নিষ্পাপ মানুষ মারা ‘মহানবীর ঐতিহ্যের লঙ্ঘন’

ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর উপর গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হাই কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়েছে, যাতে নিষ্পাপ মানুষ হত্যা ‘মহানবী (সা.) এর ঐতিহ্যের লঙ্ঘন’ বলে বিচারকদের পর্যবেক্ষণ এসেছে।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2016, 02:18 PM
Updated : 28 April 2016, 02:18 PM

ওই ঘটনায় হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানসহ তিন আসামির মৃত্যুদণ্ড ও দুজনের যাবজ্জীবন দণ্ড বহাল রেখে হাই কোর্টের রায় আসে।

প্রায় এক যুগ আগে সিলেটে তৎকালীন হাই কমিশনার বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে গত ১১ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি আমির হোসেনের বেঞ্চ রায় ঘোষণা করেছিল।

বৃহস্পতিবার ১৬৭ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ এই রায় প্রকাশ পায়, যার একটি অনুলিপি হাতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ওই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে নিয়োজিত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শেখ এ কে এম মনিরুজ্জামান কবীর।

পাঁচ আসামিদের মধ্যে মুফতি হান্নান, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনকে মৃত্যুদণ্ড এবং হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি এবং মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল সিলেটের একটি আদালত।

আট বছর পর আসামিদের আপিল খারিজ করে হাই কোর্ট বিচারিক আদালতের রায়ই বহাল রাখে।

দণ্ডিত পাঁচ আসামির সবাই বর্তমানে কারাগারে রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গি তৎপরতা  ও বোমা-গ্রেনেড হামলার আরও মামলাও বিচারাধীন।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রায়ে আসামিদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও হত্যার অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। আসামিরা আপিল না করলে তাদের মৃতুদণ্ড কার্যকরে আইনগত কোনো বাধা নেই।”

পূর্ণাঙ্গ রায় হওয়ায় এখন থেকে ৩০ দিনের মধ্যে আসামিদের আপিল করতে হবে বলে জানান তিনি।

মুফতি হান্ননসহ চার আসামির আইনজীবী মোহাম্মদ আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখনও অনুলিপি হাতে পাইনি। রায়ের অনুলিপি পেলে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করব।”

রায়ের পর্যবেক্ষণের প্রসঙ্গ মনিরুজ্জামান কবীর বলেন, “একজন যদি ষড়যন্ত্র করেন, অন্য একজন যদি তা শোনেন, তাহলে সে ষড়যন্ত্রকারীর অংশীদার হিসেবে গণ্য হবে। এটা সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে বলেও মত দিয়েছে আদালত।”

জঙ্গি হামলার এই মামলার রায়ে কুরআনের একাধিক সুরার আয়াত (সুরা আল মায়দা এবং সুরা আল নিসা) ও হাদিস উদ্ধৃত করা হয়েছে।

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, “ইসলাম কেবল হত্যা অসমর্থনই করে না, এটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে রায়ে এসেছে। অপরাধমুলক কাজ, বোমা ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে ষড়যন্ত্র ও নিষ্পাপ মানুষ হত্যা করে অভিযুক্তরা কোরআনের নিষেধাজ্ঞা ও নবীর ঐতিহ্য লঙ্ঘন করেছে বলে রায়ে বলা হয়েছে।”

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে ২০০৪ সালের ২১ মে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী গ্রেনেড হামলার মুখে পড়েন।

বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলে পুলিশের সহকারী উপপরিদর্শক কামাল উদ্দিন নিহত হন। পুলিশ কনস্টেবেল রুবেল আহমেদ ও হাবিল মিয়া নামের আরেক ব্যক্তি মারা যান হাসপাতালে।

আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ অন্তত ৪০ জন  ওই ঘটনায় আহত হন।

পুলিশ ওই দিনই সিলেট কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০০৭ সালের ৭ জুন মুফতি আব্দুল হান্নান ওরফে আবুল কালাম,  হান্নানের ভাই মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান ওরফে মফিজ ওরফে অভি, শরীফ শাহেদুল আলম ওরফে বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন ওরফে রিপনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়।

যথাযথ ঠিকানা না থাকায় মুফতি মঈন উদ্দিন ওরফে আবু জান্দাল ওরফে মাসুম বিল্লাহ ওরফে খাজার নাম প্রথমে বাদ দেওয়া হলেও পরে তাকে যুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ। ওই বছর নভেম্বরে হয় অভিযোগ গঠন।

৫৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষে ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক সামীম মো. আফজাল তিনজনকে মৃত্যুদণ্ড ও দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।

নিম্ন আদালতের রায়ের পর ২০০৮ সালে আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মুত্যুদণ্ড অনুমোদনের আবেদন) হাই কোর্টে শুনানির জন্য আসে। ২০০৯ সালে আসামিরা আপিল করেন।

চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি হাই কোর্টে শুনানি শুরু হয়। নয় দিন শুনানির পর ৩ ফেব্রুয়ারি আদালত ১১ ফেব্রুয়ারি রায়ের দিন ঠিক করে দেয়। রায় ঘোষণার আড়াই মাসের মাথায় বৃহস্পতিবার পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেল।