উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এই শাস্ত্রীয় সংগীতের পঞ্চম আসর বৃহস্পতিবার উদ্বোধন করে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, “শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতি যেসব তরুণের মধ্যে আগ্রহ দানা বাঁধে, তারা কখনও অসুন্দর আর হিংস্র হতে পারে না।”
বছরজুড়ে জঙ্গি তৎপরতা এবং হলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার পর এই উৎসব নিয়ে যে আয়োজকদের দোলাচল ছিল, তা উঠে আসে সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের কথায়।
“এ উৎসবটি নিয়ে আশা-নিরাশার দোলাচলে ছিলাম আমরা। সেই অনিশ্চয়তা কাটিয়ে এবারের উৎসব শুরু হল। এটাই বড় আনন্দের সংবাদ।”
জঙ্গিবাদ প্রতিরোধের আহ্বান জানিয়ে সংস্কৃতিকর্মী নূর বলেন, “আমাদের সন্তানদের মাঝে বুনে দিতে হবে আমাদের সংস্কৃতির বীজ।”
হলি আর্টিজানে নিহতদের স্মরণে তারিক সুজাতের লেখা একটি কবিতা ‘জন্মের আগেই আমি মৃত্যুকে করেছি আলিঙ্গন’ আবৃত্তি করে শোনান তিনি।
রাত ৯টায় রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে এই উদ্বোধন অনুষ্ঠানে ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, “সংস্কৃতি দেশে দেশে জনগণের সেতুবন্ধন রচনা করে। এ উৎসবটি তেমনিভাবে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণকে এক মঞ্চে নিয়ে এসেছে।”
উৎসবের সহ আয়োজক স্কয়ার গ্রুপের পরিচালক তপন চৌধুরী, ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সেলিম আর এফ হোসেনও অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।
তাদের বক্তব্যের আগে শর্মিলা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তার দল নৃত্যনন্দনের মণিপুরি আর কত্থক নৃত্য পরিবেশনায় শুরু হয় মূল অনুষ্ঠান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাস্ত্রীয় নৃত্যশৈলী দর্শনের নানা আঙ্গিক উঠে আসে নৃত্যনন্দনের এই প্রযোজনায়।
এরপর বাঁশির সুরে বিশ্ব মাতিয়ে বেড়ানো প্রবীণ গোদখিণ্ডি, ‘ইনসিঙ্ক শো’র স্রষ্টা ভারতের মিউজিশিয়ানস ফেডারেশনসের সভাপতি রাতিশ তাগড়ের বেহালার সঙ্গে রামদাস পাল সুরভের তবলা তৈরি করে আরেক আবহ। তাদের পরিবেশনায় ছিল ‘রাগ মারুবিহাগ’ ও‘হংসধ্বনি’।
উদ্বোধন পর্বের পর মঞ্চে আসেন সেনিয়া ও বেনারস ঘরানার কণ্ঠশিল্পী বিদূষী গিরিজা দেবী। ‘পদ্মশ্রী’ আর ‘পদ্মবিভূষণ’ খেতাবপ্রাপ্ত শিল্পী ‘যোগকোষ’ রাগের খেয়াল দিয়ে শুরু করেন। পরে তিনি পরিবেশন করেন মিশ্র খাম্বাজে ঠুমরী, রাগ কাফিতে টপ্পা ও রাগ মিশ্র গৌরীতে দাদরা।
তার আগে তিনি দর্শকদের উদ্দেশে বলেন, “বয়স হয়ে গেছে, গাইতে সমস্যা হয়। আজ আপনাদের জন্য এখানে এসেছি। যতটুকু পারি ততটুকু গাইব। যতদিন চলাফেরা করতে পারব, চেষ্টা করব ঢাকায় আসতে।”
তারপর মঞ্চে আসেন উপমহাদেশের কিংবদন্তী উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পী আলাউদ্দিন খাঁর দৌহিত্র আশিষ খান। সরোদে রাগ দরবারি কানাড়ায় আলাপ ‘জোড় ঝালা’ বাজিয়ে শোনান তিনি। এরপর রাগ চন্দ্রনন্দন ও মিশ্র ভৈরবী পরিবেশন করেন। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত বিক্রম ঘোষ, সরোদে ছিলেন সিরাজ আলী খান।
প্রথম দিনের আয়োজনে এরপর খেয়াল যুগলবন্দি ‘জাসরাঙ্গি’ পরিবেশন করেন বিদুষী অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর। অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে রাগ ললিত ও পণ্ডিত সঞ্জীব অভয়ংকর পুরিয়া ধানেশ্রী পরিবেশন করেন একই সঙ্গে। এরপর রাগ দুর্গা পরিবেশন করেন অশ্বিনী ভিদে দেশপাণ্ডে এবং সঞ্জীব অভয়ংকর পরিবেশন করেন রাগ ভূপালি।
রাতের শেষ প্রহরে বেহালা পরিবেশন করেন ড. এল সুব্রহ্ম্যণন। শুরুতেই তিনি রাগ ‘আদি তালম’ এ ‘কৃতি’ বাজিয়ে শোনান। তার সঙ্গে তবলায় সঙ্গত করেন পণ্ডিত তন্ময় বোস। এরপর তিনি ‘আদি তালাম’এ ‘মোহানাম’ এবং ‘ছন্দপ্রিয়া’ পরিবেশন করেন। ‘ছন্দপ্রিয়া’ ড. এল সুব্রহ্ম্যণনের নিজস্ব সৃষ্টি।
রাতভর চলা এই আসরে এসেছিলেন পানিসম্পদ মন্ত্রী আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। শিল্পীদের হাতে সম্মাননা তুলে দেওয়ার পাশাপাশি তারা ঘুরে দেখেন উৎসব অঙ্গন।
উৎসব নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া
উৎসবে গান শুনতে এসে টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসির হেড অফ এইচআর অ্যান্ড অ্যাডমিন ইয়াসমিন জাহানারা আয়োজক নানা অব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন তুলেন।
“ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে নানা বিধি-নিষেধ ছিল। ব্যাগের মাপ কেমন হবে, তা ভালোভাবে নোটিফাই করা উচিৎ ছিল আমাদের। ব্যাগ নিয়ে ঢুকতে সমস্যা হয়েছে।”
অনলাইনে নিবন্ধন ঘোষণা ছাড়া বন্ধ করে দেওয়ায় বেঙ্গল ফাউন্ডেশনের সমালোচনাও করেন তিনি।
“নিয়মাবলীতে লেখা ছিল গাড়ি পার্কিংয়ের কোনো ব্যবস্থাই নেই। কিন্তু এখানে এসে দেখলাম বেশকটি গাড়ি পার্ক করা হয়েছে। আয়োজকদের পক্ষপাতিত্ব সত্যি মেনে নেওয়া যায় না।”
তবে নিরাপত্তার কড়াকড়িতে বেশ সন্তুষ্ট হয়েছেন অনেক শ্রোতা-দর্শক। একটি বেসরকারি কলেজের প্রভাষক শায়লা পারভিন, মহাখালী থেকে আসা প্রযুক্তিবিদ সুদীপ্ত দাশদের কণ্ঠে ছিল প্রশস্তি। আয়োজনের সার্বিক দিক নিয়েও তারা সন্তুষ্টির কথা জানালেন।
তবে শায়লা পারভিন বলেন, “বাংলাদেশের উচ্চাঙ্গসংগীত শিল্পীদের আরও বেশি সুযোগ দেওয়া উচিৎ ছিল এবারের উৎসবে।”
উৎসবে দেশি শ্রোতাদের পাশাপাশি বিদেশিও দেখা গেছে, তাদের একজন জার্মানির গবেষক লরিনা।
উৎসবকে ‘আন্তর্জাতিক মানের’ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমি ক্ল্যাসিকাল খুব বুঝি না। এখানে কারা গাইছেন, তাদেরও চিনি না। তবে সত্যি খুব ভালো লাগছে। আমি মনোযোগ দিয়ে শুনছি। এ সত্যি অন্যরকম এক উৎসব।”
বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন
উদ্বোধনী পর্বে স্মরণ করা হয় সদ্যপ্রয়াত কর্ণাটকির ঘরানার ওস্তাদ কিংবদন্তি বালমুরালি কৃষ্ণ ও বেনারস ঘরানার ওস্তাদ আলী আাহমেদ হোসেন খানকে। তাদের প্রয়াণে শোকার্ত আয়োজকরা এক ‘বিশেষ প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শন’ করেন।
সানাইবাদক আলী আহমেদ হোসেন খানের পারফরম্যান্সে শুরু হয়েছিল উচ্চাঙ্গসংগীত উৎসবের প্রথম আসরটি (২০১২ সালে)। এবারের উৎসবের দুদিন আগে ২২ নভেম্বর মারা যান বালমুরালি কৃষ্ণ।
আয়োজকরা বলেন, কথা দিয়েও তাই আসা হয়নি তার এই উৎসবে।
এ বছর উৎসবটি উৎসর্গ করা হয়েছে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) স্মৃতির উদ্দেশে।
দ্বিতীয় দিনের আসর
শুক্রবার দ্বিতীয় দিনের আসর শুরু হবে বিদূষী মাধবী মুডগাল ও আরুশি মুডগালের পরিবেশনায়। তারপর বেঙ্গল পরম্পরা সংগীতালয়ের শিক্ষার্থীদের তবলার ধুন পরিবেশনার পরে খেয়াল পরিবেশন করবেন বাংলাদেশের কণ্ঠশিল্পী প্রিয়াঙ্কা গোপ। সেদিন থাকছে রাহুল শর্মার সন্তুর পরিবেশনা। সেতার পরিবেশনা করবেন পূর্বায়ণ চট্টোপাধ্যায়, খেয়াল পরিবেশনায় থাকবেন পণ্ডিত উল্লাস কশলকার।
ভোররাতে পরিবেশিত হবে পণ্ডিত রনু মজুমদারের বাঁশি, ইউ রাজেশের ম্যান্ডোলিন, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যাশয়ের তবলার ধুন।
বেঙ্গল উচ্চাঙ্গ সংগীত উৎসব শেষ হবে ২৮ নভেম্বর। পণ্ডিত হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়ার বাঁশির ধুনে শেষ হবে উৎসবের আনুষ্ঠানিকতা।