হুমায়ূনহীন মেলায় ‘হুমায়ূনের দাপট’

লেখক হুমায়ূন আহমেদে মৃত্যুর পর তৃতীয় মেলাও দাপটের সঙ্গে পার করলো হুমায়ূন সাহিত্য।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 Feb 2015, 08:25 PM
Updated : 28 Feb 2015, 08:25 PM

মেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশে প্রবেশপথে ডান দিকে হুমায়ূনের সর্বোচ্চ সংখ্যক বই প্রকাশকারী অন্য প্রকাশের স্টলে পাঠকের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতো। হুমায়ূনের বই প্রকাশকারী অন্য স্টলগুলোতেও হুমায়ূন প্রেমীদের আনাগোনা দেখা গেছে মাসজুড়ে।

হুমায়ূনভক্তদের অনেকেই বললেন, এই জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিকের জীবদ্দশায় তার নতুন নতুন বইয়ের জন্য বছর ধরে পথ চেয়ে থাকতেন একুশের মেলার।

হুয়াই’র সিস্টেম প্রকৌশলী রাকিব উল হক যেমন কোনো ধরনের সংকোচ না করেই বললেন, মেলা মানেই হুমায়ূন আহমেদ, হুমায়ূন আহমেদ মানেই তার একুশের মেলা।

“হুয়ায়ূনের বই এখনো আমার কাছে তুলনামূলকভাবে অন্যদের চেয়ে ভালো মনে হয়, এ কারণে আমি হুমায়ূন সাহিত্য এখনো কিনি। আমার ধারণা, অন্য পাঠকদের কাছেও এটা মনে হয়।

“আমি নিজের জন্য ‘অখণ্ড’ কিনেছি। এই বইটা আমার পড়া হয়নি। আমার ভাগ্নির বই পড়ার অভ্যাস আছে। তাই ওর জন্য শিশু-কিশোর রচনা সমগ্র কিনেছি।”

বুয়েটের শিক্ষার্থী এনামুল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সময় প্রকাশন থেকে হুমায়ূনের নবনী কিনলাম। এটা ১৯৯৩ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। আমার পড়া হয়নি তাই কিনেছি।”

“মানুষের বোধ, মানুষের মানসিকতা, একটা যুগ-এসব নিয়েই হুমায়ূন সাহিত্য। ব্যক্তি হুমায়ূনের মৃত্যুতে এটা শেষ হয়ে যেতে পারে না।”

হুমায়ূন আহমেদের সমকক্ষ কেউ না আসায় তিনি এখনো দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন, এমন অভিমতও দিলেন কেউ কেউ।

এনামের বন্ধু বুয়েটের অপর শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, হুমায়ূন সাহিত্য বাস্তবধর্মী সাহিত্য। এ কারণেই হুমায়ূন টিকে থাকবে। তিনি থাকতে তার নতুন বইয়ের দিকে সবার দৃষ্টি ছিলো। এখন পড়া হয়নি এমন পুরাতন বইয়ের দিকে মানুষের দৃষ্টি চলে গেছে।

হুমায়ূনের শেষের দিকে অধিকাংশ বইসহ প্রায় শতাধিক বইয়ের প্রকাশনার দায়িত্ব পাওয়া অন্য প্রকাশের পরিচালক ও প্রকাশক মাজহারুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, মেলায় হুমায়ূনে কোন পরিবর্তন নাই। পাঠকদের হুমায়ূন আগের মতোই আছেন।

এবারের মেলায় হুমায়ূনের ২০-২৫টির মতো বইয়ের নতুন সংস্করণ বাজারে এসেছে। এছাড়া মেলার মাঝে দেয়ালের একটি সংস্করণ শেষ হয়ে গিয়েছিল। ১০০০ কপির এই সংস্করণ শেষ হয়ে যাওয়ার পর সেটির আরো একটি সংস্করণ আনতে হয়েছে।

সময় প্রকাশের স্বত্ত্বাধিকারী ফরিদ আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, আমাদের কাছে হুমায়ূনের ৩০টির মতো বই রয়েছে। পাঠক আমাদের কাছে এসে খুঁজে খুঁজে পুরাতন বই নিচ্ছে।

তবে সেই সঙ্গে জাফর ইকবালসহ সম-সাময়িক অন্য লেখকদের বইও পাঠক কিনছে, বলেন ফরিদ।

১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া হুমায়ূন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই লেখালেখি শুরু করে সাহিত্য সমালোচকদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন। নন্দিত নরকে তার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস।

এরপর শঙ্খনীল কারাগার, রজনী, এপিটাফ, পাখি আমার একলা পাখি, ফেরা, নিষাদ, দারুচিনি দ্বীপ, নির্বাসন, অমানুষ, রূপালী দ্বীপ, শুভ্র, দূরে কোথাও, মন্দ্রসপ্তক, বাদশাহ নামদার, সাজঘর, বাসর, নৃপতির মতো পাঠক হৃদয় জয় করা উপন্যাস আসে তার লেখনীতে।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি লিখেছেন জোৎস্না ও জননীর গল্প, ১৯৭১, সূর্যের দিনের মতো উপন্যাস।

হুমায়ূনসৃষ্টি মিসির আলী ও হিমু হয়ে উঠে পাঠকদের প্রিয় চরিত্র। অনন্ত নক্ষত্র বীথি, ইরিনার মতো কয়েকটি কল্পবিজ্ঞান কাহিনীও লিখেছেন তিনি।

হুমায়ূন তার প্রধানত সংলাপনির্ভর উপন্যাসমালায় মধ্যবিত্তের জীবনের রোমান্টিকতাকে নিখুঁতভাবে তুলে এনেছেন বলে সাহিত্য সমালোচকদের মত।

তাকে নিয়ে কবি শামসুর রাহমান লিখেছেন, “অনেক উৎকৃষ্ট রচনাই অত্যন্ত জনপ্রিয়। হুমায়ূন আহমেদ আমাদের সস্তা চতুর্থ শ্রেণির লেখকদের হাত থেকে মুক্তি দিয়েছেন।”

উপন্যাসের পর নাটক লেখায় হাত দেন হুমায়ূন। এ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে ওঠায় অধ্যাপনা ছেড়ে দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়নের এই শিক্ষক।

’৮০ এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘এইসব দিনরাত্রি’ দিয়ে জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছে যান তিনি। এরপর বহুব্রীহি, অয়োময়, কোথাও কেউ নেই, নক্ষত্রের রাতের মতো জনপ্রিয় নাটকও আসে তার হাত দিয়ে।

নাটক লেখার এক পর্যায়ে নির্দেশনায় আসেন তিনি। নাটক নির্দেশনায় হাত পাকিয়ে নামেন চলচ্চিত্র পরিচালনায়। আগুনের পরশমনি দিয়ে শুরু করে শ্রাবণমেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা, শ্যামলছায়ার মতো চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমনি কয়েকটি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল।

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কুতুবপুর গ্রামে নানা বাড়িতে হুমায়ূনের জন্ম, যার ডাকনাম কাজল। তার বাবা পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ, মা আয়েশা ফয়েজ।

নিউ ইয়র্কের ম্যানহাটনের বেলভ্যু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২০১২ সালের জুলাই দেহত্যাগ করেন বাংলা সাহিত্যের সম-সাময়িক সময়ের জনপ্রিয়তম এই লেখক।