ভূমি ধসের ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা নিয়ে মহাপরিকল্পনার তাগিদ

বন উজাড়, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ এবং ভূকম্পন বা প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ফাটলের সঙ্গে ভারি বর্ষণ যোগ হওয়াকে বাংলাদেশের পার্বত্য এলাকায় ভূমি ধসের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 June 2017, 06:48 PM
Updated : 13 June 2017, 07:07 PM

প্রাকৃতিক দুর্যোগে এমন ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে এখনই মহাপরিকল্পনা নিতে সরকারকে তাগিদ দিয়েছেন তারা।

কয়েকদিনের টানা বর্ষণে মঙ্গলবার চট্টগ্রাম, রাঙামাটি ও বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকার কয়েকটি স্থানে ধস দেখা দেয়। এতে নিহত হয়েছে শতাধিক, যা ২০০৭ সালের হতাহতকেও ছাড়িয়ে গেছে।

গত কয়েক বছর ধরেই বর্ষায় পাহাড়ি এলাকায় ভূমিধস ঘটছে এবং তাতে প্রাণহানিও হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্ষা মৌসুমকে সামনে রেখে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিত করার পাশাপাশি পাহাড়ের পাদদেশ থেকে লোক সরানো ও তাদের পুনর্বাসন, ফাটলের ঢালে বিশেষ বলয় তৈরি ও পানি সরাতে ক্যানেল নির্মাণের উদ্যোগ নিতে হবে।

দুর্যোগ মোকাবেলায় আগে ব্যাপক সবুজায়ন, পাহাড় কাটা বন্ধ ও দুর্যোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় দক্ষ লোকবল গড়ে তোলার পরামর্শ দেন একজন ভূতাত্তিক ও একজন জিআইএস বিশেষজ্ঞ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার গত এক দশকে ভারি বর্ষণের সময় ভূমি ধসের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, নানা সময়ে ভূকম্পনের কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট এলাকায় পাহাড়ি এলাকায় ছোট ছোট ফাটল রয়েছে। ছোট ছোট ফাটল থাকা মানেই পাহাড়ের উঁচুতে ভূমি ধসের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

“ভারি বর্ষণে এ ফাটলগুলোয় পানির চাপ বেড়ে যায়, অভিকর্ষজ নিম্নমুখী টান এবং পিচ্ছিলতায় দ্রুত ভূমি ধস ঘটছে।”

রাঙমাটির মানিকছড়িতে ধসে মাটি চাপা সড়ক

চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, বান্দরবান ও কক্সবাজারের ভূমিধস প্রবণ এলাকার ’১৫-২০টি’ পয়েন্টে গবেষকদের নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন অধ্যাপক হুমায়ুন।

তিনি বলেন, “রিমোট সেন্সিংয়ের মাধ্যমে আমরা কিছু এলাকা চিহ্নিত করেছি। বেসরকারিভাবে কিছু কাজ হয়েছে, এখন সরকারিভাবে ভূমি ধস এলাকা চিহ্নিত করতে হবে।

“বর্ষার আগে পাহাড়ের পাদদেশ থেকে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি সরাতেই হবে। ভূমি ধসের পর যাতে রাস্তা ব্লক না হয়, সে প্রটেকশন নিশ্চিতে নির্দিষ্ট এলাকায় লোহার নেট দিতে হবে।”

২০০৭ সালের পর প্রতি বছর বর্ষায় ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা থেকে মানুষকে সরিয়ে নিতে পদক্ষেপ নেওয়া হলেও বাসিন্দাদের অনাগ্রহের কারণে তা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বলে মঙ্গলবারই এক সংবাদ সম্মেলনে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া মন্তব্য করেন। 

শুষ্ক মৌসুমে পাহাড়ের ছোট ফাটল এলাকায় সিমেন্ট দিয়ে শিলাখণ্ডের সংযুক্তি মজবুত করার পরামর্শও দেন অধ্যাপক হুমায়ুন।

পাহাড়ে অবাধে বসতি স্থাপন ও গাছপালা কেটে ফেলায় ভূমি ধসের প্রবণতা বেড়েছে, বলেন তিনি।

এই অধ্যাপক বলেন, “পার্বত্য এলাকায় যত্রতত্র রাস্তা বানানো এভয়েড করতে হবে। ইতোমধ্যে যেসব এলাকা দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে তার সুরক্ষা নিশ্চিত করার পাশাপাশি নতুন রাস্তা করার ক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো পরিহার করতে হবে।”

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভূমি ধসে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হয়ে দাঁড়ায় সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়া। এসময় উদ্ধার কাজ করতে গিয়ে নতুন করে বিপদ ডেকে আনে। মঙ্গলবারও পার্বত্য এলাকায় একই ঘটনা ঘটেছে।

চট্টগ্রামের কাপ্তাইয়ে মাটিচাপা পড়া লাশ উদ্ধার

১৯৯৭ সালে জিআইএস পদ্ধতি ব্যবহার করে খাগড়াছড়ি ও কক্সবাজার জেলায় ১৬০টি ভূমিধসপ্রবণ এলাকা চিহ্নিত করা হয়। ১৯৯৮-২০০০ সালে বান্দরবান সদর উপজেলা ও রাঙামাটি শহরে ভূমিধসের উপর বেশি কাজ হয়েছে।

সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিস (সিইজিআইস) এর পরিবশে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক কে বি সাজ্জাদুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পাহাড়ের মাটি এতেই ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে যে ভারি বর্ষণেই ভূমি ধস হচ্ছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই বাংলাদেশেও এ দুর্যোগ থাকবে। তবে কার্যকরি পরিকল্পনা নিতে হবে।

“সরকারকে এখনই উদ্যোগী হতে হবে। বিশেষ করে ভূমি ধস ঠেকাতে মহাপরিকল্পনা নেওয়ার সময় এসেছে। এক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা চিহ্নিতের পাশাপাশি পুনর্বাসনের ব্যবস্থার জন্য প্রকল্প নিতে হবে। ভালনারেবল স্লোপগুলোতে ইঞ্জিনিয়ারিং স্ট্রাকচার নিতে হবে। ব্যয়বহুল হলেও পানি দ্রুত সরে যাওয়ার জন্যে বিশেষ ক্যানেলও নেওয়া যেতে পারে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এ অধ্যাপক মনে করেন, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় জনবসতি করতে না দিলেই জানমালের এ ক্ষয়ক্ষতি শূন্যের কোটায় আনা সম্ভব।

“মানবসৃষ্ট দুর্যোগটি মানুষকেই যথাযথ পরিকল্পনা নিয়েই বাস্তবায়ন করতে হবে। রানা প্লাজা ধস কিংবা ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি মোকাবেলার মতো প্রস্তুতি রাখতে হবে, যা ভূমি ধসের উদ্ধার কাজেও সহায়ক হয়।”

  • পাহাড় ধস: ফিরে দেখা

    • ১৯৬৮ : গাছপালা প্রতিনিয়ত কাটায় বর্ষাকালে কাপ্তাই-চন্দ্রঘোনা সড়কে ভূমি ধস।
    • ১৯৭০: রাউজান-ঘাগরা-রাঙামাটি সড়কে ভূমি ধস ঘটে।
    • ১৯৯০: ৩০ মে’র ভূমি ধসে রাঙামাটি জেলার ঝাগরবিল অঞ্চলে সংযোগ সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
    • ১৯৯৭ : জুলাই মাসে বান্দরবানের ছড়াইপাড়ায় বড় ভূমিধস হয়, মোট ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা প্রায় ৯০,০০০ বর্গ মিটার।
    • ১৯৯৯: ১১ ও ১৩ আগস্ট যথাক্রমে বান্দরবান ও চট্টগ্রামে দুটি বড় ভূমিধসে ১৭ ব্যক্তি নিহত হয়।
    • ২০০৩ : ২৭ জুলাই চট্টগ্রামে ৫.৯ মাত্রার ভূমিকম্পে পাহাড় ধসে কক্সবাজারে ছয়জনের প্রাণহানি ঘটে।
    • ২০০৭: ১১ জুন বর্ষণ আর পাহাড় ধসে বিপর্যয়ের নগরীতে পরিণত হয় চট্টগ্রাম। পাহাড়ি ধস আর কাদা মাটির নিচে পড়ে নগরীর কুসুমবাগ, কাইচ্যাঘোনা, সেনানিবাসের লেডিস ক্লাব সংলগ্ন লেবুবাগান, বায়েজিদ বোস্তামী, মতিঝর্ণা পাড়সহ সাতটি স্থানে প্রাণ যায় ১২৭ জনের।
    • ২০০৮ সালের ১৮ অগাস্ট চট্টগ্রাম নগরীর লালখান বাজার মতিঝর্ণা এলাকায় পাহাড় ধসে মারা যায় চারটি পরিবারের ১২ জন।
    • ২০০৯: ১৮ মে বৃষ্টিজনিত ভূমি ধসে উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা মৌলভীবাজারে ছয়জনের প্রাণহানি ঘটে।
    • ২০১০: ১৫ জুন ভূমিধস এবং বন্যায় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কমপক্ষে ৫৩ জনের প্রাণহানি ঘটে।
    • ২০১১: ১ জুলাই টাইগার পাস এলাকার বাটালি হিলের ঢালে পাহাড় ও প্রতিরক্ষা দেয়াল ধসে মারা যায় একই পরিবারের পাঁচজনসহ ১৭ জন।
    • ২০১২: ২৬-২৭ জুনে টানা বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল, ধস ও বজ্রপাতে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান ও সিলেটে ৯৪ জনের প্রাণহানি হয়।
    • ২০১৫: ২৬-২৭ জুন কক্সবাজারে টানা ভারি বর্ষণ, ধস আর পাহাড়ি ঢলে ১৯ জনের প্রাণহানি হয়।

ভারি বর্ষণে সতর্কতা

আবহাওয়াবিদরা জানান, বর্ষা এলেই ভারী বর্ষণ ও ভূমি ধসের বিষয়ে আগাম সতর্কবাতা দেওয়া হয়। এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে হবে।

আবহাওয়াবিদ এ কে এম রুহুল কুদ্দুস বলেন, দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু (বর্ষা) বাংলাদেশের উপর সক্রিয় রয়েছে। মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে মাঝারী অবস্থায় বিরাজ করছে। এসময় অতি ভারি বৃষ্টির কারণে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।

ভোলা ও তৎসংলগ্ন এলাকায় অবস্থানরত স্থল নিম্নচাপের প্রভাবে মঙ্গলবার সকাল ৯ টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘন্টায় খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।

সোমবার বাংলাদেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে রাঙামাটিতে ৩৪৩ মিলিমিটার। এসময় রাজধানীতে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়েছে ১৩৯ মিলিমিটার।