সম্প্রীতির আহ্বানে ঢাকায় বৌদ্ধ যুব উৎসব

সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি আহ্বান এবং ভবিষ্যত মননশীল বাংলাদেশের স্বপ্নে উৎসবে মিলিত হয়েছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী যুবকেরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 July 2017, 06:49 AM
Updated : 28 July 2017, 05:32 PM

রাজধানীর কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগারের শওকত ওসমান মিলনায়তনে শুক্রবার দিনব্যাপী এই মিলনামেলা চলে।

বুড্ডিস্ট ইয়ুথ ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপ বাংলাদেশের এই আয়োজনে ক্যারিয়ার ‍উন্নয়ন ও পেশাদারিত্ব নিয়ে বিভিন্ন কর্মশালা ও সেমিনারে ব্যস্ত সময় পার করেন তারা।

সকালে গণগ্রন্থাগার চত্বরে বেলুন উড়িয়ে দিনব্যাপী উৎসবের উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

চতুর্থবারের এই যুব উৎসবের উদ্বোধন করে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ ১৬ কোটি মানুষের দেশ। এখানে কে কোন ধর্ম অবলম্বন করছে, কোন ধর্ম অনুসরণ করছে সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। এখানে নানা মত, নানা ধর্ম থাকবে; কিন্তু দেশ আমাদের একটাই বাংলাদেশ।”

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “বঙ্গবন্ধু আমাদের দেশ দিয়ে গেছেন। যেখানে ধর্ম-বর্ণের ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য থাকবে না।”

শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হককে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “এই দেশ কোনো হিন্দুর নয়, মুসলিমের নয়, বৌদ্ধের নয়, খ্রিস্টানের নয়। তাহলে এই দেশ কার? এই দেশ তার যে দেশকে ভালোবাসে। অর্থাৎ এই দেশে যে থাকবে… যেন মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে থাকে।”

মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাইরে গিয়ে পাকিস্তানি চিন্তা-চেতনা লালনকারীদের সমালোচনায় উপাচার্য বলেন, “এদেশে এখনো কিছু লোক আছে, যারা পাকিস্তানিরা যে মত ও আদর্শ লালন করত সেটা ধারণ করে। সেটা একইসঙ্গে দুঃখজনক ও বেদনাদায়ক। এদের পেছনে ফেলে সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।”

তরুণদের ঐকতান সৃষ্টির জন্য বুড্ডিস্ট ইয়ুথ ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপকে ধন্যবাদ জানান অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সকালের একটি অধিবেশনে তরুণ ও যুব সমাজের উদ্দেশ্যে বক্তব্য দেন লেখক অধ্যাপক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। তিনি পড়াশোনার মাধ্যমে নেতৃত্বগুণে সমুজ্জ্বল হতে তরুণদের প্রতি আহ্বান জানান।

উৎসবের আহ্বায়ক অরূপ রতন বড়ুয়া বলেন, “নিজেদের বন্ধুত্বের বন্ধন দৃঢ় করা, জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বিনিময়ের লক্ষ্যে আমরা এই সংগঠন গড়ে তুলেছিলাম। একইসঙ্গে নিজেদেরকে আত্মবিশ্বাসী, স্বপ্নবান ও দূরদর্শী করে গড়ে তোলা আমাদের উদ্দেশ্য।”

তিনি বলেন, “আমরা চাই, অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে সমুন্নত রেখে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম বেড়ে উঠুক। তারা মননশীলতা নিয়ে উদ্যমী হয়ে ভবিষ্যত বাংলাদেশের জন্য প্রস্তুত হোক।”

লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেমিনার ও কর্মশালার মাধ্যমে দিনের আয়োজন সাজানো হয়েছে জানিয়ে অরূপ রতন বলেন, “ক্যারিয়ার ও পেশাদারিত্বের কথা মাথায় রেখে আমরা অনুষ্ঠান সাজিয়েছি। যেটা তরুণদের সমৃদ্ধ আগামীর জন্য তৈরি করে তুলবে।”

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে নটর ডেম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার বেঞ্জামিন ডি কস্তা, ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি চিটাগংয়ের উপাচার্য অধ্যাপক প্রভাত চন্দ্র বড়ুয়া, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পালি ও বুড্ডিস্ট স্টাডিজ বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক বিমান চন্দ্র বড়ুয়া, সংসদ সদস্য নাহিম রাজ্জাক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের উপ-দপ্তর সম্পাদক ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া, বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের সদস্য দয়াল কুমার বড়ুয়া উপস্থিত ছিলেন।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে মিলনায়তনে ত্রিপিটক পাঠ ও জাতীয় সংগীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে মূল আয়োজনের সূচনা হয়। সংগঠনের নিজস্ব সংগীত পরিবেশন করা হয় এ সময়। আয়োজনের এই পর্বে সভাপতিত্ব করেন বুড্ডিস্ট ইয়ুথ ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপের চেয়ারম্যান কল্লোল বড়ুয়া।

এরপর লিডারশিপ ওয়ার্কশপ ও যুব আড্ডার পর দুপুরের খাবারের বিরতিতে যান অংশগ্রহণকারীরা। ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা নিয়ে প্যানেল আলোচনার পর বুড্ডিস্ট ইয়ুথ ফ্রেন্ডশিপ গ্রুপের নির্বাচিত ইয়ুথ আইকনরা বক্তৃতা করেন।

ক্যারিয়ার ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রফেশনালিজম নিয়ে ওয়ার্কশপ এবং যুব উদ্যোগ নিয়ে প্যানেল আলোচনাও ছিল বিকেলের আয়োজনে।

সন্ধ্যা ৬টায় সমাপনী অনুষ্ঠানে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয় ভাষা সৈনিক ও শিক্ষাবিদ প্রতিভা মুৎসুদ্দি এবং ছড়াকার সুকুমার বড়ুয়াকে।

সম্মাননার জবাবে সুকুমার বড়ুয়া বলেন, “যে সম্মান আমাকে দিয়েছেন সেজন্য আমি আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি অত্যন্ত সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত।”

‘জাগরণ’ শিরোনামের একটি ছড়া অনুষ্ঠানে পড়ে শোনান একুশে পদক ও বাংলা একাডেমিসহ বিভিন্ন পুরষ্কারপ্রাপ্ত এই লেখক।

তরুণদের উপদেশ দিয়ে প্রতিভা মুৎসুদ্দি বলেন, তোমরা যে যে জায়গায় আছো তারচেয়ে উপরে উঠে যাও। অনেক উপরে উঠে যাও।তরুণদের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও দৃঢ় করে নিজেদের প্রস্তুতি নাও।

“আমি চাই, তোমরা বুদ্ধদেবের অহিংসার মন্ত্রে প্রেম, ভালোবাসা ও বন্ধুত্ব দিয়ে সবার নেতৃত্ব দেবে।”

উৎসবে আজীবন সম্মাননার পাশাপাশি ‘বিশেষ সংবর্ধনা’ দেওয়া হয় শালবন বিহার ও ভিক্ষু প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি শীলভদ্র ভিক্ষু এবং প্রান্তিক ওয়েলফেয়ার ট্রাস্টকে।

তরুণদের মধ্যে বাংলাদেশ বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্টের ভাইস চেয়ারম্যান সুপ্ত ভূষণ বড়ুয়া, মাল্টিপেক্স ওয়েব ডিজাইনের স্বত্ত্বাধিকারী হিরো বড়ুয়া, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুজীব বিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক সুবর্ণা বড়ুয়া এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্সুরেন্স বিভাগের প্রভাষক বিপাশা বড়ুয়াকে দেওয়া হয় ‘যুব সংবর্ধনা’।

সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন রাষ্ট্রপতি কার্যালয়ের সচিব সম্পদ বড়ুয়া; তরুণদের পড়াশোনার মাধ্যমে যোগ্যতম হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে অধ্যাপক অমিত চাকমার দেওয়া বক্তব্য উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “যোগ্যতা, কর্মনিষ্ঠা ও স্বকিয়তা দিয়ে গড়ে তুলতে হবে নিজেদের। প্রথম দুটা হয়তো অর্জন করা সম্ভব, কিন্তু স্বকিয়তা তৈরির জন্য শ্রম দিতে হবে তরুণ বয়স থেকেই।”

বুড্ডিস্ট ইয়ুথ গ্রুপের মহাসচিব মিহির বড়ুয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা, চট্টগ্রাম অঞ্চল, পটুয়াখালী, বরগুনা ও উত্তরাঞ্চল থেকে সাড়ে ৪০০ জন যুব প্রতিনিধি তাদের এই উৎসবে অংশ নেন। যেসব জায়গায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী জনগোষ্ঠী আছে, সব জায়গার প্রতিনিধিত্ব ছিল এখানে।

উৎসবে মিডিয়া পার্টনার হিসাবে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে ছিল এসএ টেলিভিশন ও রেডিও ঢোল।