জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় ঋণ নয়, অনুদানের দাবি

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের ‘ইনোসেন্ট ভিক্টিম’ মন্তব‌্য করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি হাছান মাহমুদ বলেছেন, এই খাতে ঋণ নয়, বাংলাদেশের অনুদান পাওয়া উচিৎ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Oct 2016, 03:00 PM
Updated : 27 Oct 2016, 07:30 PM

জলবায়ু তহবিলের ‘বাণিজ্যিকীকরণ’ ঠেকানোর ওপরও জোর দিয়েছেন সাবেক এই পরিবেশ ও বন মন্ত্রী। 

বৃহস্পতিবার রাজধানীতে একটি সেমিনারে এবং পরে সংসদীয় কমিটির বৈঠক শেষে দুই দফা তিনি এ বিষয়ে সাংবাদিকদের সামনে কথা বলেন।

২০১২ সালে মেক্সিকোয় জি-২০ বৈঠকে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর অর্থে একটি তহবিল গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২০২০ সালের মধ্যে প্রতি বছর ১০০ বিলিয়ন ডলার করে অর্থ দিয়ে এই তহবিল গঠনের অঙ্গীকার করেছিল উন্নত দেশগুলো।

কিন্তু ওই অর্থের বেশির ভাগটাই ছাড় না হওয়ায় চলতি মাসের শুরুতে ওয়াশিংটন ডিসিতে বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্টের সভাপতিত্বে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে ক্ষোভ প্রকাশ করেন অর্থমন্ত্রী মুহিত।

এরপর সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম বাংলাদেশ সফরে এসে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার ঘোষণা দেন।

কিন্তু পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন বলে আসছে, বাংলাদেশসহ স্বল্পোন্নত দেশগুলো যেহেতু জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলায় অনুদানের দাবি জানিয়ে আসছে, সেখানে বিশ্ব ব‌্যাংকের ওই ঋণ নেওয়া উচিৎ হবে না।

আগামী ৭ থেকে ১৮ নভেম্বর মরক্কোর মারাকাশে ২২তম বৈশ্বিক জলবায়ু সম্মেলন বসতে যাচ্ছে। এবারের সম্মেলনে ২০২০ সাল পরবর্তী প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের কর্ম কাঠামো প্রণয়ন হওয়ার কথা। প্যারিস চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী দেশ হওয়ায় বাংলাদেশ ওই চুক্তি বাস্তবায়নে বাধ্য। 

মারাকাশ সম্মেলন সামনে রেখে বৃহস্পতিবার ঢাকায় কয়েকটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ও পরিবেশবাদী সংগঠন আয়োজিত সেমিনারে অংশ নিয়ে হাছান মাহমুদ বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন চুক্তি সম্পন্ন করে তা দিয়ে কেউ যদি ব্যবসা করতে চায় সেটা ঠেকানো উচিত।

“জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিশ্ব ব্যাংক প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশকে দুই বিলিয়ন ডলার ঋণ সহায়তার প্রস্তাব দিয়ে গেছে। তাদের এমন প্রস্তাবকে আমরা ভালোভাবে দেখছি। কিন্তু এই অর্থ ঋণ হিসাবে নয় বরং অনুদান হিসাবে দিতে হবে। কারণ বাংলাদেশ বিনা দোষে ক্লাইমেট চেইঞ্জের ভিক্টিম। উন্নয়নের জন্য ঋণ নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু জলবায়ু ইস‌্যুতে কোনো ঋণ নয়।”

বেসরকারি সংস্থা ইক্যুইটিবিডি আয়োজিত ‘বিপদাপন্ন জনগোষ্ঠীর পক্ষে নাগরিক সমাজের প্রস্তাবনা’ শীর্ষক ওই অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা), বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম, বাংলাদেশ ইন্ডেজিনাস পিপলস অন ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড বায়োডাইভারসিটি, ক্লাইমেট চেইঞ্জ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফোরামসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

আগের জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের চেষ্টার কথা তুলে ধরে হাছান মাহমুদ সেমিনারে বলেন, কোপেনহেগেনের আলোচনায় একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর চেষ্টা হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রসহ ১২টি দেশের সরকারপ্রধান সেখানে আলোচনায় অংশ নিয়েছিলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন।

“ইতোপূর্বে ‘ক্লাইমেট চেইঞ্জ মাইগ্রেন্টদের’ নিয়ে আলোচনা হলেও তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মাইগ্রেন্টদের বিষয়টি যাতে বিধির মধ্যে নিয়ে আসা যায় সেই চেষ্টা করতে হবে। কারণ চুক্তি হওয়ার পর সে অনুযায়ী কিছু বিধিও প্রণয়ন করা হবে।”

বন ও পরিবেশ মন্ত্রী আনোয়ার হোসেন মঞ্জু সেমিনারে বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সমস্যার বিষয়ে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা সব থেকে বেশি। তবে এই সমস্যাকে কোনো উন্নয়নের সমস্যা হিসাবে না দেখে বৈশ্বিক সমস্যা হিসাবে দেখতে হবে।

“আমরা যার যার অবস্থান থেকে কথা বলব। সরকার তার অবস্থান থেকে কথা বলবে, সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা তাদের অবস্থান থেকে কথা বলবেন, এনজিওগুলো তাদের অভিজ্ঞতা ও উপলব্ধির আলোকে কথা বলবে। কিন্তু সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সবাই কথা বলতে গিয়ে যাতে বিশৃঙ্খলা না হয়। সবাইকে একটা ঐক‌মত্যের দিকে নিয়ে যেতে হবে। আমরা সবার সাথে মত বিনিময় করব।”

পরে বিকেলে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়।

বৈঠক শেষে হাছান মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, “জলবায়ু তহবিলের বাণিজ্যিকীকরণের একটা বিষয় সামনে চলে আসছে। বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ এর মত বৈশ্বিক অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান তহবিলে টাকা ছাড়ের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে। এইচএসবিসি ব্যাংকও নাকি এই অর্থ ছাড় করবে।

“আমরা শুরু থেকে বলে আসছি, এ খাতে ঋণ নয়, অনুদান দিতে হবে। সম্প্রতি বিশ্ব ব্যাংকও দুই বিলিয়ন ডলার দেবে বলেছে। কিন্তু এটা যুক্তিযুক্ত নয়। এই তহবিলের টাকা জনগণের। এটা লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠানের হাতে যাওয়া ঠিক নয়। মরক্কোতে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষে বিষয়টি নিয়ে কথা বলার জন্য সংসদীয় কমিটি সুপারিশ করেছে।”

মারাকাশ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘জলবায়ু উদ্বাস্তু’ প্রসঙ্গেও জোরালো আলোচনার জন্য বলেছে সংসদীয় কমিটি।

হাছান মাহমুদ জানান, আসন্ন সম্মেলনে ‘কার্বন পিকিং ইয়ার’ (একটি নির্দিষ্ট সাল, যে পর্যন্ত একটি দেশের কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ বাড়তে পারবে) ২০৪১ সালের পরে করার প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়েও কমিটিতে আলোচনা হয়েছে।

“উন্নত দেশগুলো যেভাবে কার্বন নিঃসরণ করে উন্নয়নশীল ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো সেভাবে করে না। এজন্য অন্যান্য দেশের সঙ্গে আলোচনা করে পিকিং ইয়ার ২০৪১ এর পরে করার প্রস্তাব দেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। কারণ বাংলাদেশ বা অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশ আর উন্নত দেশগুলোর পিকিং ইয়ার এক হতে পারে না।”

হাছান মাহমুদের সভাপতিত্বে কমিটির সদস্য পরিবেশ ও বন উপমন্ত্রী আবদুল্লাহ আল ইসলাম জ্যাকব, নবী নেওয়াজ, গোলাম রাব্বানী, টিপু সুলতান, ইয়াসিন আলী ও মেরিনা রহমান বৈঠকে অংশ নেন।