অল্প জায়গায় ঠাসাঠাসি করে থাকার ফলে স্বাস্থ্য ঝুঁকির পাশাপাশি প্রাণীটির প্রজনন ক্ষমতাও কমে যেতে পারে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের।
শুধু থাকার জায়গার আয়তনই নয়, এ প্রাণীটির খাঁচাটিও জরাজীর্ণ। এতে যে কোনো সময় খাঁচা থেকে জলহস্তি বেরিয়ে বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষেরই।
শুধু জলহস্তিই নয়; কুমির, হরিণ ও ময়ূরসহ অন্য বেশ কিছু প্রাণির খাঁচা বা ঘর ধারণ ক্ষমতার দুই-তিন গুণ বেশি প্রাণির ভার বইছে।
কুমিরের চারটি ঘেরে আটটি থাকার জায়গা থাকলেও আছে ২৬টি। ১৫০টি ধারণ ক্ষমতার হরিণের খাঁচায় থাকতে হচ্ছে ২১২টিকে। ১০০টি ধারণ ক্ষমতার ময়ূরের খাঁচায় আছে তিন গুণ, প্রায় ৩০০টি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের বৃহত্তম চিড়িয়াখানাটি ঘুরে যাওয়া আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন চিড়িয়াখানা বিশেষজ্ঞ সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানার নকশাকার বানার্ড হ্যারিসন এখানে ৮০ প্রজাতির মোট দেড় হাজারের মতো প্রাণী রাখার পরামর্শ দিয়েছেন।
তবে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় এখানে দুই হাজারের মতো প্রাণী ‘সুন্দরভাবে’ থাকতে পারে বলে দাবি করেন কিউরেটর নজরুল।
তিন দশক আগে প্রথমে দুই জোড়া জলহস্তি আনা হয় ঢাকা চিড়িয়াখানায়। প্রজননের মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি হয়েছে এদের। স্থান সংকুলান না হওয়ায় এর আগে বঙ্গবন্ধু সাফারি পার্ক ও দুবাই চিড়িয়াখানাসহ বিভিন্ন জায়গায় উপহার হিসেবে সেসব জলহস্তি পাঠানো হয়। তারপরও গত এক বছরে জন্ম নিয়েছে আরও চারটি জলহস্তি শাবক।
জলাধার ও খাঁচার সংখ্যা বাড়ানো এবং পুরোনো খাঁচা সংস্কারসহ আরও বেশ কিছু উন্নয়ন কাজের জন্য গত বছরের জুনে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরে প্রায় ২৫ কোটি টাকার একটি প্রকল্প প্রস্তাব পাঠান কিউরেটর। সেখান থেকে প্রস্তাবটি যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে।
তবে প্রকল্পটি অনুমোদন না হওয়ায় এর অগ্রগতি জানতে গত ১১ মে কিউরেটর আরেকটি চিঠি পাঠান মন্ত্রণালয়ে। সমস্যার জটিলতা অনুধাবন করে প্রকল্পটি অনুমোদনে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয় চিঠিতে।
চিঠিটির বিষয়ে জানতে চাইলে কিউরেটর এস.এম নজরুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সমস্যা সমাধানের আশা করছেন তিনি।
“জায়গা একটু কম হয়ে গেছে। এ কারণে তাদের রক্ষনাবেক্ষণ করা কঠিন হয়ে পড়েছে। বিষয়টি জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। আশা করছি কাজ হয়ে যাবে।”
এদিকে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ রেজা খান ঢাকা চিড়িয়াখানার বর্তমান অবস্থার জন্য ‘ব্যবস্থাপনাগত পরিকল্পনার অভাবকে’ দায়ী করে বলেছেন, বিশ্বের কোনো চিড়িয়াখানায় ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত প্রাণী রাখা হয় না।
“কোনো চিড়িয়াখানায় ১০ হাজার প্রাণী থাকতে পারে। কিন্তু ১০ হাজার এক নম্বর প্রাণীটার যদি জন্ম হয়, তাহলে কী করব? অথবা ওই প্রাণীটার জন্মই হবে না চিড়িয়াখানায়। সেটা একটা পদ্ধতিগত ব্যবস্থা, যেটা সব চিড়িয়াখানায় থাকে।কিন্তু ঢাকাতে নাই।”
অল্প জায়গায় গাদাগাদি করে থাকার কারণে ঢাকা চিড়িয়াখানার জলহস্তিগুলো প্রজননসহ নানা সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন চিড়িয়াখানাটির সাবেক কিউরেটর এ বি এম শহীদুল্লাহ।
“কোনো জলহস্তির প্রজননের সময় তার জন্য আলাদা জায়গা প্রয়োজন হয়। এছাড়া একটি নতুন বাচ্চা জন্মের পর তার জন্য একটু বাড়তি জায়গা প্রয়োজন হয়।
“কিন্তু এখানে তা নেই। এছাড়া কনজাস্টেড থাকলে এদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যেতে পারে। রোগবালাইও হতে পারে।”
জলহস্তির সংখ্যা আরও বাড়লে এই প্রাণিদের ‘স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে’ পড়ার কথাও বলছেন শহীদুল্লাহ।
এ পরিস্থিতিতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ঢাকা চিড়িয়াখানাকে নিয়ে একটি ‘মাস্টারপ্ল্যানের’ কথা উল্লেখ করে বলেছেন, চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষের পাঠানো প্রস্তাবটি নিয়ে আপাতত করার কিছু নেই।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “চিড়িয়াখানা নিয়ে আমাদের এখানে (মন্ত্রণালয়ে) একটা মাস্টারপ্ল্যানের কাজ চলছে।এটা এখনো কমপ্লিট হয়নি।
“সেটা শেষ না হলে, স্পেশালভাবে কিছু করার সুযোগ নেই।”
আরও বিস্তারিত জানতে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন তিনি।
ঢাকা চিড়িয়াখানা ‘ভালো অবস্থায়’ নেই বলে জানান মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব মাকসুদুল হাসান খান।
তিনি বলেন, ঢাকা চিড়িয়াখানা আধুনিকায়নে একটি মেগাপ্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে।
“অনেকগুলো প্রস্তাব জমা পড়েছে। কারিগরি মূল্যায়ন কমিটি এগুলো যাচাই-বাছাই করবে। এসব শেষ করে ওয়ার্কঅর্ডার দেওয়ার পর কাজ শেষ হতে তিন বছর লাগবে।”
‘মেগাপ্রকল্পের’ কাজ শেষ হওয়ার আগে কিছু কিছু প্রাণী রংপুর চিড়িয়াখানায় পাঠিয়ে দেওয়ার কথা জানান সচিব।
“রংপুর চিড়িয়াখানায় প্রাণির সংখ্যা কম। কিছু প্রাণী সেখানে পাঠিয়ে দেব বলে ঠিক করেছি।
“চিড়িয়াখানার সমস্যাগুলো দ্রুত সমাধান করতে পারলে অস্থায়ী সমাধানে যাব না। আর যদি দেরি হয়, তাহলে ছোট প্রকল্পের কথা চিন্তা করব।”