মুক্তিযুদ্ধে কামান্নায় শহীদদের দুই তালিকা

মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার কামান্না গ্রামে পাক বাহিনীর অতর্কিত হামলায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে।

মাগুরা প্রতিনিধিঝিনাইদহ ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 Nov 2015, 11:19 AM
Updated : 27 Nov 2015, 02:16 PM

কামান্নায় ঘটনাস্থলে স্থাপিত স্মৃতিফলকে ২৭ শহীদের নাম লেখা হলেও মাগুরায় ওই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্মস্থানে আরেক স্মৃতিফলকে লেখা হয়েছে ২৮ জনের নাম।  

উভয় তালিকায় ২৭ জন রয়েছেন অভিন্ন। শুধু মাগুরায় একজনের নাম বেশি আছে।

১৯৭১ সালের ২৬ নভেম্বর ভোরে কামান্নায় স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পাক-বাহিনী অতর্কিত হামলা চালায় মুক্তিযোদ্ধাদেরর একটি আশ্রয় কেন্দ্রে।

নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়ি মাগুরা সদরের হাজিপুর ইউনিয়নের বিভিন্ন গ্রামে। শহীদ ওই মুক্তিযোদ্ধাদের ওই সময় কামান্না গ্রামে কয়েকটি গণকবরে সমাহিত করা হয়।

ওইদিন বেঁচে যাওয়া এক মুক্তিযোদ্ধা হলেন হাজীপুর বাহিনীর ডেপুটি কমান্ডার আবু বক্কর।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের
মাগুরা প্রতিনিধিকে
বলেন, ১৯৭১ সালের ২৫ নভেম্বর রাতে হাজীপুর বাহিনীর একদল মুক্তিযোদ্ধা কামান্না গ্রামে রাত যাপনের জন্য মাধব কুণ্ডু নামে এক ব্যক্তির বাড়ির পরিত্যক্ত একটি টিনের ঘরে অবস্থান নেন।

“খবরটি স্থানীয় রাজাকাররা ঝিনাইদহের শৈলকুপা ও মাগুরায় পাক বাহিনীর ক্যাম্পে পৌঁছে দেয়।”

তিনি জানান, এরপর রাজাকার-আলবদর বাহিনীর সহায়তায় শৈলকুপা ও মাগুরা থেকে আসা পাক সেনারা ২৬ নভেম্বর ভোর রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের উপর অতর্কিতে গুলিবর্ষণ শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি ছুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করে।

“কিন্তু সুসজ্জিত পাকবাহিনীর আক্রমণের মুখে ঘটনাস্থলেই ২৮ মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন,” বলেন তিনি।  

পাক সেনারা চলে গেলে এলাকাবাসী কামান্না স্কুল মাঠের পাশে একাধিক গণকবরে ২৮ শহীদকে সমাহিত করেন বলে জানান আবু বক্কর।

মুক্তিযোদ্ধা আবু বক্করসহ শহীদ পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘ দিন ধরে কামান্না থেকে ২৮ শহীদের কবর নিজ এলাকা মাগুরার হাজীপুরে স্থানান্তরের দাবি জানিয়ে আসছেন।

মাগুরা জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার মোল্লা নবুয়ত আলী বলেন, কামান্না থেকে ২৮ শহীদের কবর মাগুরায় আনার জন্য কেন্দ্রীয় কমান্ড কাউন্সিল ও মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে আবেদন জানানো হয়েছে।

তিনি বলেন, কামান্না শহীদদের স্মরণে হাজিপুর গ্রামে নির্মিত হয়েছে শহীদ মিনার। প্রতি বছরের মতো এবছরও ২৬ নভেম্বর শহীদদের স্মরণে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে মিলাদ মাহফিল ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। 

ওইদিনের এক প্রত্যক্ষদর্শী হলেন কামান্না গ্রামের সামেনা বেগম।

বৃদ্ধা সামেনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঝিনাইদহ প্রতিনিধিকে বলেন, ঘটনাস্থলের পাশেই তার বাড়ি। ২৬ নভেম্বর ভোর রাতে পাকবাহিনী ও রাজাকারের দল ঘুমন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ঘরটি চারদিক থেকে ঘিরে আক্রমণ শুরু করে।

ওই সময় মুক্তিযোদ্ধারা দিশেহারা হয়ে পড়েন। সেখান থেকে পাঁচ মুক্তিযোদ্ধা পালিয়ে পাশের জঙ্গলে আত্মগোপন করেন বলে জানান তিনি।  

সামেনা বলেন, ২৭ মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের গ্রামের ফণিভূষণ কুণ্ডু ও রঙ্গবিবি নামে স্থানীয় দুজন ওইদিন নিহত হন।

পরদিন সকালে গ্রামবাসী লাশগুলো কুমার নদীর তীরে পাঁচটি গণকবরে তড়িঘড়ি করে দাফন করে বলে জানান সামেনা।

শৈলকুপা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডার মনোয়ার হোসেন মালিথা বলেন, দীর্ঘ ৪৪ বছর ধরে শহীদদের স্মরণে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি করে আসছেন মুক্তিযোদ্ধারা। 

কামান্না গ্রামের মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পের টিনের ঘর দুটি অবিকল সে অবস্থাতেই রয়েছে, যা সেদিনের স্মৃতি বহন করছে।

মাগুরায় শহীদ মিনারে লেখা শহীদদের তালিকায় রয়েছে ২৮ জনের নাম।

এরা হলেন আলমগীর, আব্দুর রাজ্জাক, অধীর কুমার শিকদার, গৌর চন্দ্র শিকদার, শহিদুল ইসলাম, মোমিম উদ্দিন, ওহিদুজ্জামান, হোসেন আলী, শরিফুল ইসলাম, আনিচুর রহমান, মাছিম মিয়া, মুন্সি আলিমুজ্জামান, মনিরুজ্জামান, আলী হোসেন, কাওসার শেখ, মুন্সি আব্দুল মতলেব, সলেমান শিকদার, রিয়াত আলী, খন্দকার আব্দুর রাশেদ, সেলিম বিশ্বাস, নির্মল বিশ্বাস, তাজুল ইসলাম, গোলজার রহমান খান, আব্দুর রাজ্জাক, আব্দুল সালেক, আব্দুল আজিজ, আব্দুল কাদের ও গোলাম আকবর।

ঝিনাইদহের স্মৃতিফলকের নামগুলোও এই তালিকায় আছে। তবে নির্মল বিশ্বাসের নাম সেই তালিকায় নেই।