আবার পুড়ল বিএসইসি ভবন

দশ প্রতিষ্ঠান পুড়ে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সাত বছর পর রাজধানীর কারওয়ান বাজারে বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশন (বিএসইসি) ভবনে আবারো বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে।

লিটন হায়দারও কামাল তালুকদারবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Oct 2014, 06:22 AM
Updated : 31 Oct 2014, 06:22 AM

শুক্রবার ছুটির দিনের সকালে ১১ তলা ওই ভবনের সবচেয়ে উপরের তলায় আগুন লাগার পর অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর শতাধিক কর্মী দুই ঘণ্টার চেষ্টায় তা নিয়ন্ত্রণে আনেন।

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আলী আহমেদ খান অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানাতে পারেননি। তবে এ ঘটনায় কেউ হতাহত হননি বলে জানিয়েছেন তিনি।

এনটিভি, আরটিভি, আমার দেশ এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে ওই ভবনে।  যে ফ্লোরে আগুনের সূত্রপাত হয়, সেখানেই আমার দেশের কার্যালয়।

প্রকাশনা বন্ধ থাকা এই পত্রিকাটির কার্যালয় স্থানান্তরের মধ্যেই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বলে প্রতিষ্ঠানটির কর্মীরা জানান। আগুনে ওই কার্যালয়ের প্রায় সবকিছুই পুড়ে যায়।    

অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা তদন্তে বিএসইসি কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দুটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু ও স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন।

এই অগ্নিকাণ্ডকে ‘সরকারের নাশকতা’ আখ্যায়িত করে দোষীদের শাস্তি দাবি করেছে বিএনপি।  

২০০৭ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি এই ভবনে আগুন লেগে এনটিভি, আরটিভি ও আমার দেশসহ ১০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় পুড়ে যায়, মৃত্যু হয় তিন জনের।

শুক্রবার বেলা ১১টা ৪৮ মিনিটে ওই ভবনে আগুন লাগার খবর পেয়ে অগ্নি নির্বাপক বাহিনীর ১৯টি ইউনিট ঘটনাস্থলে পৌঁছে কাজ শুরু করে। এক পর্যায়ে পুরো এলাকায় কালো ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। ভবনের বিভিন্ন কার্যালয়ে থাকা কর্মীরা উত্তর দিকের বিকল্প সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেন।

বেলা ১টা ৫৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক। তবে আগুন পুরো নিভতে বিকাল হয়ে যায়।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি /বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

ভবনের দশম তলায় একটি ল’ ফার্মের কর্মী বাবলু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শর্ট সার্কিট হলে স্পার্ক করার যে রকম শব্দ হয়, তেমন আওয়াজ পেলাম হঠাৎ। এরপর  আমার দেশের দারোয়ান নেমে এসে চিৎকার করে সবাইকে নেমে যেতে বলে। ধোঁয়া দেখে তাড়াতাড়ি আমরা সবাই নেমে পড়ি।”

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোকচিত্রী আসিফ মাহমুদ অভি ঘটনাস্থল থেকে জানান, আগুন লাগার পর ভবনের ১১তলা থেকে প্রচুর কালো ধোঁয়া উঠতে দেখা যায়। এরপর পুরো এলাকায় ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ে। ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা এসে সামনে ও পেছনে দুটি মই লাগিয়ে পানি ও ফোম ছিটাতে শুরু করেন।

আগুন নেভানোর কাজে থাকা ফায়ার ম্যান আবুল হোসেন বেলা ১২টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ভবনের উত্তর দিকের লোহার সিঁড়ি দিয়ে আমি উঠতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু ধোঁয়ায় উঠতে পারিনি। তবে মনে হচ্ছে আগুন কেবল টপ ফ্লোরেই আছে।”

শুক্রবার ছুটির দিনে ওই ভবনের বেশিরভাগ কার্যালয় বন্ধ থাকলেও গণমাধ্যম কার্যালয়গুলোতে সাধারণত সবসময়ই কর্মীরা থাকেন। তবে আগুন লাগার পরপরই এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা নেমে আসেন।

বেসরকারি টেলিভিশন আরটিভির একজন বার্তা সম্পাদক আক্তার হোসেন জানান, ভবনের ষষ্ঠ তলায় তাদের কার্যালয়। সপ্তম থেকে নবম তলায় এনটিভি এবং ১১ তলায় আমার দেশের কার্যালয়। এছাড়া ছাদের ওপর দুটি টিনশেড কক্ষে এনটিভির আর্থ স্টেশন (ট্রান্সমিশন সেন্টার)।

এছাড়া দশম তলায় সরকারি ও বেসরকরি তিনটি প্রতিষ্ঠান, পঞ্চম তলায় বিএসইসির প্রকৌশল বিভাগের অফিস রয়েছে। নিচের বিভিন্ন তলায় এবি ব্যাংক, ইস্টার্ন কেবল লিমিটেড, ইস্টার্ন টিউব লিমিটেড, ন্যাশনাল টিউব লিমিটেড, এটলাস বাংলাদেশ লিমিটেডসহ সব মিলিয়ে এ ভবনে রয়েছে প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়।

ছবি: লিটন হায়দার

ছবি: লিটন হায়দার

এনটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক (সিএনই)  জহিরুল আলম ও আরটিভির বার্তা সম্পাদক আনোয়ার হক জানান, আগুন লাগার পর ভবনের বিদ্যুৎ সংযোগ বিছিন্ন হয়ে গেলে বেলা ১২টার দিকে তাদের চ্যানেলের সম্প্রচার সাময়িকভাবে বন্ধ হয়ে যায়।

পাঁচ ঘণ্টা পর বিকল্প ব্যবস্থায় এনটিভি এবং তারও দুই ঘণ্টা পর আরটিভি সম্প্রচারে ফেরে।

আমার দেশের কর্মী মাহমুদা ডলি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, তাদের পত্রিকা বন্ধ থাকলেও অনলাইনে নিয়মিত কাজ চলে।

“আমাদের অফিস আজ সকালে নিকেতনে শিফট করার কথা ছিল। এ কারণে নিউজ রুমের কেউ সকালে অফিসে ছিলেন না। আমার কাছে ঘটনাটি রহস্যজনক মনে হচ্ছে।”

একই কথা বলেন আমার দেশের নির্বাহী সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমেদ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “এটি সাধারণ আগুন নয়, এ আগুনে রহস্য রয়েছে। আগুনে ১১ বছরের পুরনো দলিলপত্র পুড়ে গেছে, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর্কাইভ ও কম্পিউটার।”

আগুন লাগার খবর পেয়ে এনটিভির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোসাদ্দেক আলী ফালু ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন, যিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের এক উপদেষ্টা এবং আমার দেশ ও আরটিভির সাবেক মালিক।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “বারবারই এ ভবনে আগুন লাগে, আর আমি বারবারই ক্ষতিগ্রস্ত হই। তদন্ত হয় কিন্তু রিপোর্ট পাই না। তদন্ত কি হয় তা জানা যায় না।

“বার বার এ ভবনে আগুন লাগে কেন তা জানা দরকার। আমি সকলের দোয়া চাই।”

আরটিভির বিশেষ প্রতিনিধি শামীমা আক্তার জানান, ভবনের ১১ তলায় আমার দেশের গোডাউন থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে তারা জানতে পারেন।

“১১ তলার উত্তর পূর্ব কোনে আমার দেশের গোডাউন, সেখানেই প্রথমে আগুন দেখা যায়। তবে আমাদের সবাই নিরাপদে নেমে এসেছে।”

ওই ফ্লোরের দক্ষিণ-পূর্ব কোণে ব্যারিস্টার তানজিমুল হকের ল’ চেম্বার। বাকিটা আমার দেশের কার্যালয়।

আমার দেশের অফিস সহকারী আব্বাস আলী হাওলাদার বলেন, “আমরা অফিস পরিবর্তনের জন্য পাঁচটা এসি ও চেয়ার লিফটে নামায়েছি। আরো মাল নামানোর প্রস্তুতি চলছিল। এ সময় উত্তর-পূর্ব দিকের স্টোর রুমে আগুনের ফুলকি দেখা যায়। স্টোর রুম তালাবন্ধ ছিল।”

স্টোর রুমের চাবি যার কাছে থাকে, তাকে ফোন করে ডেকে আনা হয় এরপর। তালা খুলে নিজেরা আগুন নেভানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে ফায়ার সার্ভিসে খবর দেন তারা। তারপর ভবন থেকে নেমে পড়েন।

“১১ তলা থেকে আমি সবার পরে নেমেছি। ১২/১৩ জন ছিলাম। কেউ আটকা পড়েনি বলেই মনে হয়”, বলেন আব্বাস।

বেলা ১টা ২৫ মিনিটে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশনস) মোহাম্মদ মাহাবুব সাংবাদিকদের জানান, তারা আগুন মোটামুটি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এসেছেন। ধোঁয়াও কমে এসেছে। ১১ তলা থেকে আগুন আর নিচে নামবে না বলেই তাদের মনে হয়েছে।

“১১ তলায় কাগজ জাতীয় প্রচুর দাহ্য পদার্থ ছিল। তাই নিয়ন্ত্রণে আনতে কষ্ট হয়েছে।”

এরপর বেলা ১টা ৫৬ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার কথা জানান ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক।

তিনি বলেন, তিনি নিজে ১১ তলায় গিয়ে পরিস্থিতি দেখে এসেছেন। কেউ হতাহত বা আটকা পড়ে থাকার তথ্য পাননি।

ছবি: আসিফ মাহমুদ অভি/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

আগুন পুরোপুরি নিভে যাওয়ার পর বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বিএসইসির সচিব মাসুদ আহমেদকে ভবন বুঝিয়ে দেন। এরপর ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় পুরো ফ্লোরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।

কার্যালয়ের কম্পিউটার, চেয়ার-টেবিল, শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র ও ফলস সিলিং সবটাই পুড়ে গেছে। বোর্ড দিয়ে করা পার্টিশনগুলো দাঁড়িয়ে আছে কঙ্কালের মতো।

১১ তলা ঘুরে দেখে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদক মোবারক হোসেন জানান, যে ‘স্টোর রুম’ থেকে আগুনের সূত্রপাত বলে ধারণা করা হচ্ছে, সেখানকার অবস্থা সবচেয়ে ভয়াবহ। সেখানে থাকা সবকিছুই পুড়ে কয়লার স্তূপে পরিণত হয়েছে।

বিএসইসি কর্মকর্তা মাসুদ আহমেদ বলেন, “ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এখনও নিরূপণ করা হয়নি। আগামীকাল বোঝা যাবে কি পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।”

আর কি কারণে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে তা উদঘাটন করতে বিএসইসির পরিচালক (অর্থ) সৈয়দ মোজাম্মেল হককে আহ্বায়ক এবং প্রধান প্রকৌশলী তাজুল ইসলামকে সদস্য সচিব করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানান বিএসইসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ইমতিয়াজ হোসেন চৌধুরী।

তিনি বলেন, কমিটিকে ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।

এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক শেখ মিজানুর রহমানকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের আরেকটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংস্থার পরিদর্শক ফরহাদ জামান।

কমিটি ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।”

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালক আলী আহমেদ খান বলেন, “একটি অফিসের মালামাল সরানো হচ্ছিল। তার মধ্যে বৈদ্যুতিক সরঞ্জামও ছিল। কি কারণে আগুন লেগেছে তদন্তে তা বোঝা যাবে।”

আগুন নেভানোর কাজ যখন চলছে,  তখনই বিএসইসি ভবনের নিচে পৌঁছান শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু।

২০০৭ সালে এ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের পর যে তদন্ত কমিটি হয়েছিল, তার প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, “আমি বিষয়টি দেখব। এখন আমার জানা নেই।”

এ সময় মোসাদ্দেক আলী ফালুর সঙ্গেও তার কুশল বিনিময় হয়।

স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল ঘটনাস্থলে যান বিকালে। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসে এখন নতুন যন্ত্রপাতি থাকায় আরো বেশি ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো গেছে।

আমার দেশে পরিকল্পিতভাবে আগুন লাগানো হয়েছে- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে প্রতিমন্ত্রী বলেন, “যেহেতু আমার দেশ প্রাইভেট অর্গানাইজেশন, তাই তাদের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা তা খতিয়ে দেখতে হবে।

“তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। শিগগিরই অগ্নিকাণ্ডের কারণ জানা যাবে।”

আগুন লাগার খবর পাওয়ার পরপরই সংবাদকর্মীরা বিএসইসি ভবনের সামনে ভিড় করেন। ওই রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে আগুন দেখে বিপুল সংখ্যক মানুষ ভবনের আশেপাশে ভিড় করলে যানজট সৃষ্টি হয়।