জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর জীবনাবসান

চলে গেলেন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অধ্যাপক জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 11 Nov 2014, 08:00 PM
Updated : 12 Nov 2014, 10:18 AM

মঙ্গলবার রাত পৌনে ১২টার দিকে ঢাকার বনানীতে নিজের বাসায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত জিল্লুর রহমান জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন। এই শিক্ষাবিদ ১৯৯০-৯১ সালে অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর বয়স হয়েছিল ৮৬ বছর। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক মেয়ে রেখে গেছেন।

তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেছেন, শিক্ষা ও সমাজসেবায় অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের অবদান জাতি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক শোক বার্তায় বলেন, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী একটি জ্ঞানভিত্তিক ও প্রগতিশীল সমাজ বিনির্মাণে আমৃত্যু কাজ করে গেছেন।

এই অধ্যাপকের মৃত্যুতে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু শোক প্রকাশ করে বিবৃতি দিয়েছেন। তার সাবেক কর্মস্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃহস্পতিবার ছুটি ঘোষণা করা হয়েছে।

প্রয়াত এই অধ্যাপকের বড় ছেলে দাউদ আফজাল যুক্তরাষ্ট্রে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে রসায়নের শিক্ষক, মেজ ছেলে শাকিল আক্তার একজন চিকিৎসক, ছোট ছেলে ফারহাদ আনোয়ার মালয়েশিয়ায় একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত পদার্থ বিজ্ঞান পড়ান। তার একমাত্র মেয়ে একটি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন।

শাকিল আক্তার জানান, তার বাবা মঙ্গলবার সারাদিনই অসুস্থ বোধ করছিলেন। রাত ১০টার দিকে তার স্ট্রোক হয় এবং পৌনে ১২টার দিকে তিনি মারা যান।

রাতেই জিল্লুর রহমানের মরদেহ ঢাকার শমরিতা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।  দুই ভাই বিদেশ থেকে ফিরলে জানাজা ও দাফনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বলে জানান শাকিল। তার আগ পর্যন্ত  হাসপাতালের হিমঘরেই রাখা হবে মরদেহ।

ওই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক নুরুল আক্তার সুমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উনাকে অ্যাম্বুলেন্সেই আমরা দেখেছিলাম, আনার আগেই মারা গিয়েছিলেন উনি।”

মিয়ানমারের সঙ্গে ‘সমুদ্রজয়ের’ পর ২০১২ সালে প্রধানমন্ত্রীকে দেওয়া নাগরিক কমিটির সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে কমিটির চেয়ারম্যান জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী।

জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর জন্ম ১৯২৮ সালে ২৩ ফেব্রুয়ারি ঝিনাইদহে। ফজলুর রহমান সিদ্দিকী ও হালিমা খাতুনের এই সন্তানের পড়াশোনার হাতেখড়ি কলকাতায়, নর্মাল স্কুলে। তার বাবা ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন।

বাবার চাকরি সূত্রে বিভিন্ন স্কুল ঘুরে ১৯৪৫ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় স্টার মার্কসসহ উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন তিনি। ১৯৪৭ সালে আইএ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন।

ভারত ভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে ভর্তি হন জিল্লুর রহমান। এই বিভাগে তার সহপাঠী ছিলেন কবি শামসুর রাহমান, ডেইলি স্টারের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক এস এম আলী, সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব মুজিবুল হক।

স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে ইংরেজি সাহিত্যে প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ১৯৫২ সালে সরকারি বৃত্তি নিয়ে অক্সফোর্ডে যান তিনি।

দেশে ফেরার পর প্রথমে ঢাকা কলেজে যোগ দেন। এরপর ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগে অধ্যাপনা শুরু করেন তিনি।

১৯৭৬ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে যোগ দেন জিল্লুর রহমান। ১৯৮৪ সালে উপাচার্য পদ থেকে বিদায় নিলেও ইংরেজির অধ্যাপক হিসেবে থেকেছিলেন তিনি। এর মধ্যে বিশ্বভারতীতেও পড়িয়ে আসেন তিনি।

২০০০ সালে বেসরকারি গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য হন অধ্যাপক জিল্লুর। তিন বছর পর সেখান থেকে তিনি স্বেচ্ছা অবসর নেন।

শিক্ষা গবেষণায় নিজেকে নিয়োজিত রাখলেও জাতীয় রাজনৈতিক সঙ্কটে সবসময়ই দায়িত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে দেখা গেছে জিল্লুর রহমানকে, আর এরই ধারাবাহিকতায় নব্বইয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দিন নেতৃত্বাধীন সরকারে দায়িত্ব নেন তিনি।

বাংলা একাডেমি, এশিয়াটিক সোসাইটিতে সম্পৃক্ত থাকার পাশাপাশি বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী সমিতির সভাপতি; নাগরিক নাট্য চক্রের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন তিনি।

ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে অধ্যাপক জিল্লুর রহমানের প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা ৪০টি৷ এর মধ্যে ১৯৭৭ সালে প্রকাশিত ‘শব্দের সীমানা’ প্রবন্ধ গ্রন্থের জন্য তিনি ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ লাভ করেন৷ তার কবিতা গ্রন্থ ‘হৃদয়ে জনপদে’ বাংলা একাডেমি পুরস্কার পায়।

মুক্ত চিন্তার বিকাশে অধ্যাপনা, গবেষণা ও সৃজনশীল লেখনীর মাধ্যমে শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১০ সালে স্বাধীনতা পুরস্কার দেওয়া হয় জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীকে।