আব্বাসের জামিন প্রশ্নে বিভক্ত আদেশ

নাশকতার দুই মামলায় ঢাকা দক্ষিণে বিএনপি সমর্থিত মেয়রপ্রার্থী মির্জা আব্বাসের জামিন আবেদনে বিভক্ত আদেশ দিয়েছে হাই কোর্টের একটি বেঞ্চ।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 April 2015, 09:54 AM
Updated : 15 April 2015, 04:26 PM

বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক নাশকতার দুই মামলায় তিন সপ্তাহের জামিন দিলেও অপর বিচারক তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে আবেদন খারিজ করেন এবং আব্বাসকে অবিলম্বে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।

বিচারপতি কামরুল ইসলাম সিদ্দিকী ও বিচারপতি গোবিন্দ চন্দ্র ঠাকুরের বেঞ্চ থেকে বুধবার এই বিভক্ত আদেশ আসে।

দুদকের করা আরেক মামলায় আব্বাসের জামিনের আবেদনটিও কার্যতালিকা থেকে বাদ দিয়েছে আদালত।

নিয়ম অনুযায়ী, বিষয়টি এখন প্রধান বিচারপতির কাছে যাবে। প্রধান বিচারপতি জামিন আবেদন নিষ্পত্তির জন্য অন্য একটি বেঞ্চ ঠিক করে দেবেন।

ফলে এখন সে পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে বিএনপির মহানগর আহ্বায়ক আব্বাসকে, যিনি মামলা মাথায় নিয়ে গত তিন মাস আত্মগোপনে থাকার পর জামিন চাইতে গত সোমবার প্রকাশ্যে আসেন।

বুধবারের আদেশের পর আসামিপক্ষ দাবি করেছে, জামিনের বিষয়টির নিষ্পত্তি না হওয়ায় আপাতত মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। অন্যদিকে রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, তাকে গ্রেপ্তারে আইনগত কোনো বাধা নেই।   

বিএনপির মহানগর আহ্বায়ক আব্বাসও আদেশের পর সাংবাদিকদের কাছে ‘হয়রানির’ শঙ্কার কথা বলেছেন।

আদালতে তার পক্ষে শুনানি করেন খন্দকার মাহবুব হোসেন ও এ জে মোহাম্মদ আলী। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম।

মোট তিন মামলায় আগাম জামিনের আবেদন নিয়ে সোমবার হাই কোর্টে আসেন মির্জা আব্বাস।

এর মধ্যে ২০১৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর পল্টন থানায় দায়ের করা মামলায় বাসে অগ্নিসংযোগ ও বিস্ফোরণের অভিযোগ রয়েছে। আর চলতি বছর ৪ জানুয়ারি মতিঝিল থানার মামলাটি করা হয়েছে বিস্ফোরক আইনে।

এছাড়া প্লট বরাদ্দে দুর্নীতির অভিযোগে গতবছর ৬ মার্চ শাহবাগ থানায় দুদকের দায়ের করা আরেক মামলার এজাহারে আব্বাসের নাম না থাকলেও গ্রেপ্তারের আশঙ্কায় জামিনের আবেদন করেন আব্বাস।  

ওইদিন দুই পক্ষের বক্তব্য শুনে নাশকতার দুই মামলায় আদেশের জন্য বুধবার দিন রাখে আদালত। আর অন্য মামলাটি কার্যকালিকা থেকে বাদ দেওয়ার কথা মৌখিকভাবে জানানো হয়।   

সেদিন আদালত বলে, জামিনের আদেশ হওয়ার আগ পর্যন্ত মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। আর  তিনি নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না; গণমাধ্যমে বক্তব্যও দিতে পারবেন না।  

দুদকের মামলায় আব্বাসের আবেদনটি বুধবারও কার্যতালিকায় রাখা হয়। তবে আদালত তা বাদ দেয় বলে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. বশিরউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। 

আব্বাসের অন্যতম আইনজীবী বদরুদ্দোজা বাদল আদেশের পর বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, দুদকের মামলায় জামিনের বিষয়ে বেঞ্চ ঠিক করে দেওয়ার জন্য তারা প্রধান বিচারপতির কাছে একটি আবেদন করেছেন। 

বাকি দুই মামলায় বিভক্ত আদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “যেহেতু বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য প্রধান বিচারপতির মাধ্যমে অন্য বেঞ্চে যাবে, সেহেতু আপাতত মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার বা হয়রানি করা যাবে না।” 

অন্যদিকে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “দুইজন বিচারপতির দ্বিমত হওয়ায় উনি (আব্বাস) এই আদালতে আত্মসমর্পণের আগে তার যে অবস্থায় ছিলেন, আমার বিবেচনায় সেই একই অবস্থানে উনি চলে গেছেন।”

দুদকের মামলায় তাকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে আইনগত কোনো বাধা নেই বলেও তিনি এক প্রশ্নের জবাবে জানান।

হয়রানির শঙ্কা আব্বাসের

গত ৫ জানুয়ারি বিএনপি সরকারবিরোধী আন্দোলন শুরুর পর ধরপাকড়ের মধ্যে লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যান মির্জা আব্বাস।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য নির্বাচনে প্রার্থী হলেও তার পক্ষে স্ত্রী আফরোজা আব্বাস ভোটের প্রচার চালিয়ে আসছেন। 

আদেশের পর সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতির কক্ষে মির্জা আব্বাস সাংবাদিকদের বলেন, “শুনেছি অ্যাটর্নি জেনারেল বলেছেন আমি এই মুহূর্তে ‘পলাতক’। তো তাতে আমার সন্দেহ হচ্ছে তারা আমাকে হয়রানি করতে পারে।... এখনও নির্বাচনের কারণেই আমাকে হয়রানিটা করা হবে।”

১৯৯১-৯৩ সাল পর্যন্ত ঢাকার মনোনীত মেয়র হিসাবে দায়িত্ব পালনের কথো তুলে ধরে তিনি বলেন, “ওই সময় ঢাকাবাসী দেখেছে আমার কার্যক্রম। এখন আমার কার্যক্রমের মূল্যায়ন তারা করবে ইনশাল্লাহ।

“আমাকে গ্রেপ্তার করে আর আমার কর্মীদের গ্রেপ্তার করে... আমি মনে করি তারা পোলিং সেন্টারের ভেতরে সিল মারার চেষ্টা করবে। সিল মেরে বিজয় ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করবে।... যাই হোক, আমি ঢাকাবাসীর কাছে বিনীতভাবে অনুরোধ জানাব, যদি আমাকে হয়রানি করা হয়, আমি সকলের কাছে দোয়াপ্রার্থী।”

নির্বাচনে নিজের প্রতীকে ভোট চেয়ে মির্জা আব্বাস বলেন, “আমার আবেদন থাকবে, আমি যদি আপনাদের কাছে সরাসরি আসতে পারি তো ভালো, না পারলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। আমার গ্রেপ্তারের জবাবটা মগ মার্কায় ঢাকাবাসী যাতে ভোটে দেন এটি কামনা করছি।”

‘গ্রেপ্তারে বাধা নেই’

আদেশের পর নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, মির্জা আব্বাসকে গ্রেপ্তার না করার বিষয়ে সোমবার যে আদেশ আদালত দিয়েছিল, এখন তা আর ‘বলবৎ থাকবে না’ বলে তিনি মনে করেন।

পুলিশ এখন আব্বাসকে গ্রেপ্তার করতে পারে কি না- এমন প্রশ্নে মাহবুবে আলম বলেন, “এর সরাসরি কোনো জবাব আমি দেব না। আমার বিবেচনায় আত্মসমর্পণের আগে যে অবস্থায় ছিলেন সেখানে ফিরে গেছেন। এখন উনি কী করবেন তা উনার বিষয়।”

আব্বাস ‘পলাতক’ অবস্থায় নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে পারেন না বলেও মত দেন অ্যাটর্নি জেনারেল।

দুদকের করা মামলায় পুলিশ আব্বাসকে গ্রেপ্তার করতে পারে কি না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, “দুর্নীতি মামলায় অবশ্যই গ্রেপ্তার করতে পারে। এ মামলায় গ্রেপ্তার এড়ানোর জন্যই উনারা প্রধান বিচারপতির কাছে গেছেন। ... যাতে এ কথা বলা যায় যে আমার মামলা সুপ্রিম কোর্টে বিচারাধীন আছে।”

‘গ্রেপ্তার হবে আইনের বরখেলাপ’

অ্যাটর্নি জেনারেল ‘গ্রেপ্তারে বাধা নেই’ বললেও তার সঙ্গে একমত নন মির্জা আব্বাসের আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।   

তার দাবি, দুদকের মামলায় জামিনের আবেদনটি তারা প্রধান বিচারপতির কাছে তোলায় বিষয়টি ‘আইনের দৃষ্টিতে মুলতবি’ হয়ে গেছে। বৃহস্পতিবার প্রধান বিচারপতি যে নির্দেশনা দেবেন, সে অনুযায়ীই সব হবে।

“নিয়ম হলম যখন কোনো আদালতে একটি দরখাস্ত পেন্ডিং থাকে বিচারাধীন থাকে, মুলতুবি থাকে তখন আসামিকে গ্রেপ্তার করে না। আমাদের স্পষ্ট কথা- দুদকের এই মামলা প্রধান বিচারপতির আদালতে মুলতুবি রয়েছে।... এই পর্যায়ে আইনের বিধান মোতাবেক এবং রীতি অনুসারে গ্রেপ্তার করতে পারে না।”

মির্জা আব্বাসকে পলাতক বলায় অ্যাটর্নি জেনারেলের সমালোচনা করেন সুপ্রিম কোর্ট বারের সভাপতি খন্দকার মাহবুব। 

তিনি বলেন, “শব্দটি উনি নতুন শুনেছেন। ফিউজিটি কারা? যখন ওয়ারেন্ট ইস্যু হল, আসামি পাওয়া যাচ্ছে না, পুলিশ এসে রিপোর্ট দিল আসামি পাওয়া যাচ্ছে না, তখনও কিন্তু নোটিস দেওয়া হয় আদালতে হাজির হওয়ার জন্য। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তারপরও যদি হাজির না হয়, তখন অনুপস্থিতিতে বিচার হয়। ফিউজিটিভ তখনই বলা হয়, যখন বিচার কাজ শুরু হয়ে গেলে।”

বর্তমান প্রেক্ষাপটে পুলিশ যদি মির্জা আব্বাসকে ‘গ্রেপ্তার বা হয়রানি’ করে, তা আইনের ‘চরম বরখেলাপ’ হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

খন্দকার মাহবুব বলেন, মির্জা আব্বাসের বিরুদ্ধে ‘বহু’ মামলা হয়েছে। এখন মামলার হিসাব রাখার জন্যই ‘লোক রাখা’ প্রয়োজন।

আইনজীবী কোনো সংখ্যা না বললেও বিএনপি নেতা আব্বাস সিটি নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার জন্য দেওয়া হলফনামায় ‘আগে ২৪টি এবং বর্তমানে ৩৭টি’ ফৌজদারী মামলা থাকার তথ্য দিয়েছেন।