সিদ্ধিরগঞ্জে গণশুনানিতে মিলল অপহরণের প্রত্যক্ষদর্শী

স্থানীয়দের দাবির মুখে সাত খুন তদন্ত কমিটির গণশুনানি নারায়ণগঞ্জ শহর থেকে সরিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জে নেয়ার পর সাক্ষ্য দিলেন ১৯৮ ব্যক্তি, যাদের মধ্যে একজন অপহরণের ঘটনা দেখেছিলেন বলে জানিয়েছেন।

মুজিবুল হক পলাশ নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2014, 03:58 PM
Updated : 17 May 2014, 04:22 PM

আলোচিত এই হত্যাকাণ্ড তদন্তে হাই কোর্টের নির্দেশে গঠিত সাত সদস্যের এই কমিটি এর আগে দুদিন নারায়ণগঞ্জ শহরে গণশুনানি নিলেও তাতে তেমন সাড়া মেলেনি।  

আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে অনেকে শহরে গিয়ে সাক্ষ্য দিতে চাইছেন না বলে জানানো হলে তৃতীয় দিনের গণশুনানি নিহত কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের এলাকা সিদ্ধিরগঞ্জে করার সিদ্ধান্ত হয়।

অভিযোগের মুখে থাকা র‌্যাবের সাবেক দুই সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর শনিবার সকাল ১১টায় সিদ্ধিরগঞ্জ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভেতরে রেস্ট হাউজে শুনানি শুরু হলে ৩০০ জন সাক্ষ্য দিতে নিজেদের নাম তালিকাভুক্ত করেন। এর মধ্যে ১৯৮ জনের সাক্ষ্য বিকাল পর্যন্ত নেয়া হয়।

এদের মধ্যে বন্দর থানা এলাকার বাসিন্দা কাপড় ব্যবসায়ী মো. সাহিদুল ইসলাম অপহরণের ঘটনা দেখেছেন বলে জানিয়েছেন। সিদ্ধিরগঞ্জের বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী ওই সময় র‌্যাবের গাড়ি দেখার কথা জানিয়েছেন।

২৭ এপ্রিল মেয়ের পরীক্ষা শেষে তাকে নিয়ে মোটর সাইকেলে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন ব্যবসায়ী সাহিদুল।

তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্য দিয়ে বেরিয়ে সাহিদুল সাংবাদিকদের বলেন, “দুপুর আনুমানিক দেড়টার দিকে রাস্তায় র‌্যাব-১১ এর দুটি গাড়ি দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি। অন্য দুইটি গাড়ি থেকে কিছু লোককে র‌্যাবের গাড়িতে জোর করে তোলা হচ্ছিল।

“এসময় কয়েকজনের হাতে পিস্তল ছিল, যা দিয়ে তাদের মাথায় আঘাত করতে দেখা গেছে।”

ওই ঘটনা দেখে থামলে র‌্যাব সদস্যরা ধমক দিয়ে চলে যেতে বললে চলে আসেন বলে সাহিদুল জানান।

তার ধারণা ছিল, র‌্যাব চেকপোস্ট বসিয়ে অপরাধীদের তল্লাশি করছে। পরে তিনি গণমাধ্যমে নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণের বিষয়টি দেখতে পান।

হত্যাকাণ্ডের শিকার নজরুল কিংবা মামলার প্রধান আসামি নূর হোসেন কারো সঙ্গে পরিচয় ছিল না জানিয়ে এই ব্যবসায়ী বলেন, “বিবেকের তাড়নায় এসে সাক্ষ্য দিয়ে গেলাম।”

২৭ এপ্রিল দুপুরে নজরুল নারায়ণগঞ্জের আদালতে একটি মামলায় হাজিরা দিয়ে বেরিয়ে লিংক রোড হয়ে ঢাকা যাচ্ছিলেন। আইনজীবী চন্দন কুমার সরকারের গাড়ি বেরিয়েছিল তার পেছনেই।

গত ৩০ এপ্রিল লাশ উদ্ধারের ছবি

লিংক রোড থেকে অপহরণের তিন দিন পর বন্দর উপজেলায় শীতলক্ষ্যা নদীতে সাতজনের লাশ পাওয়া যায়। লাশের ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক বলেছেন, প্রথমে মাথায় আঘাতের পর শ্বাসরোধে সাতজনকে হত্যা করা হয়।

তদন্ত কমিটিতে সাক্ষ্য দিয়ে বেরিয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, অপহরণের দিন দুপুরের পর লিংক রোড দিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে ফতুল্লা স্টেডিয়ামের একটু সামনে রাস্তার পশ্চিম পাশে র‌্যাবের দুটি গাড়ি দেখেছিলেন তিনি।

সিদ্ধিরগঞ্জের মিজমিজি পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আলী পরে খবর শোনেন তার এলাকার কাউন্সিলর নজরুলসহ সাতজনকে অপহরণ করা হয়েছে।

এরপর তিনি বাড়িতে ফিরে দেখেন যে তার প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেন আসিফের স্ত্রী ঘরের সমস্ত মালামাল নিয়ে অন্য স্থানে চলে যাচ্ছেন।

“জিজ্ঞাসা করলে সে (আসিফের স্ত্রী) জানায়, বাবার বাড়িতে চলে যাচ্ছি,” বলেন মোহাম্মদ আলী।

অপহরণ ও হত্যাকাণ্ডের নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটির দায়ের করা মামলার পাঁচ নম্বর আসামি আনোয়ার পলাতক রয়েছেন।

পলাতক নুর হোসেনের মামলায় নজরুলের সঙ্গে আসামি সিদ্ধিরগঞ্জের শহিদুল ইসলামও তদন্ত কমিটিকে সাক্ষ্যে র‌্যাবের সম্পৃক্ততার অভিযোগ তোলেন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার দিন আদালতে নজরুলকে এক লোক অনুসরণ করছিল।

“আমাদের সন্দেহ হলে তাকে আটক করে কোর্ট পুলিশের হাতে তুলে দিই। পরে র‌্যাবের পোশাক পরা একজন এসে কোর্ট পুলিশের সঙ্গে কথা বলে ওই লোকটিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যায়। কোর্ট পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলে তারা জানায়, লোকটি র‌্যাবের বিশেষ গোয়েন্দা সদস্য।”

এ থেকে শহিদুলের ধারণা, র‌্যাবই নজরুলসহ সাতজনকে উঠিয়ে নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দিয়েছে।

নজরুলের এলাকা মিজমিজির বাসিন্দা বৃদ্ধ আব্দুল খালেক সাক্ষ্য দিতে এসে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “গত ১ ফেব্রুয়ারি নূর হোসেনের লোকজন নজরুলকে মারতে এসে এলাকায় তাণ্ডব চালায়। পরে নূর হোসেনই নজরুলের বিরুদ্ধে মামলা দিলে সেই মামলায় হাজিরা দিতে গিয়ে নজরুল অপহরণ হয়।”

পলাতক নূর হোসেন

“নূর হোসেনই র‌্যাবকে দিয়ে নজরুলসহ সাতজনকে খুন করিয়েছে,” দাবি করেন তিনি।

সকালে গণশুনানির শুরুতে সিদ্ধিরগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় কয়েকশ’ নারী-পুরুষ সাক্ষ্য দিতে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের রেস্ট হাউজের সামনে জড়ো হন।

তখন তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে বলা হয়, যারা ঘটনার প্রকৃত প্রত্যক্ষদর্শী তারাই যেন সাক্ষ্য দিতে আসেন। এসময় উপস্থিত সবাই তাদের সাক্ষ্য নেয়ার দাবি জানান। এরপর তালিকাভুক্ত করে সাক্ষ্য নেয় তদন্ত কমিটি।

তদন্ত কমিটির সদস্য মোস্তাফিজুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছেন, তদন্তের স্বার্থে র‌্যাবসহ যে কাউকে তারা জিজ্ঞাসাবাদ করবেন।

রোববার বিকেল ৩টায় জেলা সার্কিট হাউজে পুনরায় চতুর্থ দফা সুশীল সমাজ ও গণমাধ্যমকর্মীদের সাক্ষ্য নেয়া হবে বলে তদন্ত কমিটি জানিয়েছে। ওই স্থানে প্রথম দুই দিন গণশুনানি হয়েছিল।