রানি এলিজাবেথ মারা গেলে যা যা ঘটবে

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাবা ষষ্ঠ জর্জের মৃত্যুর পর ২৫ বছর বয়সে সেই যে বসেছিলেন সিংহাসনে; তারপর পেরিয়ে গেছে ৬৪ বছর। রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ এখন বিশ্বের সবচেয়ে বেশি সময় ধরে টিকে থাকা ব্রিটিশ রাজত্বের শাসনকর্তা; থাই রাজা ভূমিবল আদুলিয়াদেজের মৃত্যুর পর তিনি বিশ্বে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাজত্ব পরিচলনা করা জীবিত ব্যক্তিও।  

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 March 2017, 02:50 AM
Updated : 30 March 2017, 02:50 AM

চলতি বছরই ৯২ বছরে পা দিতে যাওয়া রানিকেও নিতে হবে অনিবার্য বিদায়। ‘‍মুখে আনতে না চাইলে’ও এই বিষয়ে প্রস্তুতিতে কোনো কার্পণ্য রাখছে না যুক্তরাজ্য সরকার ও বাকিংহাম প্যালেস। ‘বেদনাচ্ছন্ন’ বিদায়কে ঘিরে তাদের প্রস্তুতির খবর জানিয়েছে ব্রিটিশ দৈনিক টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি ও গার্ডিয়ান।

তাদের দেয়া তথ্যমতে, রানির মৃত্যুর খবর প্রথমে জানানো হবে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীকে, এরপর সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের। তবে সরাসরি তাদেরকে প্রয়াণের খবর জানানো হবে না, হবে বিশেষ কোড বা সংকেতের মাধ্যমে।

রানির কোড ‘লন্ডন ব্রিজ’। তিনি মারা গেলে বিশেষ টেলিফোন লাইনে বিষয়টি জানানোর সময় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তা বলবেন, ‘লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন’।

এখন অবশ্য ‘লন্ডন ব্রিজ ইজ ডাউন’ এর ব্যাপারটা সবাই জেনে ফেলেছে; তাই কোড বদলে যেতে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে।

রানির ব্যক্তিগত সচিব ক্রিস্টোফার গাইট প্রধানমন্ত্রীকে টেলিফোনে গোপন সংকেত জানানোর পর পররাষ্ট্র দপ্তরের গ্লোবাল রেসপন্স সেন্টার থেকে এ খবর যুক্তরাজ্যের বাইরে ১৫টি দেশের সরকারের কাছে পাঠানো হবে। যুক্তরাজ্যের রানিই এসব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান। এছাড়া রানির প্রভাব রয়েছে কমনওয়েলথভুক্ত এমন ৩৬টি দেশেও খবরটি পাঠানো হবে।

এসব দেশের প্রধানমন্ত্রী, গভর্নর জেনারেল ও রাষ্ট্রদূতেরা শোক প্রকাশ করতে বাম বাহুতে সোয়া তিন ইঞ্চি প্রশস্ত কালো বন্ধনী পরবেন বলেও জানিয়েছে গার্ডিয়ান।

শেষ মুহূর্তে জ্যেষ্ঠ চিকিৎসক অধ্যাপক হিউ টমাস রানির পাশে থাকবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। রানির মৃত্যুর পর তার ঘরে কে কে প্রবেশ করবেন তা ঠিক করবেন টমাস। এমনকী সাধারণ মানুষকে কীভাবে রানির মৃত্যুর তথ্য জানানো হবে, তাও ঠিক করবেন তিনি।

সাধারণ মানুষ খবরটি পাবে সংবাদমাধ্যমকে জানানোর পর। তবে কখন সংবাদমাধ্যমকে জানানো হবে, তা ঠিক হবে রানি কখন মারা যান তার উপর। তিনি যদি রাতে মারা যান সেক্ষেত্রে পরদিন সকালে মৃত্যুর খবর গণমাধ্যমকে জানানো হবে।

বিবিসি ও আইটিএন আনুষ্ঠানিকভাবে রানির মৃত্যু সংবাদ প্রচারের সুযোগ পাবে।

এই ঘটনাকে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনায় নিয়ে রেডিও স্টেশনগুলো চলবে ‘শোক প্রস্তুতি’তে। একটি নীল রঙয়ের আলো ক্ষণে ক্ষণে জ্বলতে থাকবে যেন স্টেশনে থাকা ডিস্ক জকিরা শোকাচ্ছন্ন এবং ধীর লয়ের সুর ও গান বাজান, যতক্ষণ পর্যন্ত না আনুষ্ঠানিকভাবে রানির মৃত্যুর সংবাদ প্রচারিত হয়।

“যদি তুমি কখনও দিনের বেলায় রেডিওতে সাব্রিস অব প্যারাডাইজের হন্টেন্ড ড্যান্সহল শোনো, তাহলে টিভি খুলো। হয়তো ভয়ানক কিছু ঘটে গেছে,” ২০১১ সালে হাফিংটন পোস্টে লেখা বিবিসির রেডিও প্রযোজক ক্রিস প্রাইস রানির মৃত্যুর পর কি কি ঘটতে পারে তার বর্ণনায় এমন একটি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

আনুষ্ঠানিকভাবে যখন রানির মৃত্যুর খবর প্রচার হবে তখন একজন পদাতিক বাকিংহাম প্রাসাদের ফটকে পিন দিয়ে রানির মৃত্যুর সংবাদ টাঙিয়ে দেবেন।

“যখন পদাতিক এরকম কিছু করবেন, সঙ্গে সঙ্গে প্রাসাদের ওয়েবসাইটটি অন্ধাকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে। এক পৃষ্ঠায় কালো ব্যাকগ্রাউন্ডে সেখানে কেবল প্রাসাদের ফটকে থাকা ঘোষণাটিই দেখা যাবে,” বলছে গার্ডিয়ান।

যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের সর্বত্র ইউনিয়ন জ্যাক পতাকা অর্ধনমিত রাখা হবে। দূতাবাসগুলোতে খোলা হবে শোকবই।

এরপর পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের অধিবেশন ডাকা হবে, সাধারণ মানুষকে কাজ থেকে দ্রুত ছুটি দিয়ে বাড়ি পাঠানো হবে। আকাশপথে উড়োজাহাজের পাইলটরা যাত্রীদের সংবাদটি জানাবেন।

অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শুরুর আগ পর্যন্ত রানিকে ওয়েস্টমিনিস্টার হলে রাখা হবে। এখানেই ১২ দিন ধরে তাকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ দেওয়া হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। শোক প্রক্রিয়ায় রানির প্রিয় পশুপাখিদেরও সম্পৃক্ত করা হবে।

রানির কফিনে একটি ‘আলগা ডালা’ থাকবে বলেও গার্ডিয়ান জানিয়েছে; যেখানে মুকুট ও অন্যান্য রত্নসামগ্রী থাকবে। অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন ডালাটি সরিয়ে ফেলা হবে।

শ্রদ্ধা জানানো শেষে চার্চ অব ইংল্যান্ডের জ্যেষ্ঠ বিশপ আর্চবিশপ অব ক্যান্টারবুরি ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে কিংবা সেইন্ট পল ক্যাথেড্রালে রানির রাষ্ট্রীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার কাজ শুরু করবেন।

নরফোকের অষ্টাদশ ডিউক দ্য আর্ল মার্শাল রাজকীয় এই অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দেখভাল করবেন। শতাব্দীকাল ধরে তাদেরই হাতে এই দায়িত্ব দেওয়া বলে টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি জানিয়েছে।

ইউরোপের অন্যান্য রাজকীয় পরিবার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দেবেন। তাদের বেশিরভাগকেই রাখা হবে বাকিংহাম প্যালেসে। বাকিরা থাকবেন ক্লারিজ হোটেলে।

রানির মৃত্যু যদি ব্রিটেনের বাইরে হয়, সেক্ষেত্রেও বিশেষ প্রস্তুতি নিয়ে রাখা হয়েছে। মৃত্যুর খবর জানার পরপরই রাজকীয় কর্মচারীদের বানানো একটি বিশেষ কফিন জেটবিমানে করে রানি যেখানে মারা গেছেন সেখানে উড়িয়ে নেওয়া হবে।

এলিজাবেথ যদি স্কটল্যান্ডে মারা যান সেক্ষেত্রে সেখানকার রীতি অনুযায়ী সৎকার কার্যক্রম শুরু হবে বলে টাউন অ্যান্ড কান্ট্রি জানিয়েছে। রানির মৃতদেহকে তখন হোলিরুড হাউজ এবং সেইন্ট জাইলস ক্যাথেড্রালের মতো জায়গায়ও রাখা হতে পারে।

সবশেষে রানিকে উইন্ডসর প্রাসাদের সেইন্ট জর্জ চ্যাপেলে সমাহিত করা হতে পারে বলে অনুমান করা হচ্ছে।

ব্রিটিশ সিংহাসন কখনই উত্তরাধিকার শূন্য থাকবে না, এই রীতিতে রানির মৃত্যুর পরপরই স্বয়ংক্রিয়ভাবে তার বড় ছেলে চার্লস রাজা ঘোষিত হবেন। যদিও কখন তার অভিষেক  হবে, তা জানা যায়নি।

চার্লস রাজা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বদলে যাবে যুক্তরাজ্যের জাতীয় সঙ্গীত। এতদিন যেখানে ‘গড সেইভ দ্য কুইন’ বলা হতো, সেখানে বলা হবে ‘গড সেইভ দ্য কিং’। বদলে যাবে রাষ্ট্রীয় মুদ্রা, সিলমোহর ও স্ট্যাম্পের ছবিও।  

প্রিন্স চার্লস এরপর প্রথম সন্ধ্যাতেই জাতির উদ্দেশ্যে মায়ের মৃত্যুসংবাদ জানাবেন। এটাই হবে রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে তার প্রথম ভাষণ।

চার্লস ও নতুন রানি ক্যামিলা যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ইংল্যান্ড, ওয়েলস, স্কটল্যান্ড এবং নর্দার্ন আয়ারল্যান্ড সফর করবেন। কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোও নতুন রাজাকে শুভেচ্ছা জানাবে।

গার্ডিয়ান জানাচ্ছে, রানির মৃত্যুর পর আনুষ্ঠানিকতায় কোনো ধরনের খুঁত না রাখতে সবকিছুই অনেক আগে থেকে পরিকল্পনা করে রাখা হয়েছে। এখন যে প্রক্রিয়াগুলোর কথা বলা হচ্ছে তার সবকিছুই ১৯৬০ এর দশক থেকে নির্ধারিত। রানির প্রয়াণ মাত্র প্রক্রিয়াটি শুরু হয়ে যাবে।

রানির মৃত্যুর পর যাদের উপর সেইসব খবর প্রকাশ ও অন্যান্য দায়িত্ব বর্তাবে তারা প্রতি বছর দুই থেকে তিনবার একত্রিত হয়ে এইসব প্রক্রিয়া ঝালাই করে নেন।

তারা একইসঙ্গে এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অস্থায়ী সরকারি কর্মকর্তা, পুলিশ ও সম্প্রচারকারকদের এই বিষয়ে কোনো পরিবর্তন বা নতুন কিছু যোগ হয়েছে কী না, তাও জানান।