প্রজাপতি প্রজাতি মহাবিপদে

প্রজাপতি ফুলের মধু আহরণে ঘোরে গাছে গাছে। বন কিংবা ঝোঁপ-ঝাড়ের গাছপালায় ঘুরলেও ডিম পাড়ে নির্দিষ্ট একটি গাছে। আর পাশের খাল-বিলে ছুটে যায় পানি পান করতে।

মঈনুল হক চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2016, 05:13 AM
Updated : 1 July 2016, 06:38 AM

কিন্তু নিজ বাসস্থান উপড়ে ফেললে কিংবা খাল-নদীর ভরাট হয়ে গেলে অথবা পানি দূষণ হলে প্রজাপতির রঙিন ডানা ওড়ে না সেখানে।

এই সমস্যায় পড়েছে স্থানীয়ভাবে ‘সুন্দরবনের কাক’ নামে পরিচিত প্রজাপতিটির (বৈজ্ঞানিক নাম- Euploea crameri nicevillei)। যেটা ‘হালনাগাদ লাল তালিকায়’ অতি বিপন্নের তালিকায় রয়েছে।

বিপন্নের তালিকায় রয়েছে সোনালি পাখার ‘কনকচাপা’ (বৈজ্ঞানিক নাম- Troides aeacus), সাদা বাঘ নামে পরিচিত ডোরা কাটা ‘সুষমা’ (বৈজ্ঞানিক নাম-  Danaus melanippus), রঙিন গোলাপ নামে পরিচিত ‘আলসিন্দুরা’ (বৈজ্ঞানিক নাম- Pachliopta hector) এবং কমনবার্ড নামে পরিচিত ‘সোনাল’ (বৈজ্ঞানিক নাম- Troides helena)।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যার অধ্যাপক মনোয়ার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দেশের প্রাণিকূলের সর্বশেষ হালনাগাদ লাল তালিকা বিলুপ্তির হুমকির তালিকায় ১৮৮টি প্রজাপতিতে চিহ্নিত করেছি আমরা। এর মধ্যে একটি মহাবিপন্ন, ১১২টি বিপন্ন ও ৭৫টি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে।”

তার মতে, প্রাণীকূলের আবাস ধ্বংস ও নগরনায়নের ফলে বন উজাড় হচ্ছে এবং পরিবেশ দূষণ যে ব্যাপক হারে বেড়েছে তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে প্রজাপতির বিপন্নতা।

২০০০ সালে দেশে প্রথমবারের মতো পাঁচ ক্যাটাগরির প্রাণিকূলের ওপর ‘লাল তালিকা’ করে আন্তর্জাতিক পরিবেশ সংরক্ষণ সংগঠন আইইউসিএন বাংলাদেশ।

এবার সাত ক্যাটাগরিরও পর্যালোচনা চালায় সংস্থাটি। প্রথমবারের মতো এবার যুক্ত হয়েছে প্রজাপতি প্রজাতি। এ প্রজাতির কার্যক্রমের প্রধান ছিলেন অধ্যাপক মনোয়ার।

প্রজাপতির জীবনচক্র তুলে ধরে তিনি বলেন, “প্রজাপতি প্রজাতিটি যে ঝুঁকিতে রয়েছে তাতে দেশের পরিবেশের বর্তমান চিত্র সহজেই ফুটে উঠে। স্তন্যপায়ী, পাখি, সরীসৃপ, উভচর, স্বাদু পানির মাছ ও চিংড়ির যে সংখ্যক প্রজাতি সঙ্কটাপন্ন, তার সমান সংখ্যক প্রজাপতি প্রজাতি হুমকিতে। পানি দূষণ ও পরিবেশ ধ্বংসের ব্যাপকতা এতে সহজেই অনুমেয়।”

বন, ঝোঁপ-ঝাড় উজাড় বন্ধ এবং দূষণ রোধে কার্যকর ব্যবস্থা না নিলেও আগামী কয়েক দশকে বিলুপ্তির তালিকায় প্রবেশ করবে রঙিন প্রজাতির অনেক প্রজাপতি।

“সুন্দরবন, লাউয়াছড়া ও ঢাকার বংশী নদী সংলগ্ন এলাকায় গবেষণাকালে প্রজাতির বাসস্থান, পরাগায়ন, ফুলের মধু আহরণ, লার্ভা সংগ্রহ, পানি সংগ্রহ ও ডিম পাড়ার গাছ কমে যাওয়ায় বৈরী পরিবেশের সুনির্দিষ্ট চিত্র আমরা পেয়েছি। এখন লাল তালিকা ধরে হুমকির কারণ চিহ্নিত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার সময় এসেছে,” বলেন এ অধ্যাপক।

শুধু প্রজাপতি প্রজাতি নয়, অন্য সব প্রাণিকূলকে বিলুপ্তির ঝুঁকি থেকে বাঁচাতে যথাযথ পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের বিষয়ে যত দ্রুত সম্ভব উদ্যোগ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

>>বিলুপ্ত প্রজাতি: স্তন্যপায়ী ১১, পাখি ১৯, সরীসৃপ ১। মোট ৩১টি প্রজাতি।

বিপদে পাখিরাও

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক দেশের পাখি প্রজাতির সর্বশেষ হালনাগাদ লাল তালিকা তৈরিতে প্রধান ভূমিকা রাখেন।

তিনি জানান, গত ১০০ বছরে যে ৩১টি প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে, তার মধ্যে পাখি সবচেয়ে বেশি ১৯ প্রজাতি। তবে এখন ১০টি পাখি প্রজাতি মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে।

বিলুপ্ত ১১ প্রজাতির পাখিগুলো হচ্ছে- দেশি  সারস, লালগলা বাতাই, দেশি ময়ূর, সবুজ  ময়ূর, মেটে তিতির, বাদা  তিতির, বাদি হাঁস, গোলাপি হাঁস, বাংলা ডাহর, পাতি  ডাহর, বড় মদনটাক (হাড়গিলা), ধলাপেট বক, চিতিঠুটি গগনবেড়, রাজ শকুন, লালমুখ দাগিডানা, কালাবুক টিয়াঠুটি, তিলাবুক টিয়াঠুটি, বড় লালমাথা টিয়াঠুটি, দাগিলেজ গাছআচড়া।

“বর্তমানে বাংলা শকুন, চামচু ঠুঁঠো বতন, কালাপেট পাঁচিল, দেশি গাঙচষা প্রজাতির পাখি মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে বাংলা শকুন রক্ষায় কাজ শুরু হয়েছে। আশা করি, এখন বন্যপ্রাণী রক্ষায় সব মহল সচেতন হবে,” বলেন ইনাম আল হক।

স্তন্যপায়ী প্রজাতির বিষয়ে অধ্যাপক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, স্তন্যপায়ী ১১ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে গত শতকেই। তবে গত ১৫ বছরে মন্থর ভাল্লুকের বিলোপ ঘটেছে। এখন বিলুপ্তির হুমকিতে মহাবিপন্নের তালিকায় রয়েছে বাঘ, হাতি, ভোঁদড়সহ ১৭ প্রজাতি।

সরীসৃপের মধ্যে অতি পরিচিত হলুদ পাহাড়ি কচ্ছপ, উভচরে পরিচিত চামড়াঝোলা ব্যাঙ ও লাউয়াছড়া চিকিলা; স্বাদু পানির মাছ প্রজাতিতে মহাশোল ও বাঘাইর মহাবিপন্নের তালিকায়।

 

বিলুপ্তির হুমকিতে যারা

আইইউসিএন এর আবাসিক প্রতিনিধি ইশতিয়াক উদ্দিন আহমেদ জানান, প্রাণিকূল রক্ষায় নীতিগত সিদ্ধান্তের আমুল পরিবর্তন আনতে হবে।বিভিন্ন প্রজাতির আবাসস্থল রক্ষা ও অন্যান্য ব্যবহারের প্রতিও অনকূল পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে।

“আজকের পর থেকে আমরা আশা করবো-যথাযথ উদ্যোগের মাধ্যমে আগামীতে আর কোনো প্রজাতিই বিলুপ্ত হবে না।”

>>অতি বিপন্ন: স্তন্যপায়ী ১৭, পাখি ১০, সরীসৃপ ১৭, উভচর ২, মাছ ৯ ও প্রজাপতি ১। মোট ৫৬টি প্রজাতি।

>>বিপন্ন: স্তন্যপায়ী ১২, পাখি ১২, সরীসৃপ ১০, উভচর ৩, মাছ ৩০, চিংড়ি ২, প্রজাপতি ১১২। মোট ১৮১টি প্রজাপতি।

>>ঝুঁকিপূর্ণ: স্তন্যপায়ী ৯, পাখি ১৭, সরীসৃপ ১১, উভচর ৫, মাছ ২৫, চিংড়ি ১১ ও প্রজাপতিক ৭৫। মোট ১৫৩ প্রজাতি।

বুধবার দেশের প্রাণিকূলের ‘হালনাগাদ প্রজাতির লাল তালিকা’ ২০১৫ প্রকাশ হয়।

বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে আইইউসিএন এ লাল তালিকার হালনাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।