জিয়া দোষী না হলে কেন তদন্তে বাধা দিল: হাসিনা

তদন্তে জিয়াউর রহমানের বাধা দেওয়াই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে তার জড়িত থাকার প্রমাণ বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2017, 04:01 PM
Updated : 16 August 2017, 06:54 PM

১৫ অগাস্ট জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে বুধবার আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সেই সময়ের প্রেক্ষাপট ও নানা ঘটনা তুলে ধরে জিয়াকে দায়ী করেন তিনি।

বাংলাদেশের জাতির জনক হত্যাকাণ্ডের তদন্তে যুক্তরাজ্যে গঠিত অনুসন্ধান কমিশনের সদস্যদের ১৯৮১ সালে জিয়ার শাসনামলে বাংলাদেশে আসতে না দেওয়ার কথা বলেন শেখ হাসিনা।

“আমার প্রশ্ন, জিয়াউর রহমান যদি দোষী না হত, যদি খুনের সাথে জড়িত না থাকত, তাহলে নিশ্চয়ই সে তদন্ত করতে দিত, যদি নির্দোষ হত। কিন্তু সেই ব্রিটিশ এমপিদেরকেই আসতে দিল না বা তদন্ত করতে দিল না।”

বাংলাদেশের জন্মের চার বছরের মাথায় সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের শিকার হন স্বাধীনতার স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান। বিদেশে থাকায় তখন বেঁচে গিয়েছিলেন জাতির জনকের দুই মেয়ে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা।

১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট ট্রাজেডির পর ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে আসেন সেনা কর্মকর্তা জিয়া। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ তাকে প্রথমে সেনা প্রধান করেন। পরে জিয়া নিজেই রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতাগ্রহণকারী মোশতাকের সঙ্গে জিয়ার যোগসাজশের কথা আওয়ামী লীগ নেতারা বলে আসছেন। অন্যদিকে বিএনপি নেতারা বলেন, তখন জিয়া ছিলেন একজন সেনা কর্মকর্তা মাত্র, সামরিক আইন জারিসহ সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন আওয়ামী লীগেরই নেতা মোশতাক।

শেখ হাসিনা বলেন, “অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে খুনিরা এই হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল। এটা একটা বিরাট ষড়যন্ত্র ছিল। দুর্ভাগ্য যে এই ষড়যন্ত্রের সঙ্গে জড়িত খুনি মোশতাক। আর খুনি মোশতাকের দোসর ছিল জিয়াউর রহমান।

“খুনি মোশতাক অবৈধভাবে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘোষণা দেয়, আর জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করে। তার কতটা ঘনিষ্ঠ ছিল যে, তাকেই সেনাপ্রধান হিসেবে সঙ্গে সঙ্গে মোশতাক নিয়োগ দেয়।”

আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা বলেন, একাত্তরে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানিদের পক্ষ নিয়েছিল, বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর তারাই ক্ষমতায় বসেছিল।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পাশাপাশি স্বাধীনতাবিরোধীদের পৃষ্ঠপোষকতার জন্যও জিয়াকে দায়ী করেন তিনি।  

“বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিল জিয়াউর রহমান। অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধ ও সাজাপ্রাপ্তদের মুক্তি দিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসিয়েছিল।”

“বারবার এই পুরস্কারের খেলা আমি দেখেছি। কেউ খুনিদেরকে দিয়ে সংগঠন করেছে। ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন, খুনি হুদা, শাহরিয়ার এদেরকে দিয়ে প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল হিসেবে একটি দল গঠন করে। ওই খুনিদের দিয়ে সে রাজনীতি করা শুরু করে। ইত্তেফাকে বসে এই মইনুল হোসেন খুনিদের দিয়ে রাজনৈতিক সংগঠন করেছিল। জিয়াউর রহমান এদের কাউকে প্রধানমন্ত্রী, কাউকে মন্ত্রী, উপদেষ্টা করেছিল।”

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য সাবেক সেনাশাসক এইচ এম এরশাদের সমালোচনাও করেন শেখ হাসিনা, যাকে এখন নিজের বিশেষ দূতের পদ দিয়েছেন তিনি।

“জেনারেল এরশাদ খুনি রশিদ, ফারুককে দিয়ে ফ্রিডম পার্টি তৈরি করে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী করেছিল। খালেদা জিয়া ১৫ই ফেব্রুয়ারি ভোটারবিহীন নির্বাচন করে খুনি রশিদ, মেজর হুদাকে সংসদ সদস্য করে জাতীয় সংসদে বিরোধীদলের চেয়ারে বসিয়েছিল।”

“কেউ তো একথা বলেন না, যে খুনিরা জাতির পিতাকে হত্যা করেছে, আমার মাকে হত্যা করেছে, ওই শিশুদের হত্যা করেছে, তাদেরকে যারা এভাবে পুরস্কৃত করেছিল তাদের প্রতি কি জাতির ঘৃণা থাকবে না? তাদেরকে কি মানুষ ঘৃণা করবে না? তারাই কি এদেশের রাজনীতির নেতৃত্ব দেবে? তারাই কি ক্ষমতায় যাবে আর তাদেরকে ক্ষমতায় আনার জন্য বারবার চক্রান্ত হবে? কেন?”

জাতির জনককে হত্যার বিচার আটকাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি রাখার কথাও বলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা।   

“আমি তো বিচার চাইতে পারিনি। আমার তো বিচার চাওয়ার অধিকারটাই কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।”

একুশ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার শুরু করে।

শেখ হাসিনা বলেন, “সেই বিচারের রায় যেদিন ঘোষণা হবে সেদিন বিএনপি হরতাল ডেকেছিল যাতে জজ সাহেব কোর্টে যেতে না পারে, রায় ঘোষণা করতে না পারে। প্রশ্ন আমার, কেন বিএনপি সংগঠন হিসেবে ওই দিনটা হরতাল দিল আর রায় ঘোষণায় বাধা দিল; যদি তারা অপরাধী না হবে।”

তখন রায় হলেও মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি ঝুলে যায় ২০০১ সালে ক্ষমতার পালাবদলে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠনের পর। 

শেখ হাসিনা বলেন, “এই খুনিরা যাদের বিচার চলছে তাদেরকেও পুরস্কৃত করে। তারা খুনি ছাড়া কী?”

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাধ্যমে বাংলাদেশকে আবার পাকিস্তানের প্রদেশ বানানোর চেষ্টা করা হয়েছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“অতি সূক্ষ্মভাবে জাতির পিতার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করা, স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করা এবং যারা সেই ২৭ মার্চ পর্যন্ত পাকিস্তানি শাসকের চাকরি করেছে, তাদেরকেই ঘোষক হিসেবে ঘোষণা দেওয়া থেকে শুরু করে যত মিথ্যাচারে এদেশ ভরে গিয়েছিল।”

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণে ‘একক কোনো ব্যক্তির দ্বারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি’ বলে যে মন্তব্য করা হয়েছে, সে বিষয়েও কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

“কেউ বলতে চেষ্টা করেন, একজনের দ্বারা দেশ স্বাধীন হয়নি, একজনের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন হয়নি। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শুধু নেতৃত্ব দেননি। উনি সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন, এই সংগঠন গড়ে তোলার জন্য তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। এই সংগঠন গড়েই বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতার মূলমন্ত্রে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি।

“তিনি যখন স্বাধীনতার ঘোষণা দেন তাকে শুধু গ্রেপ্তার করেই নিয়ে যায়নি, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার বক্তব্যে একজনকেই শুধু দোষারোপ করেছিলেন, সেটা হচ্ছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাহলে যারা একথা বলেন, যে কোনো একক ব্যক্তি দ্বারা দেশ স্বাধীন হয়নি, তারা কি ইয়াহিয়া খানের ভাষণটা পড়েন নাই?”

একইসঙ্গে তিনি বলেন, “হ্যাঁ, এটাও ঠিক এককভাবে তো কেউ করতে পারেন না। সেটা করার জন্য তাকে সংগঠন করতে হয়েছে, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়েছে। জনগণ উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি যে নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই নির্দেশনা মেনেই প্রতিটি পদক্ষেপ নিয়ে এদেশের মানুষ দেশ স্বাধীন করেছে।”

“এখন আমরা শুনি; সব কথার উত্তর দেওয়ার হয়ত সময় হয়নি,” বলেন শেখ হাসিনা।

বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে এই আলোচনা অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ নেতা আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ও আবেদ খানও বক্তব্য রাখেন।