বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের কর্মময় রাজনৈতিক জীবনের নানা ইতিবৃত্ত ফুটে উঠেছে ২৩২টি আলোকচিত্রে।
বঙ্গতাজের ৯১তম জন্মদিনে এসব আলোকচিত্র নিয়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে গ্যালারি টোয়েন্টি ওয়ানে আয়োজন করা হয়েছে মাসব্যাপী আলোকচিত্র প্রদর্শনী।
শনিবার শ্রাবণের বৃষ্টিসিক্ত বিকালে এই প্রদর্শনীর উদ্বোধন করেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদ।
ইতিহাস আশ্রয়ী আলোকচিত্রগুলোয় মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা থেকে শুরু করে ছেষট্টির ছয় দফার অন্যতম রূপকার কিংবা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীনকে দেখা যায় উদ্দীপ্ত ভূমিকায়।
তাজউদ্দীন সম্পর্কে তার রাজনৈতিক সহচর তোফায়েল আহমদ বলেন, “আদর্শবাদী এই নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর একনিষ্ঠ অনুসারী, ছিলেন জাতির জনকের যোগ্য ও বিশ্বস্ত সহচর।
“বঙ্গবন্ধুর ভাবাদর্শ ও চিন্তা-চেতনাকে যথার্থভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাস তিনি জাতিকে যেভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তা ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবে।”
কোনো ষড়যন্ত্রই মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত বাংলাদেশের অগ্রগতি ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না মন্তব্য করে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, “বর্তমানে দেশের অগ্রগতিকে যারা বাধাগ্রস্ত করছে চায়, তাদের দূরভিসন্ধি কখনোই পূরণ হবে না।”
স্মৃতিচারণ করে আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “বঙ্গবন্ধু ২৩ বছর যে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন, সেটারই চূড়ান্ত বাস্তবায়ন করেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ।”
রণাঙ্গনে মুক্তিযুদ্ধের নানা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তাজউদ্দীন আহমেদের বিচক্ষণতা ও দুরদর্শিতার গল্প শুনিয়েছেন তারা। বলেছেন, ব্যক্তি জীবনে সরল, রাজনৈতিক জীবনে নির্মোহ এক নেতার কথা।
প্রদর্শনীর আলোকচিত্রগুলোতে উঠে এসেছে মুজিবনগর সরকার ও মহান মুক্তিযুদ্ধের নানা দুর্লভ মুহূর্ত। প্রতিটি ছবিই যেন বলে যায় ইতিহাসের এক মহান নাবিক ও তাঁর সময়ের যোদ্ধাদের কথা। নতুন করে চোখের সামনে হাজির হয় পুরনো দিনের সংগ্রামের ইতিহাস।
একটি ফ্রেমে দেখা যায়, একাত্তরের ৬ ডিসেম্বর ভারতের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি মেলার পর দেশটির দেশটির সংবাদমাধ্যম আকাশবাণীর এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের।
সাক্ষাৎকারের একপর্যায়ে পাকবাহিনীর হাতে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথা স্মরণ করে গড়িয়ে পড়ছে তাজউদ্দীনের চোখের জল।
একাত্তরের নভেম্বর মাসে ধারণ করা আরেক ছবিতে এই বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রীকে দেখা যায় ভারতের কৃষ্ণনগরের মিলিটারি ফিল্ড হাসপাতালে। একাত্তরের রণাঙ্গনে আহত ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজের শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছিলেন তিনি।
ক্যামেরার আলো-ছায়ায় দৃশ্যমান হয়েছে একাত্তরে পাকবাহিনীর হাতে বঙ্গবন্ধু গ্রেপ্তার হওয়ার পর মুক্তিযুদ্ধের কাণ্ডারি হয়ে ওঠা মহান এই জননেতার কর্মতৎপরতা।
ছবিগুলোই যেন বলে দিচ্ছে- দেশপ্রেম, সততা ও মেধার মেলবন্ধনে বাঙালির স্বপ্নের রাষ্ট্র বাংলাদেশকে পাকিন্তানের কাছ থেকে কেমন করে ছিনিয়ে নেন মহান এই জননায়ক।
সহজেই দর্শনার্থীরা ফিরে যান অতীতের আয়নায়। নতুন প্রজন্মের কাছে বইয়ের পাতার বাইরে দৃশ্যমান হয় বাঙালির অহংকার মুক্তিযুদ্ধ, সত্তরের সাধারণ নির্বাচন কিংবা ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের দৃশ্যকল্প।
অসংখ্য ছবির মধ্যে আছে একাত্তরে শত্রুমুক্ত হওয়া যশোরের মুক্তাঞ্চলে তাজউদ্দীন আহমদের দীপ্ত ভঙ্গিতে বক্তৃতার দৃশ্য। আছে জননেতার রণাঙ্গন পরিদর্শনের ছবি। নেতা বুড়িমারী সীমান্তে আহত এক মুক্তিযোদ্ধার শারীরিক অবস্থার খোঁজ নিচ্ছেন, ঠাঁই পেয়েছে এমন মমতাময় আলোকচিত্র।
একাত্তরের এপ্রিলে কুষ্টিয়ার মেহেরপুরে গঠিত মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সংগ্রামী জনতার মাঝে দাঁড়িয়ে সরকারের রূপরেখা ঘোষণা করছেন। আরেক ছবিতে সত্তরের নির্বাচনে বিজয়ের পর সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখছেন এই অবিসংবাদিত নেতা।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্তির পর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ফ্রেমবন্দি হয়েছেন তার ঘনিষ্ঠ সহযাত্রী তাজউদ্দীন। আছে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময় এক জনসভায় উদ্দীপ্ত ভঙ্গিতে তাজউদ্দীনের বক্তৃতা দেওয়ার দৃশ্য।
১৯৬৬ সালে মুক্তিযুদ্ধের আগে পরিবারের সঙ্গে ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন জননেতা। তার কোলে স্নেহের বন্ধনে আশ্রয় নিয়েছে ছেলে সোহেল তাজ। পাশে রয়েছেন সহধর্মিণী জোহরা তাজউদ্দীন। সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন মেয়ে রিমি, রিপি ও মিমি।
পাশের ছবিতেই বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরে দুই নেতার আনন্দের অশ্রুজলে হৃদয়স্পর্শী ভালোবাসার প্রকাশ। আছে স্বাধীন দেশে প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতির জনকের সঙ্গে তাজউদ্দীনের একান্ত আলাপচারিতার দৃশ্য।
গ্যালারির এক কোনায় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতার লাশের ছবি। ৩ নভেম্বর মৃত্যু, ধানমণ্ডির তাজ-লিলিতে লাশ আনা হল ৫ নভেম্বর। নেতার নিথর ছবির পাশে লেখা ‘সূর্য্য অস্তমিত হল। অস্তমিত হল মানবতার পথের দিশারী এক আলোকবর্তিকার।’
প্রদর্শনীতে ঠাঁই পেয়েছে রশিদ তালুকদার, আফতাব আহমেদ, মঞ্জুরুল আলম বেগ, গোলাম মাওলা, জহিরুল হক, পাভেল রহমানসহ দেশ-বিদেশের আলোকচিত্রীদের ফ্রেমবন্দি অনবদ্য সব ছবি। এছাড়াও পারিবারিক অ্যালবাম ও তৎকালীন পত্রিকায় প্রকাশিত সংগৃহীত ছবিও রয়েছে প্রদর্শনীতে।
মাসব্যাপী এ প্রদর্শনী প্রতিদিন বেলা ১২টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকবে।