পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার দলিল আলমডাঙ্গা গণহত্যা

হাসিবুল হক
Published : 15 Dec 2020, 08:00 PM
Updated : 15 Dec 2020, 08:00 PM

একাত্তরের মধ্য এপ্রিল। ১৪-১৭ তারিখের যে কোন একদিন পাকিস্তানি আর্মি থানা শহর আলমডাঙ্গা দখল করলো। সম্ভবত ১৪ তারিখে আলমডাঙ্গার পতন ঘটলো। সেনা লরির আওয়াজ আর ভারী বুটের শব্দে এই অঞ্চলের সবখানে আতঙ্ক। জনশূন্য হয়ে গেল ছোট্ট শহর।

একাত্তরে আলমডাঙ্গায়  মুক্তিসংগ্রাম ও গণহত্যার সেই সব দিনগুলো স্মৃতি থেকে তুলে এনে বলছিলেন বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব শিক্ষানুরাগী ড.আবদুল হামিদ। 

এর আগে ৩০ মার্চ তাজউদ্দিন আহমদ চুয়াডাঙ্গায় এসে পৌঁছে গেছেন; বিকালে সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে গেছেন সাথে  ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। ৩ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা শহরে বিমান হামলা করলো ওরা। থমথমে পরিবেশ সবখানে। ঢাকায় খান সেনারা গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ চুয়াডাঙ্গার অবাঙালি মহকুমা প্রশাসক মোহম্মদ ইকবালকে আটক করার পর সে নিহত হলো।

বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার পর ৩০ ও ৩১ মার্চ কুস্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতা দক্ষিণ-পশ্চিম রণাঙ্গণের প্রধান উপদেষ্টা ডা.আসহাব-উল হক হেবা, উপপ্রধান দুই উপদেষ্টা আলমডাঙ্গার ব্যারিস্টার বাদল রশীদ ও চুয়াডাঙ্গার ইউনুস আলী এ্যাডভোকেইট এর নেতৃত্বে গঠন করা হাজার হাজার আনসার,মুজাহিদ ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী নিয়ে এই রণাঙ্গণের অধিনায়ক মেজর আবু ওসমান চৌধুরী,সহ-অধিনায়ক ক্যাপ্টেন আযম চৌধুরী হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলো। বাদল ব্যারিস্টার অবশ্য ২৭ মার্চ ভারতে রওনা হয়ে গেছেন দেশের পক্ষে প্রচার চালাতে।

আলমডাঙ্গা থানা আনসার বাহিনীর আলমডাঙ্গা সার্কেলের দায়িত্বে ছিল সহকারি অ্যাডজুট্যান্ট আবুল কাশেম।এই প্রতিরোধ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেকে নিহত হলো। অনেকে যার যার মতো পালানোর চেষ্টা করে ধরা পড়ে গ্রামের মানুষের হাতে বর্শা বল্লমের খোঁচায় মারা পড়লো। একেক দল একেক জায়গায় নিহত হলো। কেউ গাড়াগঞ্জ, আবদালপুর, ঝাউদিয়া, কালিদাসপুরে মারা পড়ে। পয়লা এপ্রিলে আতাউল্লাহ নামের অল্প বয়সী এক পাঠান অফিসারকে ধরে চুয়াডাঙ্গায় আনলো। মুক্তিবাহিনীর পক্ষে অনেকে আহত হলো, শহীদ হয়েছে কয়েকজন।

হাজার হাজার ছাত্র-জনতা মুক্তিকামী মানুষকে সাথে নিয়ে কুস্টিয়া চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুরের অনেক নেতা এই প্রতিরোধ যুদ্ধের নেতৃত্বে ছিলেন। আলমডাঙ্গায় নেতৃত্ব দিয়েছে শাফায়েত-উল ইসলাম,ডা.সাহাবুদ্দিন(সাবু ডাক্তার),বাবু বিমল পাল,কাজী কামাল, রশীদ মোল্লা,আনোয়ার আহমেদ আনু প্রমুখ।

ড.হামিদের ভাষ্যে,  "৩০ মার্চ কুস্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধে আমি স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসা দিতে ওষুধ, গজ-ব্যান্ডেজ সাথে রেখে প্রতিদিন আনোয়ার আহমেদ আনুকে আমার মোটর সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিজের ঘাড়ে পয়েন্ট ২২ বোর রাইফেল নিয়ে পোড়াদহ-কুস্টিয়া যেতাম। প্রকাশ্যে নিজের ঘাড়ে রাইফেল রাখা কতটা ঝুঁকি তখন ওতো ভাবিনি।মনে হয়েছে প্রয়োজনে রাইফেল তাক করে শত্রুর বিপক্ষে লড়তে পারবো।"

এলাকায় রাজাকারেরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযোগিতা করেছিল সেসব ঘটনা তুলে ধরে তিনি বলেন, "রাজাকাররা গরীব হিন্দুদের কাপড়-চোপড় ধান-চাল, গরু,টিনের চালা, শোয়ার চৌকিটাও লুট করেছে। জমিজিরেত জোর জবরদস্তির টিপসই নিয়ে কেড়ে নিয়েছে। কুস্টিয়ার যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিবাহিনীর জন্য নিজের গ্রামের ছেলেমেয়েদের দিয়ে জোগাড় করা শুকনো খাবার,রুটি,গুড় আলমডাঙ্গার ডাকবাংলোতে পাঠানোর কারণে দুর্লভপুর গ্রামের ডাক্তার জগবন্ধু আচার্যের বাড়িঘর তছনছ করলো তারা।

"এই অঞ্চলের সব ঘরে ঘরে ঐ কয়দিন তখন মেয়েদের রুটি ও শুকনো খাবার বানানোর হিড়িক পড়ে যায়। কুস্টিয়া চুয়াডাঙ্গা মেহেরপুর ঝিনেদার এতোবড় অঞ্চলের মা-মেয়েদের সহযোগিতার কারণে কুস্টিয়ার যুদ্ধ জয় সহজ হয়েছে।"

আবদুল হামিদ বলেন,  "কুষ্টিয়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর জন্য খাবার পাঠাতে আলমডাঙ্গার ডাকবাংলোতে রান্নাবান্নার আয়োজন করা হতো। গোবিন্দপুরের হারেস সরদার রান্না করতো।নেতৃবৃন্দের সাথে থেকে ড.বজলুল হক এসব তদারকি করতেন। মুক্তিযুদ্ধের এই কর্মযজ্ঞের সাথে ছিল ডাকবাংলোর কেয়ারটেকার নজর আলী।স্বাধীনতা বিরোধীরা এই আয়োজনের ছবি তুলে পরবর্তীতে সম্ভবত খানসেনাদের দেখায়।"

যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির শুরু থেকে যুক্ত থাকা প্রবীণ ব্যক্তি হরিণাকুন্ডু থানার আমিরুল ইসলাম বলেন-, "কুষ্টিয়ার প্রতিরোধ যুদ্ধের আগে ভাংবাড়িয়া ও আশপাশের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানদের সাথে চুয়াডাঙ্গার তৎকালিন ইপিআর প্রধান মেজর ওসমান চৌধুরীর আলোচনা সভা হওয়ার কথা ছিল কিন্তু তিনি আসতে পারেননি, সভাও হয়নি।

"কিন্তু এই গোপন খবর জানাজানি হলে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত বগাদি গ্রামের একজন লোক সামরিক পোশাকে ভাংবাড়িয়া গ্রামে এসে আওয়ামী লীগ নেতা চেয়ারম্যান হেফাজউদ্দিন বিশ্বাস ও তার বড় ছেলে রতন ও খালেক নামের একজনকে (খালেক মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের না) চুয়াডাঙ্গায় ধরে নিয়ে যায়। পরে শোনা গেল তাদেরকে মাথাভাঙ্গা নদীর পাড়ে নিয়ে হত্যা করে খান সেনা ও রাজাকার বাহিনী।"

তার ভাষ্যে, ভাংবাড়িয়ায় আসতে না পারলেও আলমডাঙ্গা থানা কাউন্সিল চত্বরে উপস্হিত হলেন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী। বিপুল জনসমাগম তখন। সেখানে হাজির হলেন সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ডা.বজলুল হক।

"পরবর্তীতে ১৪ এপ্রিল ভেড়ামারা, ১৫ এপ্রিল ঝিনেদা ও কুষ্টিয়া খান সেনাদের দখলে চলে গেল। সে কারণে ঐদিনই চুয়াডাঙ্গা থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমের রণসদর দপ্তর মেহেরপুর সরিয়ে নেওয়া হলো। যখন ১৬ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গা,মেহেরপুরের পতন ঘটলো তখন রণসদর দপ্তর আবার মেহেরপুর থেকে ইছাখালিতে সরানো হলো। তবে এই অঞ্চল পতনের আগে ৩০মার্চ কুস্টিয়ার যুদ্ধ, ৫ এপ্রিল বিষয়খালির যুদ্ধ ও ৭ এপ্রিল লেবুতলার যুদ্ধে জয় পেয়ে মুক্তিবাহিনীর মনোবল চাঙ্গা হয়ে উঠলো", বললেন আবদুল হামিদ। 

১০ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গাকে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্হায়ী রাজধানী ঘোষণা করা হবে এমন খবর প্রচার হয়ে গেলে ১৫ ও ১৬ তারিখে আবার বিমান হামলা শুরু হয়। নিরীহ মানুষজনের ওপর হামলার কারণে চুয়াডাঙ্গা থেকে মানুষ যে যার মতো পালাতে থাকে।

"দখলদার বাহিনী ১৬ এপ্রিল ঝিনাইদহ থেকে চুয়াডাঙ্গা আসার পথে সড়কের আশেপাশের দোকান-পাট,হাট-বাজার,বাড়ি-ঘরের নিরীহ মানুষদের ব্রাশফায়ারে হত্যা করে চুয়াডাঙ্গা শহরে সন্ধ্যা নাগাদ ঢুকে পড়লো।ঐদিন অনেক নিরীহ মানুষ প্রাণ হারায়।১৬ এপ্রিলের রাতটা খুব দুর্যোগের ছিল।ঝড়-বৃষ্টি কাদা পানিতে রাস্তাঘাট একাকার। কি যে দুঃসময় তখন!"

তিনি বলেন, "মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক শাফায়েত মিয়াদের নির্দেশে সম্ভবত এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তায় সকালে আলমডাঙ্গা কলেজের কন্ট্রোলরুম বন্ধ করে দিয়ে মাইকিং করে জানানো হলো, সকলকে যার যার মতো নিরাপদ জায়গায় সরে যেতে।"

আলমডাঙ্গা রেলস্টেশনের কাছে ওয়াপদা কলোনীর পূর্ব দিকে ও কালিদাসপুর লাল রেল ব্রিজের কাছে খান সেনারা ঘাঁটি তৈরি করে। ড. বজলুল হকের বাড়ির সামনে থানা কাউন্সিলে ক্যাম্প বসায়। একটা সময় বজলুল হকের ডিসপেনসারির একাংশও দখল করে নেয়। চারতলা ভবনে রাজাকারদের জন্য ক্যাম্প করা হয়। ঐ ভবনের ছাদে খানসেনারা অস্ত্র তাক করে টহল দিত।

"আন্দিয়া বাবুর বাড়িতে মিলিশিয়া পুলিশ ক্যাম্প ও আনন্দধাম ক্যানেল ব্রীজে রাজাকার ক্যাম্প হলো।এখানকার নিরীহ মানুষকে মেরে ফেললো,নির্যাতন করলো,বাড়িঘরে আগুন দিলো", বললেন আবদুল হামিদ। 

লালব্রিজ

তখন পাকিস্তানি মেজর রানার নাম খুব শোনা যেত জানিয়ে আবদুল হামিদ বলেন, "যেদিন ওরা আলমডাঙ্গা দখল করলো সেদিন তৎকালিন ডাউকি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান বিনোদপুর গ্রামের আবুল হোসেন,বাবু গঙ্গাধর জালানের ভাই পুষ্কর জালান,দোয়ারকা বাবুসহ এক পুলিশকে হাটবোয়ালিয়া গ্রামের মাথাভাঙ্গা নদীতে নিয়ে হত্যা করে। ঐদিন আলমডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান গোবিন্দপুর গ্রামের আওয়ামীলীগের ডা.শমশের আলী মিয়াকে ধরে নিয়ে যায়,পরে প্রাণ নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছেন তিনি। যুদ্ধের শেষের দিকে হানাদাররা গোবিন্দপুরের হরেকৃষ্ণকে মেরে ফেললো।

"খান সেনারা রেলস্টেশনের বাইরে লাল রেলব্রিজের কাছে ট্রেন থামিয়ে নিরীহ পুরুষ যাত্রীদের মুক্তিযোদ্ধা কি না প্রমাণের জন্য তল্লাশির নামে তাদের সম্পদ লুট করতো, এরপর পুরুষদের নামিয়ে নিয়ে মেরে ফেলার পর রেলওয়ের লালব্রিজ ও কালিদাসপুর এলাকার গণকবরে ফেলে দিতো।মেয়েদেরকে ট্রেন থেকে নামিয়ে সরাসরি ওয়াপদা'র দারোয়ানদের হলদে রঙের ঘরে নিয়ে নির্যাতন নিপীড়ন শেষে হত্যা করতো।"

মানুষ তখন বলাবলি করতো খানসেনা ও রাজাকাররা নিরীহ এবং নির্দোষ মানুষকে হত্যা করে ব্রিজ থেকে কুমার নদে ফেলে দিচ্ছে।

বধ্যভূমি গার্ডরুম

জুন মাসে গোবিন্দপুরের মফিজউদ্দিন বিশ্বাস নিহত হলে রাজাকার ও খানসেনারা ড.বজলুল হকের ভগ্নিপতি ব্রিটিশ রেলওয়ের গার্ড শামসুদ্দিন আহমেদ ওরফে শাম গার্ডকে চাপ দিতে থাকে বজলুল হককে তাদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য; না দিলে পরিবারের সবাইকে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়।

বুজলুল হককে খানসেনা ও রাজাকারদের হাতে তুলে দেওয়া হয়নি। তবে জুন মাসের মাঝামাঝি একদিন বজলুল হকের মেজো ছেলে সনজুকে লতিফ দারোগা বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর পরিবার থেকে সে বিচ্ছিন্ন। পরে যশোর থেকে বন্দীদশা মুক্ত হয়ে সেপ্টেম্বরে বাড়ি ফেরার সুযোগ মেলে তার। গালভর্তি দাড়ি,উসকো খুসকো চুল;ভীতসন্ত্রস্ত চেহারার সনজুকে তখন আর চেনা যায় না।

একদিন ড.বজলুল হকের বাড়ি রেইড দেয় পাকিস্তানি মিলিশিয়া বাহিনী, যাকে ঝটিকা হামলা বলে। সারাবাড়ি ঘিরে ফেলে। ডিসপেনসারি ও বাড়ির সবকিছু তন্ন তন্ন করে লুটপাট চালায়।তছনছ করে দেয় সবকিছু। তারপর তাকে থানায় নিয়ে যায়; এরপর চুয়াডাঙ্গাতে পাঠিয়ে দেন। দুইদিন পর তাকে আবার ফেরৎ দেয়।

"ঐদিন আমাকে থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে পরে ছেড়ে দেয়", বললেন আবদুল হামিদ।

"১৪ অগাস্ট ১৯৭১। সকালে ডিসপেনসারির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। আগের দিন শুকচা বাজিতপুরের যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধা টগরের মরদেহ গরুর গাড়িতে বাঁশের সঙ্গে পা উপরে বেঁধে ঝুলিয়ে আলমডাঙ্গা শহরের স্টেশন রোড থেকে এক অবাঙালি চারতলা মোড়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। যেতে যেতে আমাকে দেখে বিহারি কটাক্ষের সুরে তুমি সম্বোধন করে বলে,তোমাদের লোক সে তোমাদের লোক।আমি ডিসপেনসারিতে ঢুকে পড়ি।"

সাদা ব্রিজ

তিনি বলেন,  "তারপর টগরের মৃতদেহ চারতলার মোড়ে নিয়ে খুঁটির সাথে দু'পা উপরের দিকে বেঁধে মনে হয় দুই দিন ওভাবে রেখে দেওয়ার পর জিকে ক্যানেলের ধারে শহীদ টগরকে মাটিচাপা দেয়। ঐ অবাঙালিকে স্হানীয় রাজাকার,শান্তি কমিটির উচুঁ পর্যায়ের মেম্বররাও ভয় পেতো। না জানি ওর মতের বিরুদ্ধে গেলে তাদেরকেও শেষ করে দেয় কি না!"

স্মৃতি হাতড়ে  ৭ অক্টোবরের ঘটনা মনে করে আবদুল হামিদ বলেন,  "শবে-বরাতের দিন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ইউসুফ মিয়া তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে নিহত হলেন। পরদিন সকালে হঠাৎ ড.বজলুল হকের বাড়িতে খান সেনাদের আক্রমণ। সারা বাড়ি কেরোসিন ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে সবকিছু অঙ্গার করে দিলো। বাড়িটায় দুই বার এমনভাবে আগুন লাগালো যে বাস করার মতো থাকলো না। প্রথমে আগুন জ্বালিয়ে ওরা চলে গেল। আবার ফেরৎ এসে তা কেন নেভানো হলো সেই অপরাধে পরিবারের এক ছেলেকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিঠে বেদম আঘাত করলো।বাবা রে মা রে বলে সে কি চিৎকার তার!"

নয় মাস কোনো স্বস্তি ছিল না কোনো মানুষের মনে। রাজাকারদের ও খানসেনাদের অত্যাচারে আতঙ্কিত এলাকার মানুষ। প্রায় রাতে মাইন বিস্ফোরণের বিকট শব্দ শোনা যেত। পরে জানা হয়ে গেল খান সেনা ও রাজাকারদের ভয়ে রাখতে মুক্তিফৌজের দল বিস্ফোরণ ঘটাতো। রাতের অন্ধকার ছিল কিছুটা স্বস্তির; কারণ মুক্তিযোদ্ধারা রাতে বের হতো। খান সেনারা রাতে ভয়ে বের হতো না।

তিনি বলেন,  "সেদিন ছিল ১২ নভেম্বর শুক্রবার। বোধ হয় ১৩৭৭ বঙ্গাব্দের কার্তিক মাস। ২২ রমজান। এদিন আলমডাঙ্গা শহরে মুক্তিবাহিনীর সাথে পাকিস্তানি আর্মির যুদ্ধ শুরু হয়।এই যুদ্ধে স্টেশনপাড়ার বাহার আলী মোল্লার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা নান্নু ড. হকের বাড়ির পাশে পাডিয়া স'মিলের পিছনে খান সেনাদের গুলিতে শহীদ হলো। জয়ের আনন্দে রাইফেল খাড়া করে ড.হকের বাড়ির সামনে দিয়ে থানা কাউন্সিলের দিকে যেতে মিলিশিয়া বাহিনীর গুলিতে মুক্তিযোদ্ধা আশু শহীদ হয়।

"এই যুদ্ধে যোগ দিয়ে তাহের হুদা ইউনিয়নের শ্রীপুর গ্রামের আবদার বাহিনীর যোদ্ধা দামুড়হুদা থানার আনসার আলী শহীদ হলো। সরকারি খাদ্য গুদাম কর্মকর্তা গফুর সরদার সাহেবের ছেলে দুলাল (যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা দুলাল) ও পাঁচলিয়া গ্রামের ছেলে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার জামাল উদ্দিন আহত হলো।পুরো শহরে তখন ভুতুড়ে পরিবেশ;এই পরিবেশেও আমি রুগী দেখতে বের হয়েছি।"

বলতে বলতে কিছুক্ষণ থেমে যান আবদুল হামিদ। তারপর আবার বলেন, "যেদিন যুদ্ধ শুরু হলো তার আট-নয় দিন পর ঈদ। মুক্তিযোদ্ধাদের পরিকল্পনা ছিল ঈদের নামায শেষে রাজাকারদের ক'জনকে জীবিত ধরে এনে ওদের কাছ থেকে খবর সংগ্রহ করা। কিন্তু হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল।পরে জানা গেল মুক্তিযোদ্ধাদের এই পরিকল্পনা রাজাকাররা কোনো ভাবে জেনে খান সেনাদের জানিয়ে দেয়। যার ফলে আগেভাগে যুদ্ধ শুরু হয়।"

সারাদিন থেমে থেমে যুদ্ধ চলছিল।  দুপুর বেলা দখলদার বাহিনীর একটা দল রাজাকারদের সাথে নিয়ে ড.বজলুল হকের বাড়িতে অতর্কিতে হামলা চালায়। নিরস্ত্র স্বাধীনতাকামী এই মানুষকে টেনে হিঁচড়ে পাশে তার বোনের বাড়ির উঠোনে নিয়ে হত্যা করে। এরপর বড় ছেলে মনজুকে থানায় ধরে নিয়ে যায়। পরে রাজাকারদের কারো অনুরোধে মা হারা অনেকগুলো ছোট ভাইবোনের কথা ভেবে মনজুকে ছেড়ে দেয়।

"ওদের আব্বাকে কবরে শোয়ানোর সুযোগ দেয়নি খানসেনারা।তার নিথর দেহ নির্জন উঠোনে চাদরে ঢেকে রেখে বাড়ি ছেড়ে চলে যায় সবাই।"

পাঁচ মুক্তিযোদ্ধার কবর

শহীদ ড. বজলুল হক ও তিন শহীদ মুক্তিযোদ্ধা মোল্লা আবুল হোসেন নান্নু,আশরাফ আলী আশু ও আনসার আলীকে তৎকালীন থানা কাউন্সিল এলাকার এক কোণে গণকবরে মাটিচাপা দিয়ে রাখে ওরা। দেশ স্বাধীন হলে ক্যানেলের পাশ থেকে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা জামসেদ নূরী টগরকে তুলে এনে চার শহীদের সাথে সমাহিত করা হয়।

পরিশেষে বয়োজ্যেষ্ঠ আবদুল হামিদের একটাই কথা,  "৭ ডিসেম্বর বর্বর যুদ্ধাপরাধী পরাজিত পাকিস্তানি সেনারা এই জনপদ ছেড়ে গেলেও সেই জেনোসাইডের  দলিল হয়ে রয়েছে আলমডাঙ্গা।"