শিক্ষামন্ত্রীর দেড় ঘণ্টার নাটক

প্রকাশকদের আগেই খবর দিয়ে, একদল সাংবাদিক সঙ্গে নিয়ে বাংলাবাজার এলাকা ‘আকস্মিক’ পরিদর্শন করে পাঠ্যবই ছাপানোর মান দেখলেন ও দেখালেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ।

শহীদুল ইসলামবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2014, 12:05 PM
Updated : 21 Sept 2014, 01:08 PM

সোমবার বেলা ২টায় সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনে থেকে ২৫টি গাড়ির বহর নিয়ে শুরু হওয়া মন্ত্রীর ‘ঘাম-ঝরানো’ অভিযান চলে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত।

মন্ত্রীর অভিযান চালাকালেই প্রকাশনার সঙ্গে জড়িত বাংলাবাজারের একাধিক ব্যক্তি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মন্ত্রীর আসার খবর তারা দুদিন আগেই পেয়েছেন।

রোববার মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও ‘আকস্মিক’ অভিযানের খবর সংগ্রহ করতে সংবাদ মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক আমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে বলা হয়, সাংবাদিকদের জন্য গাড়িরও ব্যবস্থা রয়েছে।

এছাড়া মন্ত্রীর ‘আকস্মিক’ অভিযান নিয়ে শুক্র ও শনিবার সাংবাদিকদের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন বাংলাবাজারের একাধিক প্রকাশক।

অভিযান ‍শুরু: বেলা ২টা

বেলা ২টায় সচিবালয়ের এক নম্বরে ফটকের সামনে আগে-পিছে দুটি পুলিশ ভ্যান নিয়ে দাঁড়ায় শিক্ষামন্ত্রীর গাড়ি। মন্ত্রীর গাড়ির পেছনে জড়ো হতে থাকে সাংবাদিকদের গাড়ি। বহরে যুক্ত হয় ২৪/২৫টি গাড়ি।

মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বহরের সবাইকে হাজীর বিরিয়ানি, আর সি কোলা আর বোতলজাত পানি সরবরাহ করা হয়। তবে সব সাংবাদিক মন্ত্রণালয়ের খাবার নেননি।

প্রথম পর্ব

যানজট ঠেলে ২টা ২৫ মিনিটে মন্ত্রীর গাড়ির বহর থামে বাংলাবাজারে ঢাকা সদর ডাকঘরের প্রধান কার্যালয়ের সামনে। সেখানে আগে থেকেই উপস্থিত বাংলাবাজারের প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির কয়েকজন নেতা মন্ত্রীকে স্বাগত জানান।

তাদের উদ্দেশে মন্ত্রী বলেন, “দেখতে আসলাম। মন্ত্রী হিসাবে প্রথম এখানে এলাম।”

সমিতির নেতাদের ধন্যবাদ পেয়ে তাদের সঙ্গে নিয়েই মন্ত্রী পায়ে হেঁটে পৌঁছান ৫/১, প্রতাপদাস লেনের মনির প্রেসে। অবশ্য বাংলাবাজার নেমেই এনসিটিবির উৎপাদক ও নিয়ন্ত্রক মুস্তাক আহমেদকে পুলিশসহ ওই প্রেসে পাঠিয়ে দেন তিনি।

এরপর দল নিয়ে প্রেসে ঢুকেই কাগজ ‘পরীক্ষা’ করেন মন্ত্রী। তাতে হাত লাগান সাংবাদিকরাও।

এই প্রেসের মালিক মঞ্জুর মোরশেদ আজাদ মন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে কয়েকবার সাংবাদিকদের বলেন, “মন্ত্রী আসবেন, তা কিন্তু আমরা জানতাম না।”

তবে প্রেসের একজন কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রী আইবো, এটা তো সবাই জানি। দ্যাহেন না সব কিছু ফিটফাট।”

যে কাগজে বই ছাপানো হচ্ছে তা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য তার কিছু নমুনাও ওই প্রেস থেকে সঙ্গে নেন নাহিদ।

গুদাম পর্ব

বাংলাবাজারের প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির নেতাদের সঙ্গে নিয়ে ২টা ৫৮ মিনিটে মন্ত্রী হাজির হন বইয়ের একটি গুদামে। বদ্ধ গুদামে ঘেমে একাকার হয়ে যান মন্ত্রী ও তার সঙ্গে থাকা লোকজন।

প্রেস থেকে বের হয়ে মন্ত্রী কোন গুদামে যাবেন এনিয়ে যখন কথা চলছিল; তখন সমিতির একজন নেতা অন্য নেতাদের বলেন, “ওহানে চলেন, সব রেডি করা আছে।”

তাদের রেডি করা গুদামে ঢুকেই ছাপানো বইগুলো প্রায় ১৫ মিনিট ধরে নাড়াচাড়া করেন শিক্ষামন্ত্রী। সাংবাদিকদের একাধিকবার বলেন, “দ্যাখেন বইগুলো তো ঠিকই আছে, তাই না?”

সাংবাদিকদের কেউ কেউ মন্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে অতিরিক্ত গরমের কারণে গুদাম থেকে বের হয়ে যান। বেশ কয়েকটি টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে কেউ কেউ বইয়ের কাগজ আসলেই ঠিক আছে কি না তা মন্ত্রীর সঙ্গে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করেন।

গুদাম থেকে বের হওয়ার আগে সাংবাদিকদের মন্ত্রী বলেন, “জাতীয় স্বার্থে গরমে কষ্ট করার জন্য ধন্যবাদ।”

প্রেস থেকে গুদামে আসার সময় পথে স্কুলভ্যানে থাকা কয়েকজন শিশুর সঙ্গে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। এক শিশুকে মোবাইলে কথা বলতে দেখে মন্ত্রী বলেন, “কী মাকে খবর দিচ্ছ যে বাড়ি ফিরছি, তাই না?”

পর্ব: ‘ফাটাকেষ্ট’

প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ হেঁটে ৩টা ১৬ মিনিটে বাংলাবাজারের রাস্তায় দাঁড়ানো একটি ভ্যানের কাছে থামেন মন্ত্রী। ওই ভ্যানে থাকা বোর্ডের বইগুলো পরীক্ষা করেন তিনি।

এদিকে মন্ত্রীর পরিদর্শনের খবরে বাংলাবাজার এলাকায় কয়েকশ মানুষ মন্ত্রীর পিছু পিছু হাঁটা শুরু করেন, বন্ধ হয়ে যায় রাস্তায় যান চলাচল।

হেঁটে যাওয়ার সময় মন্ত্রীকে রাস্তার দুই ধারের জনতা ও বইয়ের দোকানিদের উদ্দেশে হাত নাড়তে দেখা যায়। ঘেমে একাকার হলেও মন্ত্রীর মুখ হাসিমাখাই ছিল।

নাহিদকে সচরাচর এভাবে রাস্তায় দেখা না যাওয়ায় একজন পথিক বেশ জোরেশোরেই বলেন, “যোগাযোগমন্ত্রীর মতো নতুন ফাটাকেষ্ট সাজছে।”

মন্ত্রীর হেঁটে যাওয়ার সময় সাহিত্য সাগর প্রকাশনীর ওয়াহেদুজ্জামান বইয়ের একজন দোকানিকে বলেন, “তোদের তো আগেই বলেছিলাম, আজ মন্ত্রী আসবে।”

ভ্যানের বই পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সাংবাদিকদের কয়েক দফা ব্রিফ করেন নাহিদ। বইয়ের ছাপা ও কাগজ যে আসলেই ভালো, তাই ছিল তার বক্তব্য।

পরে ঢাকা সদর ডাকঘরের প্রধান কার্যালয়ের সামনে মন্ত্রীকে ফুলের তোড়া দিয়ে শুভেচ্ছা জানান বাংলাবাজার প্রকাশক ও বিক্রয় সমিতির নেতারা।

এই সমিতির সভাপতি আলমগীর শিকদার বলেন, “খারাপ কাগজে বোর্ডের বই ছাপা হচ্ছে কেউ এমন প্রমাণ দিতে পারলে ৫০ হাজার টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে।”

বিকাল ৩টা ৩০ মিনিটে ২৫টি গাড়ির বহর নিয়ে বাংলাবাজার থেকে চলে আসেন শিক্ষামন্ত্রী।

ফুলের তোড়া কি আগে থেকেই তৈরি ছিল- এ প্রশ্নে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক প্রকাশক নেতা বলেন, “সবই তো বুঝেন, তাহলে প্রশ্ন করেন কেন?”