বায়োমেট্রিক: আঙুলের ছাপ না মেলায় হয়রানি

কল করতে গেলেই ভেসে আসছে ৩০ এপ্রিলের মধ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধনের অনুরোধ, অন্যত্থায় রয়েছে সিম বন্ধের হুমকি, সেই সময় শেষ হতে বাকি আর মাত্র তিন দিন; কিন্তু পুনঃনিবন্ধনে গিয়ে আঙুলের ছাপ না মেলায় ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছেন অনেকে।

মঈনুল হক চৌধুরীও উত্তম সেন গুপ্তবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 April 2016, 06:36 AM
Updated : 27 April 2016, 06:21 PM

এ পরিস্থিতিতে করণীয় কী, তা নিয়ে স্পষ্ট ধারণা না পেয়ে বিড়ম্বনায় পড়ার কথা জানিয়েছেন মোবাইল ফোন গ্রাহকরা।

কক্সবাজারের বাসিন্দা মিনহাজ উদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গ্রামীণফোন আর এয়ারটেলের দুটো সিম আমার। পুনঃনিবন্ধন করতে ছবি আর এনআইডি নিয়ে অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারে গিয়ে পড়ি বিপাকে। তারা জানায় আমার আঙুলের ছাপ এনআইডির সঙ্গে মিলছে না।”

সরকারি এ চাকুরে এখন থাকেন কর্মস্থল যশোরে। আঙুলের ছাপ নিয়ে জটিলতা নিরসনে সেখানকার উপজেলা নির্বাচন অফিসে গিয়েও সমাধান পাননি তিনি।

“তারা আঙুলের ছাপ হালনাগাদ করতে অস্বীকৃতি জানায়; বলেছে যশোর সদর উপজেলার বাইরের কোনো ভোটারের আঙুলের ছাপ নেওয়া সম্ভব হবে না।”

যেখান থেকে ভোটার হয়েছিলেন সেখানে যেতে মিনহাজকে পরামর্শ দেন কর্মকর্তারা।

“এখন এটা সম্ভব? বাকি আর কয়েকটা দিন। সেখানে গেলেও কী ভোগান্তি হয় কে জানে!” বলেন তিনি।

একই ধরনের বিপত্তিতে পড়েছেন চট্টগ্রামের গৃহিণী সেলিনা আক্তার। গত শনিবার বহদ্দারহাটে রবি সেবা কেন্দ্রে গিয়ে দেখেন এনআইডির সঙ্গে তার আঙুলের ছাপ মিলছে না।

এ অবস্থায় করণীয় কী, তা জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পাননি তিনি। হতাশ হয়ে সিম পুনঃনিবন্ধনের জন্য বিকল্প পথ খুঁজছেন এই গৃহবধূ।

“মোবাইল কোম্পানিগুলো নির্ধারিত সময়ে নিবন্ধনের কথা বলছে। অথচ ঝামেলায় পড়লে কী করব, সে বিষয়ে কোনো পরামর্শও দিচ্ছে না। এখন অন্যের নামে নিবন্ধন করব, না কি জন্মনিবন্ধন কাগজ দিয়ে কাজ সেরে ফেলব বুঝছি না,” ক্ষোভের সঙ্গে বলেন সেলিনা।

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মৃদুল কান্তি চৌধুরীর সমস্যা কিছুটা ভিন্ন।

“বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলের চামড়া উঠে যাওয়ায় বায়োমেট্রিকের যন্ত্র আঙুলের ছাপই পেল না। বাধ্য হয়ে তাই স্ত্রীর নামেই সিম নিবন্ধন করি,” বলেন তিনি।

চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দেবাশীষ দেব রয়েছেন কর্মস্থল ঢাকায়। তারও আঙুলের ছাপ না মেলায় সিম পুনঃনিবন্ধন আটকে রয়েছে।

“সমস্যা কাদের, তাই তো বুঝতে পারছি না। জাতীয় পরিচয়পত্রে দেওয়া আঙুলের ছাপ কী করে বদলে গেল? এখন ওই ছাপ হালনাগাদ করতে হবে, তারপর পুনঃনিবন্ধন। ৩০ এপ্রিলের মধ্যে সব কাজ শেষ করতে পারব কি না, দুশ্চিন্তায় আছি,” বলেন তিনি।

আগামী শনিবারের মধ্যে বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে সিম ও রিম পুনঃনিবন্ধনের সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। অনিবন্ধিত সিমগুলো প্রথমে কয়েক ঘণ্টা এবং পরে একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হবে বলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম বলে আসছেন।

বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া ১৩ কোটি ১০ লাখ সিম ও রিমের মধ্যে আট কোটি বর্তমানে সক্রিয় আছে বলে ছয় মোবাইল অপারেটরের হিসাব।

বায়োমেট্রিক পুনঃনিবন্ধন কাজে সংশ্লিষ্ট বিটিআরসির এক কর্মকর্তা জানান, গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৬ কোটি ৩৫ লাখেরও বেশি সিমের পুনঃনিবন্ধন হয়েছে।এর বাইরে ৬২ লাখেরও বেশি গ্রাহকের আঙুলের ছাপ জাতীয় পরিচয়পত্রের সঙ্গে না মেলায় আটকে আছেন তারা।

এছাড়া জাতীয় পরিচয়পত্রের হালনাগাদে তথ্য সংগ্রহ এবং ১৫ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের অনেকের তথ্য নিলেও তাদের এখনও জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়নি নির্বাচন কমিশন; এদের সিমগুলো কীভাবে পুনঃনিবন্ধিত হবে তারও কূলকিনারা করতে পারছে না অপারেটররা।

“ভোটার হয়েছি অথচ এনআইডি নেই। শেষ সময়ে এসে বুঝে উঠতে পারছি না কোথায় গিয়ে এনআইডি নম্বর নেব, কখন নিবন্ধনের কাজ সারব,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক মোবাইল ব্যবহারকারী।

“এখন আশা, যদি পুনঃনিবন্ধনের মেয়াদ বাড়ায়”; এনআইডি ছাড়া জন্মনিবন্ধন, পাসপোর্ট ও ড্রাইভিং লাইসেন্স দেখিয়ে সিম পুনঃনিবন্ধন করার বিষয়টি জানা নেই তার।

গত ১৬ ডিসেম্বর বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু হওয়ার পর আঙুলের ছাপ না দিয়ে নতুন সিম কেনা যাচ্ছে না। পাশাপাশি চলছে পুরনো সিমের পুনঃনিবন্ধন।

বায়োমেট্রিক ভেরিফিকেশন বিষয়ে মোবাইল ফোন অপারেটরদের চিঠি দিয়ে জাতীয় পরিচয়পত্রের ‘অপরিহার্যতার’ কথা জানায় বিটিআরসি।

চিঠিতে কোনো গ্রাহক জাতীয় পরিচয়পত্র দেখাতে না পারলে পাসপোর্ট/ড্রাইভিং লাইসেন্স/জন্ম নিবন্ধন সনদের বিপরীতে ৬ মাসের সংযোগ দেওয়ারও নির্দেশনা দেওয়া হয়।

তবে মোবাইল অপারেটরদের কয়েকজন এজেন্ট জানিয়েছেন, এনআইডি ছাড়া অন্য পরিচয়পত্র নিচ্ছেন না তারা।

“এনআইডি ছাড়া অন্য কোনো কাগজে আমরা নিবন্ধন করাচ্ছি না। আমাদের কাছে দেওয়া বায়োমেট্রিক মেশিনে এনআইডির তথ্য নেওয়া ছাড়া কোনো অপশন রাখা হয়নি,” বলেন এক এজেন্ট।

এনআইডি না থাকায় প্রতিদিন অনেককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে বলেও জানান তিনি।

“বেঁধে সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ভিড় সামলাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। তার উপর অনেকেরই আঙুলের ছাপ মিলছে না, কারও কারও আবার জাতীয় পরিচয়পত্র নেই। এদের কী বলব, সে সংক্রান্ত নির্দেশনাও আমরা পাইনি।”

আঙুলের ছাপ নিয়ে নাগরিকদের এ দুর্ভোগের কথা স্বীকার করেছে নির্বাচন কমিশনও। ‘সংকট নিরসনে’ ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে তারা।

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সুলতানুজ্জামান মো. সালেহউদ্দিন বুধবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গতকাল পর্যন্ত আট থেকে নয় কোটি সিমের পুনঃনিবন্ধন হয়েছে বলে আমরা জেনেছি।”

আঙুলের ছাপ না মেলায় অনেকে পুনঃনিবন্ধন করতে পারছেন না জানিয়ে তিনি বলেন, এ সংখ্যা অর্ধ কোটির বেশি হতে পারে বলে তার ধারণা। তবে প্রথম দফায় না মিললেও পরে অনেকের আঙুলের ছাপ মিলে যাওয়ায় তারা নিবন্ধন করতে পেরেছেন।

তাই আঙুলের ছাপ না মেলায় ঠিক কতো সংখ্যক গ্রাহক সিম পুনঃনিবন্ধনে ব্যর্থ হয়েছেন সে হিসাব বিটিআরসি দিতে পারবে বলে জানান তিনি।

এ পরিস্থিতিতে গ্রাহক হয়রানি এড়াতে এনআইডির আঙুলের ছাপ হালনাগাদের কাজ শুরু হয়েছে জানিয়ে মহাপরিচালক সুলতানুজ্জামান বলেন, নির্বাচন কমিশনের যে কোনো উপজেলা অফিসে গিয়ে আঙুলের ছাপ হালনাগাদ করা যাবে।

“কেউ এ সেবা দিতে ব্যর্থ হলে এনআইডির কেন্দ্রীয় হেল্প সেন্টারে ১৬১০৩ নম্বরে ফোন করে অভিযোগ করতে হবে। তাহলে আমরা ব্যবস্থা নেব।”

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (অপারেশন্স) সৈয়দ মুহাম্মদ মূসা বলেন, সিম পুনঃনিবন্ধনের কাজ শুরুর পর থেকেই আঙ্গুলের ছাপ হালনাগাদের সুযোগ দেওয়া হয়।

“এমনকি এক এলাকার ভোটার যেন অন্য এলাকার নির্বাচন অফিসে আঙ্গুলের ছাপ দিতে পারে সে নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয়ভাবে আগারগাঁওয়ে এ সেবা দেওয়া হচ্ছে।”

তবে নির্বাচন সংশ্লিষ্ট অনেক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ফেব্রুয়ারি থেকে দেশজুড়ে ইউপি নির্বাচন শুরু হওয়ায় সংশ্লিষ্ট এলাকাগুলোতে এ সংক্রান্ত সেবা বন্ধ ছিল।

“ওই সময় ভোটার তালিকা হালনাগাদের সুযোগ রাখা হয় না। তাই পুনঃনিবন্ধনে আগ্রহীদের আঙ্গুলের ছাপ হালনাগাদ করা যায়নি,” বলেন এক কর্মকর্তা।

তবে শেষ সময়ে এসে এখন আঙ্গুলের ছাপ হালনাগাদের সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি যাদের এখন পর্যন্ত জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়নি, তাদের কাছে তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলেও জানান তারা। 

“এখনও যারা এনআইডি হাতে পাননি তাদের স্থানীয়ভাবে (এনআইডির) নম্বর সরবরাহ করা হচ্ছে। আঙ্গুলের ছাপও হালনাগাদ করা হচ্ছে। আমরা সব ধরনের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করে যাচ্ছি,” বলেন নোয়াখালীর জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মনির হোসেন।