অং সান সু চি ছিলেন গণতন্ত্রের মূর্ত প্রতীক। বুদ্ধিদীপ্ত, উচ্চ শিক্ষিত, স্বতস্ফূর্ত এবং ফটোজেনিক।
মিয়ানমারের জেনারেলরা ছিলেন এর বিপরীত। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তাদের বিষয়ে ইতিবাচক কিছু লিখবে- সে আশা তারাও করতেন না। ভাবমূর্তি ভালো করার কোনো চেষ্টাও তারা কখনো করেননি।
সামরিক শাসনের সেই সব দিনে মিয়ানমারে যে বিদেশি সাংবাদিকরা কাজ করেছেন, দিনের পর দিন তাদের গুপ্ত পুলিশ আর গুপ্তচরদের নজর এড়িয়ে চলার চেষ্টা করতে হয়েছে। সামরিক জান্তা এই সাংবাদিকদের সব সময় ঘৃণার চোখে দেখেছে; অন্যদিকে গণতন্ত্রপন্থিরা তাদের স্বাগত জানিয়েছে।
১৯৯৫ সালের জুলাই মাসে অং সান সু চি যখন প্রথমবার গৃহবন্দি দশা থেকে মুক্ত হলেন, নেলসন ম্যান্ডেলার পর তিনিই তখন বিশ্বে স্বৈরাচারবিরোধী লড়াইয়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক। ওই সময়ই সু চির সঙ্গে বিবিসির সাংবাদিক ফের্গল কিনের প্রথম সাক্ষাৎ হয়।
অকুতোভয় সু চি কেমন করে সৈন্যদের উদ্যত রাইফেলের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন, তা সে সময় আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর জন্য বড় খবর ছিল।
গৃহবন্দি সু চির মুক্তির দাবিতে সে সময় সোচ্চার ছিল জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। সেজন্য নানাভাবে চেষ্টাও করেছিল তারা।
সেই সব দিনে সু চি ইয়াংগুনে লেকের ধারে তার বাড়ি থেকে গেইটের বাইরে অপেক্ষমাণ সমর্থকদের বলতেন- কেন তাদের আরও সহিষ্ণু হতে হবে, কেন শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। তার যেসব বক্তৃতা বিদেশি সাংবাদিকরাও শুনেছেন।
ফের্গল কিন লিখেছেন, ১৯৯০ সালে তাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও সু চি বার বার অহিংস আন্দোলনের ওপর জোর দেন।
মিয়ানমারে বদলি হওয়ার আগে দির্ঘদিন দক্ষিণ আফ্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে কাজ করেন কিন। সেখানে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস কীভাবে গণতন্ত্রে আসার প্রক্রিয়া সফল করল, তা জানতে সু চি উদগ্রীব ছিলেন।
সু চির উক্তি ‘ফ্রিডম ফ্রম ফিয়ার’ সে সময় বার বার শোনা যেত। পরে ওই শিরোনামে একটি বইও প্রকাশিত হয়।
সে সব দিনে ফের্গল কিনের মত যে পশ্চিমা সাংবাদিকরা মিয়ানমারে দায়িত্ব পালন করছিলেন, তাদের অনেকেরই রুয়ান্ডা বা বলকানের সংঘাতপ্রবণ এলাকায় সাংবাদিকতার অভিজ্ঞতা ছিল। সু চির কাছে অহিংসার ভাষাই তারা শুনতে চাইতেন।
ফের্গল কিন লিখেছেন, গণহত্যা আর জাতিগত নির্মূল অভিযান দেখার পর ‘লেকের পারের সেই নারী নেত্রীর’ বক্তৃতায় উজ্জীবিত বোধ করতেন তারা।
বিশ্বে সে সময় সার্বিয়ার স্লোবোদান মিলোসেভিচ, ক্রোয়েশিয়ার ফ্রাঞ্জো তুজমান এবং রুয়ান্ডায় উগ্রপন্থি হুটুদের নৃশংসতার খবরের মধ্যে পশ্চিমা সংবাদিকদের মনে হত, মিয়ানমারে একজন শান্তির দূতকে তারা পেয়েছেন।
যুগ যুগ ধরে সেনা শাসনে থাকা মিয়ানমারে দারিদ্র্য আর বৈষম্যের কারণে গভীর থেকে গভীরতর হওয়া জাতিগত দ্বন্দ্বের জটিল সমিকরণ যে এই সাংবাদিকরা খুব ভালোভাবে বুঝতে পেরেছিলেন, তা নয়। অং সান সু চির ব্যক্তিগত ভাবনা সম্পর্কেও তাদের ধারণা ছিল খুব কম।
ফের্গল কিন লিখেছেন, যে জেদের কারণে সু চি সামরিক জান্তার সঙ্গে কখনও আপসে আসেননি, সেই জেদ যে ক্ষমতায় যাওয়ার পর বিদেশি সমালোচকদের বিষয়েও সমান শক্তিশালী হয়ে দেখা দিতে পারে, তা সম্ভাবনা তখন তাদের মাথায় আসেনি।
বিপদের সময় যা ছিল সু চির সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা, এখন তাই তার সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে উঠতে পারে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আন্দোলনে যারা এতদিন বন্ধু ছিলেন, রাজনীতিবিদদের মধ্যে যারা ছিলেন সহানুভূতিশীল, তাদের অনেকেই এখন সু চির সমালোচনায় মুখর।
কিনের ভাষায়, সু চিকে যারা কাছ থেকে দেখেছে, তারা জানে, একবার মনস্থির করলে সেখান থেকে তাকে সরিয়ে আনা কত কঠিন।
মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি বিজয় নামবিয়ার গত ডিসেম্বরে যখন রাখাইন এলাকা পরিদর্শনের আহ্বান জানালেন, সু চি তা প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।
সু চির দলের ঘনিষ্ঠ একজন একবার কিনকে বলেছিলেন, নামবিয়ার যা চাইছেন তা কখনোই করবেন না তাদের নেত্রী। হত্যা, ধর্ষণ আর বাড়ির ভেতর পুড়িয়ে মারার খবর যতই আসুক, তিনি এটাও স্বীকার করবেন না যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের জাতিগতভাবে নির্মূলের চেষ্টা হচ্ছে।
রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চির অবস্থানের সমালোচনা অবশ্য নতুন নয়।
পাঁচ বছর আগে মিয়ানমারে যখন সহিংসতার কারণে এক লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাস্তুহারা হল, তখনও তার অবস্থান ছিল একই।
মিয়ানমারের মানুষ তাকে ডাকে ‘দো সু’ বা ‘সু খালা’ নামে। রাখাইনে গিয়ে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বানে ওই সময়ও তিনি সাড়া দেননি।
সু চির সরকার উগ্রপন্থি বৌদ্ধদের ঘৃণা ছড়ানো বন্ধের উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু তার রাজনৈতিক ‘হিরো’ মহাত্মা গান্ধী বা জওহরলাল নেহেরু ভারতবর্ষ ভাগ হওয়ার পর মুসলমানদের সমর্থনে প্রকাশ্যে যে অবস্থান নিয়েছিলেন, মিয়ানমারের নেত্রী তা করেননি।
মারমুখো হিন্দুদের মিছিলের মধ্যে গিয়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা থামানোর যে চেষ্টা নেহেরু করেছিলেন, ২০ শতকের ইতিহাসে তা সাহসিকতার অন্যতম নজির হিসেবে বিবেচিত।
সু চির কাছ থেকে তা কেউ আশা করছে না। কিন্তু আদর্শের জায়গা থেকেও তার যে নীরবতা, সেটাই তার সাবেক অনেক সমর্থকের সমালোচনার কারণ।
রোহিঙ্গাদের দুর্দশা এমনিতেই একটি ট্র্যাজেডি। কিন্তু রাখাইন থেকে যে ধোঁয়ার মেঘ এখন উঠছে, তার অর্থ এটাই যে, সেনাবাহিনী এখনও তাদের পুরনো ধারায় নির্মমতা চালিয়ে যেতে পারে, বিশ্ব যাই বলকু না কেন।
আর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অভিযান এখন দেখা যাচ্ছে, মিয়ানমারের অন্যান্য রাজ্যের সংখ্যালঘু জাতি বা কারেন বিদ্রোহীদের কাছে তা তো অচেনা নয়।
অং সান সু চি সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করেন না। সেনাবাহিনীও তার ওপর আস্থা রাখে না। কিন্তু সু চি যখন সেনাবাহিনীর নির্যাতনের নিন্দা করতে অস্বীকৃতি জানান, তখন তা জেনারেলদের রাজনৈতিক আশ্রয় দেয়।
তখন তা নীরবতার চেয়েও বেশি কিছু হয়ে ওঠে।
নিরাপত্তা পরিষদে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নিন্দা প্রস্তাব ঠেকাতে সু চির সরকার রাশিয়ার সঙ্গে কাজ করছে। আর তিনি নিজে রাখাইনের সহিংসতার জন্য দায়ী করেছেন সন্ত্রাসীদের।
সু চির জেদ এখানে একটি বিষয়। কিন্তু তার চেয়েও গুরুতর একটি প্রশ্ন এখনো অমীমাংসিত।
বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ মিয়ানমার নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলমানদের কখনোই নিজেদের নাগরিক হিসেবে মেনে নেবে না বলে উদ্বেগ রয়েছে। তাহলে মানবাধিকারের প্রতি সু চির অঙ্গীকার কি পক্ষপাত দুষ্ট?
সেনাবাহিনীকে তাদের বর্বর অভিযান বন্ধের জন্য চাপ দিয়ে এই প্রশ্নের উত্তর সু চি দিতে পারেন। তেমন কোনো লক্ষণ অবশ্য এখনও দেখা যাচ্ছে না।
[বিবিসিতে প্রকাশিত ফের্গল কিনের লেখা থেকে অনূদিত]