এখনও মুক্তির খোঁজে উ সুয়ে

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে বাঙালির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মিছিলে গিয়েছিলেন ১৮ বছরের রাখাইন তরুণ উ সুয়ে হাওলাদার। এখন বিরাশি। জীবন সায়াহ্নে এসে হিসাব মেলাতে গিয়ে চাওয়া-পাওয়ার সমীকরণ মেলে না। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় বললেন ৫২ থেকে ৭১’র নানা স্মৃতিকথা।

আশিক হোসেনবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Sept 2014, 09:53 AM
Updated : 15 Sept 2014, 09:53 AM
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম: শুনেছি আপনি ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

উ সুয়ে হাওলাদার: ভাষা আন্দোলন মানে তখন তো ছাত্রজীবন, আন্দোলন মানে আমি মিছিলে নেমেছিলাম বরিশালে। ‘বাংলা ভাষা দিতে হবে, দিতে হবে’ শুনে আমি উদ্বুদ্ধ হয়ে স্কুল পালিয়ে মিছিলে নেমেছিলাম।

তখন বয়স কত ছিল আপনার?

তখন তো.... ১৮ বছর।  বরিশাল ব্যাপ্টিস্ট মিশন স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষা দেওয়ার কথা ছিল সেবছর। অবশ্য বিভিন্ন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত হয়ে আমি সেবছর পরীক্ষা দিতে পারি নাই।

সে সময়ের কোন স্মৃতি মনে আছে আপনার? মানে আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হলেন কিভাবে?

আন্দোলনের মধ্যে সে সময় সবাই তো ছাত্র, শিক্ষক, রাজনীতিবিদ সবাই মিলে মিছিলে নামল। রাষ্ট্র ভাষা বাংলা দিতে হবে দিতে হবে এই। তখন বাংলা ভাষার জন্য আমি সকলের সাথে মিছিলে নামি।

ভাষা আন্দোলনের মিছিলে যখন গেলেন আপনার সঙ্গে আপনার কোনও রাখাইন বন্ধু কি গিয়েছিল?

না, তখন তো রাখাইনরা ভয়ে যেতে পারেনি। আমি পালিয়ে মিছিলে গিয়েছিলাম। স্কুলে ধরা পরার ভয়ে আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম। আমার জানা মতে বরিশালের অন্য কোন রাখাইন আর যায়নি।

এরপরে কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন?

হ্যাঁ, ১৯৫৭ সালে বরিশাল জেলার তদানিন্তন আব্দুর রব সেরনিয়াবাত সাহেবের নেতৃত্বে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) তখন মনটা চাচ্ছিল যে এটা একটা প্রগতীশীল দল, মেহনতি মানুষের রাজনৈতিক দল। এজন্য অন্যান্য বন্ধুদের সঙ্গে তাদের পাশে আমি দাঁড়িয়েছিলাম।

ভাষা আন্দোলনের পরে তো আরো অনেকগুলো রাজনৈতিক আন্দোলন হয়েছে, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণআন্দোলন, ৭০’র নির্বাচন এবং সবশেষ ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এগুলোতে কি আপনি অংশ নিয়েছিলেন?

৭০ এর ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিতে আমি অংশ নিয়েছি তো। ন্যাপ এর পক্ষ থেকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলাম। সে সময় তো ছিলেন ওয়ালি খান, তার গ্রুপের প্রফেসর মোজাফ্ফর, পঙ্কজ ভট্টাচার্য ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। সে সময় নির্বাচন করেছি। আমি তখন কুড়েঘরের পক্ষে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি।

আর মুক্তিযুদ্ধের সময় তো ছিন্নভিন্ন অবস্থা। সে সময় অনেকে পালিয়ে গেল, হিন্দুরা মন্দিরে আশ্রয় নিত, তাদের আশ্রয় দিতাম। খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করতাম। আমি তো এখানেই ছিলাম। আমাদের ক্যাম্প ছিল। মন্দিরে মেয়েদের, বেশিরভাগ হিন্দুরা এবং অনেক মুসলিমও আশ্রয় নিয়েছিল।

রাখাইনদের ভাষা ও সংস্কৃতি তো বাঙালিদের থেকে আলাদা তারপরেও আপনি কোন চেতনা থেকে ভাষা আন্দোলনে গেলেন?

আমি আন্দোলনে গিয়েছি কারণ আমি যে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেটা অনুযায়ী আমার মনে হয়েছিল আমি যদি এ লাইনে যাই তাহলে আমার সমাজের আমার লোকজনের কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষের এবং স্থানীয় মানুষের মুক্তি আসবে।

মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে আন্দোলন করেছি। সবাই যেন নিজেদের ভাষা, সংস্কৃতি পালন করতে পারে- এজন্য আন্দোলন করেছি।

তার মানে যখন  ভাষা আন্দোলনে গেলেন তার আগে থেকেই আপনি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন?

হ্যাঁ, আমি তার আগে থেকেই রাজনীতির সাথে যুক্ত। সে সময় আমি ছাত্র ইউনিয়ন করতাম। খুব বেশি না, আমি ইউনিয়নের সাথে চলাফেরা করতাম।

আজ এতদিন পরে রাখাইনদের কি কোন পরিবর্তন এসেছে? মানে যে চিন্তা ও চেতনা থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে তা কি বাস্তবায়িত হয়েছে?

৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দিলেন, এই যে মুক্তির কথা বললেন… এটার কথা চিন্তা করে আমাদের সমাজের সবাই কিন্তু আশা করেছিলেন পরিবর্তন আসবে। কিন্তু এ আশা এখন প্রতিফলিত হচ্ছে না।