প্রজন্মের বসন্তে

পহেলা ফাল্গুন আসতে এখনো কয়েক দিন বাকী, কিন্তু শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে বসন্ত এসে গেছে এখনি। এই বসন্ত নবজাগরণের, এই বসন্ত ৪২ বছর ধরে চাপা পড়ে থাকা মানুষের প্রাণের দাবির, এই বসন্ত যুদ্ধাপরাধীদের জঞ্জাল সরানোর প্রত্যয়ে জেগে ওঠা নির্ভীক তরুণ প্রজন্মের। প্রজন্মের এই বসন্ত এখন সেøাগানে মুখরিত, প্রতিবাদী গানে এখানে সবার কণ্ঠ উচ্চকিত, কবিতার দৃপ্ত উচ্চারণে এখানে সবাই প্রদীপ্ত, শিল্পীদের তুলিও এখানে প্রতিরোধের ভাষায় রঞ্জিত। আন্দোলন ক্ষেত্র এখন পথনাটকের মঞ্চ, আন্দোলনের কর্মীরা এখন মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রের ফেরিওয়ালা। শাহবাগ থেকে টিএসসি- গণমঞ্চের এই আন্দোলনকে জাগিয়ে রাখতে তাই দিন রাত বিভিন্ন অঙ্গনের কর্মীরা অব্যাহত রাখছেন তাদের সাংস্কৃতিক নানা কর্মকা-।

সেঁজুতি শোণিমা নদী বিনোদন ডেস্ক বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকমবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 9 Feb 2013, 11:03 PM
Updated : 9 Feb 2013, 11:03 PM

‘শাহবাগ প্রতিবাদ’ এর শুরু ৫ ফেব্রুয়ারির দুপুর থেকে; আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল ‘মিরপুরের কসাই’ খ্যাত যুদ্ধাপরাধী কাদের মোল্লার অপরাধের শাস্তি হিসেবে ফাঁসি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদ-ের রায় দেওয়ার পর থেকেই সারা দেশের মতো সামাজিক মাধ্যমগুলোতেও দেখা যায় ক্ষুব্ধ মানুষের প্রতিক্রিয়া। সেই প্রতিক্রিয়া থেকেই ব্লগার্স অ্যান্ড অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট সোসাইটি ঘোষণা দেয় শাহবাগ চত্বরে এসে তাদের প্রতিবাদ জানানোর। মুহূর্তের মধ্যেই ওই প্রতিবাদের আহ্বান ছড়িয়ে পড়ে তরুণ সমাজের মধ্যে এবং তারাও দল বেঁধে এসে যোগ দিতে থাকে যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবির এই অবস্থান কর্মসূচিতে। মঙ্গলবার বিকেল থেকেই শাহবাগে আসতে থাকা জনতার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাগিয়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্রের প্রদর্শনী শুরু করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চলচ্চিত্র সংসদ (ডিইউএফএস) এর তরুণরা। রাতভর বিশাল এক স্ক্রিনে সবার জন্য উন্মুক্ত ওই প্রদর্শনীতে তারা দেখান একাত্তরে শহীদ বুদ্ধিজীবী চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’, প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের প্রামাণ্যচিত্র ‘মুক্তির গান’ ও ‘নরসুন্দর’ এবং প্রয়াত কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’। আন্দোলনের চারদিন ধরেই প্রদর্শনীর এই আয়োজন অব্যাহত রেখেছেন তারা। প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে ভোররাত পর্যন্ত চলতে থাকা এই আয়োজনে এরইমধ্যে তারা দেখিয়ে ফেলেছেন অনেকগুলো সিনেমা এবং ডকুমেন্টারি। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’, নাসিরউদ্দীন ইউসুফের ‘একাত্তরের যীশু’, ‘গেরিলা’, চাষী নজরুল ইসলামের ‘ওরা এগারো জন’, ফাকরুল ইসলামের প্রামাণ্য চিত্র ‘আলবদর’, কাওসার আহমেদের প্রামাণ্যচিত্র ‘সে রাতের কথা বলতে এসেছি’ ইত্যাদি।

জাদুঘরের পাশে একইধরনের চলচিত্র প্রদর্শনী মঙ্গলবার থেকেই একযোগে চালিয়ে যাচ্ছে ম্যুভিয়ানা, চলচ্চিত্রম্, এমসিজে ফিল্ম ক্লাব এবং স্ট্যামফোর্ড স্টুডেন্টস সিনে ফোরামের মতো চলচ্চিত্র সংগঠনগুলো। তাদের এই প্রদর্শনী প্রতিদিন সন্ধ্যা সাতটা থেকে শুরু হয়ে চলছে ভোররাত পর্যন্ত।   

সাংস্কৃতিক সংগঠন উদীচীও কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদ-ের প্রতিবাদে বুধবার বিকেলে এবং পরদিন প্রেসক্লাবের সামনে তাদের ‘প্রতিবাদী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ এর ডাক দেয়। পরে ব্লগারদের অবস্থান জানতে পেরে বুধবারের অনুষ্ঠান সমাপ্ত করেই মিছিল করে শাহবাগের গণমঞ্চে এসে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করেন তারা। গত ক’দিন ধরে সেখানেই নিজেদের প্রতিবাদী গান, আবৃত্তি এবং পথনাটক প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই আন্দোলনে সক্রিয় আছেন তারা।

এব্যাপারে সংগঠনটির সহ সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন জানান, ‘রায় জানতে পেরে ঐ দিনই আমরা আমাদের প্রতিবাদ কর্মর্সূচি ঘোষণা করেছিলাম। পরে আমাদের ব্লগার বন্ধুদের অবস্থানের কথা জানতে পেরে তাদের সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করি আমরাও। গণসঙ্গীত, কবিতা আবৃত্তি এবং পথনাটক প্রদর্শনীর মধ্য দিয়ে কেবল শাহবাগ চত্বরেই নয়, টি এস সি এবং শহীদ মিনারে চলতে থাকা ‘পথনাটক’ উৎসবেও আমরা আমাদের প্রতিবাদ ব্যক্ত করছি। আমাদের নাটক বিভাগের কর্মীদের পথ নাটক ইহা একটি নাটক এর বেশ কয়েকটি প্রদর্শনী হয়েছে এই ক’দিনে। এভাবে আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে দিনরাত আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি।’

পথনাটকের মাধ্যমে আরও কয়েকটি নাট্যসংগঠন এই আন্দোলনে তাদের সংহতি প্রকাশ করেছে। এ ব্যাপারে প্রাচ্যনাট থেকে বাকার বকুল জানান, ‘বুধবার থেকে প্রাচ্যনাট এই আন্দোলনের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। শাহবাগে প্রতিদিন রাত ১০ টার পর ‘দড়ি পাকা’ নামের একটি পথনাটকের প্রদর্শনী করা হচ্ছে। নাটকটিতে দেখানো হয় কাদের মোল্লার ফাঁসির বদলে যাবজ্জীবনের রায় হওয়ায় বিক্ষুব্ধ জনতা নিজেরাই তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর জন্য দড়ি পাকাতে শুরু করে। নাটকটির একপর্যায়ে দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ করা হয়; দর্শকদের প্রতিক্রিয়ায় বেরিয়ে আসে, তারা এই রায় মানেন না; পারলে এখনই কাদের মোল্লাকে শাহবাগে এনে ফাঁসিতে ঝোলাতে চান তারা।’

এছাড়াও নাট্যধারা, পালাকারের মতো নাট্যসংগঠন আন্দোলনে যোগ দিয়েছে। তারা তাদের নাটকের পরিচিত গানের সুরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি জানিয়ে নিজেদের প্রতিবাদ প্রকাশ করছে। আবৃত্তি সংগঠন জিয়নকাঠিও যোগ দেয় এই আন্দোলনে।

এদিকে মঙ্গলবার রাত থেকেই ঢাকা বিশ্বদ্যিালয়ের চারুকলা অনুষদের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীরা রং-তুলিকে অস্ত্র হিসেবে নিয়ে যোগ দেন এই আন্দোলনে। চারুকলার শিক্ষার্থীরা বুধবার সকাল দশটা থেকেই রোড পেইন্টিং এবং ব্যাঙ্গচিত্রের ব্যানার আঁকার মাধ্যমে শুরু করেন তাদের প্রতিবাদ। অনুষদের সব বিভাগের নতুন এবং পুরোন ছাত্রছাত্রীদের এই রোড পেইন্টিং এবং ব্যাঙ্গচিত্রগুলোতে উঠে এসেছে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতি বন্ধের দাবি।

এব্যাপারে চারুকলা অনুষদের ‘ভাস্কর্য বিভাগ’ এর ১২ তম ব্যাচ (সম্মান) এর ছাত্র মানবেন্দ্র ঘোষ জানান, ‘কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে মঙ্গলবার গভীর রাত পর্যন্ত প্রতিবাদ হয়েছে চারুকলায়। এরপর বুধবার সকাল দশটা থেকেই আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানাতে শুরু করি ব্যানার, ক্যানভাসে ব্যাঙ্গচিত্র আঁকা এবং পরবর্তীতে রোড পেইন্টিং এর মাধ্যমে। শিক্ষার্থীদের দল দুই অংশে এই রোড পেইন্টিং শুরু করে; প্রথমে শাহবাগ চত্বর থেকে চারুকলা পর্যন্ত, অন্যদিকে চারুকলা থেকে টিএসসি পর্যন্ত করা হয় এসব রোড পেইন্টিং। আমাদের তাৎক্ষণিক আয়োজনে করা এসব রোড পেইন্টিং এ উঠে এসেছে রাজাকারদের ফাঁসির দাবি। এছাড়াও আমাদের কার্টুনিস্টরা একটি বড় ব্যানারে এঁকেছেন যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাঙ্গ চিত্র। এটি এখন চারুকলার সীমানা দেয়ালে টাঙানো আছে। এছাড়াও আন্দোলনের দিনগুলোতে মশাল মিছিল, ঝাড়– মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানিয়ে আসছি।’

মহাসমাবেশের দিন ৮ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই ‘শিল্পী সমাজ’ এর পক্ষ থেকে চারুকলার সামনে স্থাপন করা হয় একটি প্রতিবাদ মঞ্চ। এতে যোগ দেন দেশবরেণ্য শিল্পী কাইয়ূম চৌধুরী, জামাল আহমেদ, নেসার হোসেন,শেখ আফজালসহ তরুণ প্রজন্মের অনেক শিল্পী। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মুক্তিযোদ্ধারাও ওই মঞ্চে দাঁড়িয়ে নিজেদের যুদ্ধের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের সূচনা এবং কালক্রমে তার বিবর্তন নিয়ে শিল্পী নেসার হোসেন বলেন, ‘একসময়, দেশ যখন শাসিত হচ্ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের সরকার দ্বারা, তখন আমরা অর্থাৎ শিল্পী সমাজই কিন্তু এই আন্দোলনের শুরু করেছিলাম। সেই প্রতিকূল সময়ে আমাদের শৈল্পিক এবং সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়েই কিন্তু পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের একটি দল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি নিয়ে ক্ষমতায় আসে। তারপরও যখন আমরা দেখি যে আমাদের সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি, এবং বিচার বিভাগের স্বচ্ছতা নিয়ে আমাদের ভেতরে যে সন্দেহ ছিলো, এই রায়ের মাধ্যমে সেটাই সত্যি প্রমাণিত হয়েছে, তখন আসলেই আমরা প্রতারিত বোধ করছি। আর তাই সেই সময়ের মতো এখনো আমরা এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি।’

শিল্পী সমাজের এই মঞ্চে জাতীয় সঙ্গীতসহ অনেক শিল্পীই গান পরিবেশন করেন। একপর্যায়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত ‘ও আমার দেশের মাটি’ গেয়ে শোনান অভিনয়শিল্পী এবং চারুকলার সাবেক ছাত্রী বিপাশা হায়াত। তিনি বলেন ‘আপনাদের আন্দোলন থেকে ফাঁসির দাবির যে ডাক এসেছে তা বৃথা যাবেনা। আপনাদের এ ডাক এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে।’

ঐ দিন সন্ধ্যা ছয়টায় শুরু হয় ফ্যাশন হাউজ ‘দেশাল’ আয়োজিত ‘আমার সোনার বাংলা’ নামের কনসার্ট। এতে পরিবেশন করে গানের দল ‘জলের গান’। দলটির অন্যতম প্রধান সদস্য রাহুল আনন্দ তাদের গান ‘বৃষ্টি পড়ে টাপুর-টুপুর’ গানের আগে শাহবাগ প্রতিবাদের সঙ্গে সবাইকে সংহতি প্রকাশ করার আহ্বান জানান।

এছাড়াও বিকেল পাঁচটা থেকে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত হয় ‘আমার মলয়ের গান’ নামের একটি কনসার্ট। এতে অংশ নেয় ব্যান্ডদল ‘মেঘদল’, ‘চিরকূট’, ‘চিৎকার’, ‘সহজিয়া’। কনসার্টটি থেকে বিভিন্ন গানের মাধ্যমে সংহতি প্রকাশ করা হয় আন্দোলনের সঙ্গে।

এছাড়াও ‘তীরন্দাজ’, ‘জয়ধ্বনি সাংস্কৃতিক সংগঠন’ এর মতো আরো অনেকে সংগঠন পুরোটা সময় জুড়েই শাহবাগে অবস্থান করছে তাদের প্রতিবাদী গান এবং কবিতার মধ্য দিয়ে।

শুক্রবার, মহাসমাবেশের দিন ‘জিপসি বাইকার্স’ নামের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগের ছয় তরুণ সাইক্লিস্ট তাদের প্রতিবাদ জানান এক অভিনব পন্থায়। সারা গায়ে সাদা রং মেখে বুকে ও পিঠে ‘জয় বাংলা’, ‘ফাঁসি ফাঁসি ফাাঁসি চাই’- ইত্যাদি স্লোগান লিখে রাজাকারের কুশপুত্তলিকাকে দড়িতে ঝুলিয়ে রাস্তায় টেনে নিয়ে পুরো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস একযোগে প্রদক্ষিণ করেন তারা। তাদের এই ব্যতিক্রমি কর্মকা- দৃষ্টি আকর্ষণ করে অনেকেরই, বিক্ষুব্ধ জনতার অনেকেই কুশপুত্তলিকাগুলোকে লাথি এবং ঝাড়– পেটা করে।

গান, কবিতা, চলচ্চিত্র, পথ নাটক, চিত্রাঙ্কন, পারফর্মিং আর্ট, কনসার্ট- এর সবকিছুর মধ্য দিয়েই দিনে দিনে আরো বেগবান হচ্ছে ‘শাহবাগ প্রতিবাদ’। প্রতিদিন সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে একই চিত্র। এভাবেই প্রতিবাদের আগুনে রঙিন হচ্ছে শাহবাগ বসন্ত; প্রজন্মের এই বসন্তে সবাইকে আমন্ত্রণ।