২ পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু স্প্লিন্টারে: চিকিৎসক

গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের ঠেকাতে গিয়ে দুই পুলিশ কর্মকর্তার মৃত্যু স্প্লিন্টারের আঘাতে হয়েছে বলে জানিয়েছেন ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক।

নিজস্ব প্রতিবেদকও গোপালগঞ্জ প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 July 2016, 02:43 PM
Updated : 31 July 2016, 06:48 PM

কূটনৈতিকপাড়ার ওই ক্যাফেতে শুক্রবার রাতে একদল অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হানা দিয়ে বিদেশিসহ অন্তত ৩০ জনকে জিম্মি করার পর তাদের উদ্ধারে জঙ্গিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কয়েকদফা গোলাগুলি ও সংঘর্ষে ওই দুই পুলিশ কর্মকর্তা মারা যান।

নিহত ঢাকা মহানগর ডিবি পুলিশের সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম ও বনানী থানার ওসি সালাউদ্দিনের লাশের ময়নাতদন্ত হয় শনিবার বিকালে, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সোহেল মাহমুদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডকটমকে তিনি বলেন, “দুজনই স্প্লিন্টারের আঘাতে মারা গেছেন।

“সালাউদ্দিনের গলায় একটি জখম ছিল, স্প্লিন্টারের আঘাতের কারণে তার মৃত্যু হয়। আর রবিউলের শরীরের বিভিন্নস্থানে স্প্লিন্টারের জখমের চিহ্ন ছিল। তবে বুকে স্প্লিন্টারের আঘাতটি ফুসফুস পর্যন্ত পৌঁছে।”

এর আগে রাত পৌনে ৯টার দিকে জিম্মি সঙ্কট শুরুর পর থেকে রাত ১১টার মধ্যে জঙ্গিদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে অন্তত পাঁচ পুলিশ সদস্যের আহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়, এদের মধ্যে মারা যান এসি রবিউল ও ওসি সালাউদ্দিন।

গুলশান ২ নম্বরের ৭৯ নম্বর সড়কে হলি আর্টিজান বেকারিতে সন্ত্রাসী হামলার আধা ঘণ্টার মধ্যে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন এই দুই পুলিশ কর্মকর্তা।

এসি রবিউলের আহত হওয়ার খবর পেয়ে রাতেই সাভার থেকে ঘটনাস্থলে ছুটে এসেছিলেন তার শ্বশুর (মাঝের জন)

সংঘর্ষে আহত হওয়ার পর তাদের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে গেলে রাত সাড়ে ১১টার দিকে ওসি সালাউদ্দিনকে কর্তব্যরত চিকিৎসকরা মৃত ঘোষণা করেন। এরপর রাত সোয়া ১টার দিকে একই হাসপাতালে রবিউলের মৃত্যুর কথা জানান গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার শেখ নাজমুল আলম।

এরপর দুই পুলিশ কর্মকর্তার লাশ ইউনাইটেড হাসপাতালেই ছিল। পরে শনিবার সকালে কমান্ডো অভিযানে রক্তাক্ত জিম্মি সঙ্কটের অবসানের পর দুপুরে সেখান থেকে তাদের লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

অস্ত্রধারীরা অভিযানের আগেই গভীর রাতে বিদেশিসহ ২০ জিম্মিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করে বলে শনিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে জানায় আইএসপিআর। কমান্ডো অভিযানে ছয় বন্দুকধারীর মৃত্যু ও একজনের আটকের খবরও দেয় তারা।

বাবাকে দেখবে না রবিউলের সন্তান

জন্মে পৃথিবীর আলো দেখলেও কোনোদিনই বাবার মুখ দেখা হবে না গুলশানের জিম্মি সঙ্কটে বন্দুকধারীদের হামলায় নিহত ডিবির এসি রবিউল ইসলামের দ্বিতীয় সন্তানের।

জঙ্গিদের স্প্লিন্টারে আহত হওয়ার পর আহত অবস্থায় এসি রবিউলকে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে

মাসখানেক আগে গোয়েন্দা পুলিশে বদলি হয়ে আসা রবিউলের সাত বছর বয়সী একটি ছেলে রয়েছে। তার স্ত্রী সন্তানসম্ভবা বলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে।

রবিউলের একমাত্র ভাই শামসুজ্জামান শামসের বন্ধু অভি হাসান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রাত ১১টার দিকে পরিবারের সদস্যরা রবিউলের খবর পান। এ সময় শামস সাভারে ছিলেন। সেখান থেকে ইউনাইটেড হাসপাতালের পথে রওনা দেন।

“খবর শুনে রবিউলের সন্তান সম্ভবা স্ত্রী এখন পাগলপারা।”

রবিউলের বাড়ি মানিকগঞ্জের নয়াডিঙির কাটিগ্রামে।

লাশ রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে নেওয়ার পর সেখান থেকে মানিকগঞ্জে নিয়ে গ্রামের কবরস্থানে তাকে দাফন করা হবে বলে জানান অভি।

এমন মৃত্যু মানতে পারছেন না স্বজনরা

এদিকে গুলশানের ক্যাফেতে সন্ত্রাসী হামলায় নিহত বনানী থানার ওসি মো. সালাউদ্দিনের মৃত্যুতে মুষড়ে পড়েছেন স্বজন আর বন্ধু-পরিজনরা।

সাহসী, ন্যায়পরায়ণ আর সদালাপী একজন পুলিশ কর্মকর্তার এমন আচমকা মৃত্যু মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে তাদের। 

সালাউদ্দিনের মৃত্যুর খবরে রাত থেকেই তার এলাকা গোপালগঞ্জ শহরের ব্যাংকপাড়ায় তার বাড়িতে জড়ো হতে থাকেন স্বজন, বন্ধু আর পাড়াপ্রতিবেশীরা। শোকের সঙ্গে তারা ক্ষোভও জানিয়েছেন এমন হামলায়।

ওসি সালাউদ্দিন

গোপালগঞ্জ এসএম মডেল সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের জনপ্রিয় শিক্ষক মরহুম আবদুল মান্নান খানের সাত ছেলে, তিন মেয়ের মধ্যে সালাউদ্দিন ছিলেন পঞ্চম।

বাবার স্কুল থেকেই ১৯৮৪ সালে এসএসসি আর ১৯৮৬ সালে ঢাকা কলেজ থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে এইচএসসি পাসের পর সালাউদ্দিন ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা বিভাগে। সেখান থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষে ১৯৯০ সালে যোগ দেন পুলিশ বাহিনীতে।

চাকরি জীবনে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সঙ্গে কাজ করায় পেয়েছেন জাতিসংঘ শান্তি পুরস্কার।

ব্যক্তিগত জীবনে স্ত্রী রোমকিম এবং এক মেয়ে ও এক ছেলেকে নিয়ে ছিল তার সংসার।

সালাউদ্দিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু প্রবাল বলেন, “সালাউদ্দিন মানুষ হিসেবে খুবই ভালো ছিল। মানুষ বিপদে পড়লেই সে সাহায্য করত। সে মিরপুর থানায় থাকার সময় সবার সহযোগিতায় পাঁচতলা একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছে।

“কোনো পুলিশ সদস্য অসুস্থ হলে বা অসহায় হয়ে পড়লে তাদের সহযোগিতা করেছে। নিরপরাধ মানুষকে রক্ষা করতে গিয়েই সে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমি এ ঘটনার বিচার চাই।”

ব্যাংকপাড়া হাবিবুর রহমান মুকুল, থানাপাড়ার বাসিন্দা মহাসীন শেখও সালাউদ্দিনের অবদানের কথা স্মরণ করেন।

শোকে স্তব্ধ সালাহউদ্দিনের ছোট ভাই মোহাম্মদ আলী এ হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করে বলেন, “দোষীদের অবশ্যই শাস্তি দিতে হবে। এ ঘটনার পিছনে কারা আছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে।

“আমার ভাই অত্যন্ত সাহসী, পর-উপকারী, ন্যায় ও কর্তব্যপরায়ণ পুলিশ অফিসার ছিল। এছাড়া সে ভালো মানুষের কাছে ছিল ফেরেস্তা। আর ক্রিমিনালরা তাকে যমের মতো ভয় পেতো।”

পুলিশ কর্মকর্তা সালাউদ্দিনের লাশ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকার বনানীতে দাফন করা হবে বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে পরিবারের পক্ষ থেকে জানিয়েছেন তার ভাই রাজি উদ্দিন খান আইজিনার।

তিনি বলেন, “সালাহউদ্দিনের লাশ আমরা গোপালগঞ্জে এনে দাফন করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তার লাশ দাফনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ কারণে সালাহউদ্দিনের মরদেহ ঢাকার বনানীতে সমাহিত করা হবে।”