সীমানা পেরোলেই ‘বৈধ’

ভারতের সঙ্গে পশু বাণিজ্যের কোনো চুক্তি না থাকলেও প্রতিদিন অবৈধ পথে সীমান্ত পেরিয়ে ভারত থেকে গরু আনা হচ্ছে; বিক্রি হচ্ছে বাংলাদেশের বাজারগুলোতে। এ প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি গরু আসে কোরবানি ঈদের আগে।

লিটন হায়দারও গোলাম মুজতবা ধ্রুববিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 Sept 2014, 06:21 PM
Updated : 16 August 2015, 10:44 AM

ব্যবসায়ীরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমেই তারা বেশি গরু আনেন, কারণ নদীতে ভাসিয়ে পশু আনা অনেক সহজ হয়।

অবৈধ পথে গরু আনার এই প্রক্রিয়াটি ঝুঁকিপূর্ণ হলেও সীমান্তরক্ষী এবং রাজস্ব কর্মকর্তার ‘প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণে’ তা ‘বৈধতা’ পায় অল্প সময়ে, মাত্র পাঁচশ টাকার রফায়।

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি পশু ঢোকানো হয় বেনাপোলের পুটখালী সীমান্ত পথে।

বেনাপোল পোর্ট থানা থেকে মাত্র ৫ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে সীমান্তের কোল ঘেষে এই পুটখালী। সেখানে খাটালে (পশু যেখানে জড়ো করা হয়) প্রতিদিন শতশত পশু জড়ো করেন রাখালরা।

পুটখালী খাটালের তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল ইসলাম জানান, বেনাপোল সীমান্তের ১৫ কিলোমিটার এলাকার প্রায় ৩ হাজার পরিবারের ৫ হাজার যুবক ভারত থেকে গরু পারাপার করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ভারত সীমান্ত থেকে বাংলাদেশের মালিকের কাছে একটি গরু পার করে পৌঁছে দিতে পারলে পারিশ্রমিক পাওয়া যায় ২ থেকে ৩ হাজার টাকা।

এরপর এই খাটালে জড়ো হওয়া গরুর একটি তালিকা তৈরি করে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে করিডোরে গিয়ে গরুপ্রতি ৫০০ টাকা করে শুল্ক দিতে হয়। আর এর পুরোটাই দেখভাল করে বিজিবি।

বেশি রোজগারের আশায় জীবন বাজি রেখে রাখালরা ঝুঁকিপূর্ণ এ কাজে ঝুঁকে পড়ছেন বলেও জানান তিনি।

‘অবৈধ ব্যবসায়ও ফাঁকি’

অভিযোগ রয়েছে, শুল্ক দেওয়ার সময় কৌশলে গরুর সংখ্যা কম দেখানো হয়। তাছাড়া একটি শুল্ক রশিদ দিয়ে একাধিকবার পশু আনা নেওয়ার ঘটনাও ঘটে অহরহ।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গরুপ্রতি তাদের ৫০০ টাকা রাজস্ব গুণতে হলেও নানা কারণে খরচ পড়ে প্রায় দুই হাজার টাকা।

অবশ্য গরু আনার প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়েছিল বেনাপোলের পুটখালী বিজিবি ক্যাম্প কমান্ডার সুবেদার সামসুর রহমানের কাছে।

তিনি বলেন, “ভারতীয় ব্যবসায়ীরা পশু এনে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে। পরবর্তীতে বিজিবির তদারকিতে করিডোর থেকে পশুপ্রতি পাঁচশ’ রাজস্ব আদায়ের পর তা ছেড়ে দেওয়া হয়।”

তবে একটি রশিদ দিয়ে একাধিকবার কেনাবেচা এবং অতিরিক্ত টাকা আদায়ের বিষয়টি ঠিক নয় বলে দাবি করেন তিনি।

আর বিজিবি উপ মহাপরিচালক আবুল হাসনাত মোহাম্মদ খায়রুল বাশার বলছেন, পশুর রাজস্ব আদায়ের বিষয়টি রাজস্ব কর্মকর্তারাই দেখে থাকেন। তাছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে স্থানীয় জেলা প্রশাসকরা খাটালের ইজারা দেন। সুতরাং এগুলো বিজিবির বিষয় নয়।

‘জলে ভেসে আসে গরু’

সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দেশে প্রতিবছর প্রায় ৩৫ লাখ গরু জবাই হয়। এর অর্ধেকই হয় কোরবানি ঈদে। তবে এই বিপুল পরিমাণ চাহিদা দেশীয় গরু দিয়ে মেটে না।

তাই বিভিন্ন সীমান্ত পথে বেশি দামের আশায় আনা হয় গরু।

উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাগঞ্জের সদর উপজেলার বাখের খালি, শিবগঞ্জের মনোহরপুর, মাসুদপুর এবং গোমস্তাপুর উপজেলার বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় গরু আসে। মূলত বর্ষা মৌসুমে নদী দিয়ে ভাসিয়ে এসব গরু আনা হয়।

এছাড়া নওগাঁ জেলার সাপাহার, পোরশা, পত্নীতলা, ধামইর হাট উপজেলার হাপানিয়া, কলমুডাঙ্গা, সোনাডাঙ্গা, নিতপুর, দোয়ারপাল, কালুপাড়া, বস্তাবর,, চকচণ্ডি, হাটশাইল সীমান্ত রুট দিয়েও বাংলাদেশে গরু ঢোকে।

সাতক্ষীরা সীমান্তের সদর উপজেলার ভোমরা, গাজীপুর, ঘোনা, বৈকারি ও কুশখালি কলারোয়া উপ জেলার মাদরা, চান্দুডিয়া, সোনাবাড়িয়া, দেবহাটা উপজেলার কোমরপুর, ভাতশালা, কালিগঞ্জ উপজেলার খানজিয়া দিয়েও ওপার থেকে এপারে গরু আনা হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

এর বাইরে চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার মেদেনিপুর ও বেনীপুর এবং দামুড়হুদা উপজেলার মুন্সিপুর ও ঠাকুরপুর দিয়েও গরু ঢুকছে দেদারসে।

তারা জানান, ভারত থেকে মূলত রাজস্থানী, সিন্ধি ও হরিয়ানা জাতের গরু আনা হয়।

চুয়াডাঙ্গা ৬ বিজিবি ব্যাটালিয়নের লেফটেনেন্ট কর্নেল এসএম মনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, গত বছর এসব সীমান্ত দিয়ে এক লাখ ৭১ হাজার ৩৪১টি গরু এসেছে। এ বছর এ পর্যন্ত এসেছে ৮৯ হাজার ৭৭১টি।

দামুড়হুদা উপজেলার কার্পাসডাঙ্গা গবাদি পশু শুল্ক করিডোরের ইনচার্জ খাইরুল বাশার জানান, ঈদের কারণে প্রতিদিন গড়ে দুই শতাধিক গরু আনা হচ্ছে বাংলাদেশে, যা অন্য সময়ের চেয়ে প্রায় দ্বিগুণ।

বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে গরু আনা হলেও দেশের ৪০টির মতো খাটালের বেশিরভাগই বন্ধ। ফলে রাজস্ব হারাতে হচ্ছে সরকারকে।

এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গতবছর কোরবানি ঈদের আগে (জুলাই, অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর) তিন মাসে বেনাপোল শুল্ক করিডোর দিয়ে ২ লাখ ৭২ হাজার ৬২৮টি পশু বাংলাদেশে ঢোকে, যা থেকে ১৩ কোটি ৬৩ লাখ ১২ হাজার ৬শ’ টাকা রাজস্ব আদায় হয়।

তবে চলতি বছরের প্রায় একই সময় (আড়াই মাসে) ওপার থেকে এসেছে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৬৬৫টি পশু, যা থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ৬ কোটি ৮৩ লাখ ৩০ হাজার ৫শ’ টাকা।

দুই দেশের মধ্যে পশু বাণিজ্য না থাকার কারণকে সীমান্তে হত্যার মূল কারণ হিসাবে তুলে ধরে সম্প্রতি কলকাতায় এক সেমিনারে এই ব্যবসাকে বৈধতা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন দুই দেশের প্রতিনিধিরা।

তারা বলেন, ব্যবসাটিকে বৈধতা দিলে সুবিধা পাবে দুই দেশই।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে সহায়তা করেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের বেনাপোল, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি)