সমুদ্রসীমা: বাংলাদেশ পেল সাড়ে ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার

বঙ্গোপসাগরের বিরোধপূর্ণ সাড়ে ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকার মধ্যে প্রায় সাড়ে ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার এলাকা বাংলাদেশকে দিয়ে ভারতের সঙ্গে নতুন সমুদ্রসীমা নির্ধারণ করে দিয়েছে আন্তর্জাতিক সালিশি আদালত।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2014, 08:41 AM
Updated : 8 July 2014, 05:39 PM

পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী মঙ্গলবার ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে এই রায়ের কথা প্রকাশ করে বলেন, “এই রায়ের ফলে বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গ কিলোমিটারের বেশি টেরিটোরিয়াল সমুদ্র, ২০০ নটিক্যাল মাইল একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্রগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানের তলদেশে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের উপর সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছে।”

বঙ্গোপসাগরের সীমা, অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং মহীসোপানের তলদেশে সার্বভৌম অধিকার নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের দাবির শুনানি শেষে নেদারল্যান্ডসের স্থায়ী সালিশি আদালত বা পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশন (পিসিএ) সোমবার রায়ের অনুলিপি দুই দেশের রাষ্ট্রদূতের কাছে হস্তান্তর করে।

ট্রাইব্যুনালের পাঁচ বিচারকের মধ্যে  পেমারাজু শ্রীনিবাস রাও ভিন্নমত পোষণ করলেও বিচারকমণ্ডলীর সভাপতি রুডিগার ভোলফ্রাম এবং টমাস এ মেনসাহ ও আইভান শিয়েরার জ্যঁ-পিয়ের কৎয়ের মতামত অনুসারে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বিরোধ মীমাংসা করেছে আদালত।

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য ট্রাইব্যুনাল বিরোধপূর্ণ আনুমানিক ২৫ হাজার ৬০২ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকার মধ্যে ১৯ হাজার ৪৬৭ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকা বাংলাদেশকে দিয়েছে।

“এই রায় উভয় রাষ্ট্রের জন্য বিজয় নিশ্চিত করেছে। এই বিজয় বন্ধুত্বের বিজয়। এই বিজয় বাংলাদেশ ও ভারতের জনগণের বিজয়।”

দীর্ঘদিনের বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানে সদিচ্ছা দেখানোয় এবং ট্রাইব্যুনালের রায় মেনে নেয়ার জন্য ভারত সরকারকে সাধুবাদ জানান তিনি।

মন্ত্রী জানান, ট্রাইব্যুনালের রায় উভয় রাষ্ট্রের সমুদ্র সীমানা চিহ্নিত করে দিয়েছে, যার বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ নেই। এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক আদালতে ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা সম্পর্কিত মামলার সমাপ্তি ঘটল।

বিরোধ এবং রায়

২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর দ্য হেগের পিস প্যালেসে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা নির্ধারণ মামলার মৌখিক শুনানিতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলে ছিলেন এজেন্ট দীপু মনি, পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক এবং মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম। দুই পক্ষের যুক্তিতর্ক উত্থাপন শেষে মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ রাখা হয়েছিল।

সমুদ্রসীমা নিয়ে ভারতের সঙ্গে বিরোধের প্রধান বিষয় ছিল দুই দেশের জলসীমা শুরুর স্থান নির্ধারণ। এছাড়া ভূমিরেখার মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রে রেখা টানার পদ্ধতি নিয়েও মতবিরোধ ছিল।

সমুদ্রসীমা বিরোধের ক্ষেত্রে ভারত সমদূরত্বের ভিত্তিতে রেখা টানার পক্ষে মত দিলেও বাংলাদেশ ন্যায্যতার ভিত্তিতে রেখা টানার দাবি জানায়।

বাংলাদেশের দাবি ছিল, বঙ্গোপসাগর ও ভূমির মূলবিন্দু থেকে সমুদ্রের দিকে ১৮০ ডিগ্রির সোজা রেখা যাবে। তবে ভারত বলে- সমুদ্রতট বিবেচনায় এ রেখা হবে ১৬২ ডিগ্রি থেকে।

দুই পক্ষের দাবি বিবেচনা করে ট্রাইব্যুনাল বলেছে, দুই দেশের সমুদ্রসীমা শুরু হবে ২১ ডিগ্রি ৩৮ মিনিট ৪০.২ সেকেন্ড উত্তর অক্ষাংশ, ৮৯ ডিগ্রি ৯ মিনিট ২০ সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে।

এরপর ২১ ডিগ্রি ২৬ মিনিট ৪৩.৬ সেকেন্ড উত্তর অক্ষাংশ, ৮৯ ডিগ্রি ১০ মিনিট ৫৯.২ সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমাংশ এবং ২১ ডিগ্রি ৭ মিনিট ৪৪.৮ সেকেন্ড উত্তর অক্ষাংশ, ৮৯ ডিগ্রি ১৩ মিনিট ৫৬.৫ সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ছুঁয়ে এই রেখা অগ্রসর হবে দক্ষিণে। ৮৯ ডিগ্রি ১৩ মিনিট ৫৬.৫ সেকেন্ড পূর্ব দ্রাঘিমাংশ থেকে ১৭৭ ডিগ্রি ৩০ মিনিট দিগংশে (ওই বিন্দু থেকে ঘড়ির কাঁটার দিকে প্রমিত কোণ) এই রেখা বাংলাদেশ-মিয়ানমার সমুদ্রসীমার সঙ্গে মিলবে।

শুনানিতে বাংলাদেশের পক্ষে কৌঁসুলী হিসেবে ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের পল রাইখলার ও লরেন্স মার্টিন, যুক্তরাজ্যের অধ্যাপক জেমস ক্রাফোর্ড, ফিলিপ স্যান্ডস ও অ্যালান বয়েল এবং কানাডার অধ্যাপক পায়াম আখাভান।

মামলায় বাংলাদেশের এজেন্ট ও সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি বলেন, “আজ আমাদের আনন্দের দিন। ন্যায্যতার জয় হয়েছে। সকল পক্ষের জয় হয়েছে। এটা উইন উইন সিচুয়েশন।আমাদের যা দরকার আমরা তা পেয়েছি। প্রতিবেশী দেশও তাদের যা পাওয়ার তা পেয়েছে।”

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমও উপস্থিত ছিলেন।

প্রতিবেশী এ দুটি দেশের সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনা শুরু হয় ১৯৭৪ সালে। দীর্ঘ সময়ে কয়েকটি বৈঠক হলেও সমাধান না পেয়ে ২০০৯ সালের ৮ অক্টোবর আন্তর্জাতিক আদালতে যায় বাংলাদেশ। সেখানেও সমঝোতা না হওয়ায় ২০১১ সালের মে মাসে বিষয়টি হেগের আদালতে গড়ায়।

এর আগে ২০১২ সালে জার্মানির হামবুর্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আদালত মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধের যে রায় দেয় তাতে নায্যতার ভিত্তিতে বঙ্গোপসাগরে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত জলসীমা পায় বাংলাদেশ।

মানচিত্রে এই জায়গাতেই ছিল তালপট্টির অবস্থান

তালপট্টি প্রসঙ্গ

বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ তালপট্টি দ্বীপটি আর না থাকলেও আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ে সমুদ্রের ওই অংশটি ভারতের ভাগে পড়েছে বলে দীপু মনি সংবাদ সম্মেলনে জানান।

তিনি বলেন, “তালপট্টি এখন নেই। তালপট্টি যে জায়গায় ছিল এ সীমানাটি ভারতের দিকে পড়লেও এর নিচের (দক্ষিণে) বিশাল জায়গায় আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।”

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের পর সাতক্ষীরা জেলার হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনায় এই নতুন দ্বীপের উৎপত্তির পর  বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এর মালিকানা দাবি করে নাম দেয়া হয় দক্ষিণ তালপট্টি। অন্যদিকে ভারতও নিজেদের মানচিত্রে এর অধিকার দাবি করে, নাম দেয় পূর্বাশা বা নিউ মুর।

এ দ্বীপের মালিকানা নিয়ে আশির দশকে বাংলাদেশ-ভারত টানাপড়েন নতুন মাত্রা পায়। ১৯৭৯ সালে বাংলাদেশ একটি যৌথ সমীক্ষার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু ভারত ১৯৮১ সালে সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে নিজেদের পতাকা ওড়ায়। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে তালপট্টি সমুদ্রগর্ভে হারিয়ে যায়।

এ মামলায় বাংলাদেশের ডেপুটি এজেন্ট ও মেরিটাইম অ্যাফেয়ার্স ইউনিটের সচিব অবসরপ্রাপ্ত রিয়ার অ্যাডমিরাল মো. খুরশেদ আলম বলেন, “আপনারা জানেন-এটা একটা বালির দ্বীপ। ১৯৭০ সালে যে সাইক্লোন হয়েছিল, তখন তা উঠেছিল। পরে ১৯৮৫ সালে উড়িরচরে যে সাইক্লোন হয়, তাতে তা বিলীন হয়ে যায়। সে সময় থেকে আর এটা [দক্ষিণ তালপট্টি] আর নেই। ম্যাপে তো দেখতেই পাচ্ছেন আপনারা।”

পার্মানেন্ট কোর্ট অব আর্বিট্রেশনে বাংলাদেশ-ভারত সমুদ্রসীমা মামলার শুনানি

‘বড় সাফল্য’

এ রায় থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে পাওয়ার পয়েন্টে একটি বিশ্লেষণ তুলে ধরেন খুরশেদ আলম।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ ছিল ৮০ হাজার বর্গ কিলোমিটারের, এর মধ্যে পেয়েছি ৭০ হাজার বর্গ কিলোমিটার। ভারতের সঙ্গে বিরোধ ছিল ২৫ হাজার বর্গ কিলোমিটারের, এর মধ্যে আমরা পেয়েছি সাড়ে ১৯ হাজার বর্গ কিলোমিটার। এবার আপনারাই মূল্যায়ন করুন- কতটুকু জিতেছি।”

পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে চলা একটি বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান হয়েছে। এর চেয়ে বড় সাফল্য আর কী আছে?”

সাগরে অর্জিত নতুন এলাকা ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জনেও সরকার পদক্ষেপ নিচ্ছে বলে জানান তিনি।

মাহমুদ আলী বলেন, এ লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ১ ও ২ সেপ্টেম্বর ‘ব্লু-ইকনমি’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক কর্মশালার আয়োজন করতে যাচ্ছে।