আপনার ব্যাটিং নিয়ে যত কাঁটাছেড়া হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে একমাত্র মোহাম্মদ আশরাফুল ছাড়া আর কারও ব্যাটিং নিয়ে মনে হয় এতটা হয়নি। আপনি মেরে খেললে কথা উঠেছে, ধরে খেললে কথা উঠেছে। তো এসব আলোচনা-সমালোচনা, এসব ব্যাপার কি আপনার ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলেছে?
তামিম: আমি ভাবতাম এসব। একটা সময় আমার মনে হতো, পৃথিবীর কোনো দেশের মিডিয়ার উচিত নয় আমরা কিভাবে খেলছি বা খেলব, এসব বলা বা লিখা। কে কিভাবে ব্যাটিং করবে বা বোলিং করবে, এটা তার নিজের ব্যাপার।
কাঁটা ছেড়ার কথা যেটা বললেন, আপনার মনে আছে কিনা…২০০৯ বা ২০১০ সালে যখন আমি খুব ভালো খেলছিলাম, তখন প্রত্যেকটি ভালো ইনিংসের পরই আমি প্রেস কনফারেন্সে বলতাম, ‘আমি যেভাবে ব্যাটিং করি তাতে রান পেলে দেখতে খুব ভালো লাগবে। কিন্তু আউট হলে খুব বাজে লাগবে। এটা একটু সবার মাথায় থাকতে হবে।’ কারণ আমি জানতাম যে ক্রিকেটে খারাপ সময় আসবেই।
এসব কথাবার্তা তাহলে আপনার ব্যাটিংকে প্রভাবিত করেছে?
তামিম: যদি করে থাকে, সেটার দায় আমার। মিডিয়ার কথা শুনে খেলা বদলে ফেললে সেটা কোনো কাজের কথা হলো না। একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা আপনাকেই প্রথম বলছি, গত ২ বছরে আমি একটা ইনিংসও ব্যাটিং করে উপভোগ করতে পারিনি। শ্রীলঙ্কায় সেঞ্চুরি করেছি, জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে গত বছর দুটি সেঞ্চুরি করেছি, আরও বেশ কিছু ৭০-৮০-৯০ ছিল, বিশ্বাস করুন, একটা ইনিংসও আমি উপভোগ করতে পারিনি। কারণ, আমি নিজের মতো খেলিনি বা খেলতে পারিনি।
ব্যাটিংয়ের ধরন প্রসঙ্গে বিরেন্দর শেবাগের উদাহরণ আপনি অনেকবার দিয়েছেন আমাদের সামনে। শেবাগ কিন্তু কখনো কারও কথায় কান দেননি, নিজের মতোই খেলে গেছেন। আপনারও সেটাই করা উচিত ছিল না কি?
তামিম: হয়ত ওই লেভেলের আত্মবিশ্বাস আমার ছিল না! হয়ত ওই মানসিক শক্তি ছিল না যে ঠিক করব, ‘যা কিছুই হোক, আমি এভাবেই খেলব।’ দেখা গেছে, যখন আক্রমণাত্মক খেলেছি, তখন শুধু আক্রমণই করেছি। ধরে খেললে আবার পুরো খোলসে ঢুকে গেছি। ব্যালান্সটা করতে পারিনি। হয় ফার্স্ট গিয়ার অথবা ফোর্থ গিয়ার। মাঝামাঝি ছিল না। কিছু একটা মিসিং ছিল।
এখন সেটা খুঁজে পেয়েছেন?
তামিম: হ্যাঁ। পাকিস্তান সিরিজে আমি ডাবল সেঞ্চুরি করেছি, আরও দুটি সেঞ্চুরি করেছি। কিন্তু সেটার চেয়েও বড় হলো, আবার নিজের মত ব্যাটিং করতে পেরেছি। ব্যাটিংয়ের আনন্দটা খুঁজে পেয়েছি। প্রত্যেকটা ইনিংস আমি উপভোগ করেছি, এমনকি টি-টোয়েন্টিতে ১৪ রানের ইনিংসটাও। কারণ নিজের মত খেলতে পেরেছি। ছেলেবেলা থেকে আমি যেভাবে ব্যাটিং করেছি, করতে চেয়েছি বা করতে ভালোবাসি, সেটাই এই সিরিজে করতে পেরেছি। এটাই সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি।
ওই ‘মিসিং’ ব্যাপারটা কিভাবে হঠাৎ খুঁজে পেলেন?
তামিম: এই প্রশ্নটা অনেকেই করেছে, করছে। আপনাকে বলি, পাকিস্তান সিরিজে যে প্রস্তুতি ম্যাচটি খেললাম, ওখানেই আমি নিজেকে খুঁজে পেয়েছি। অবাক হতে পারেন, কারণ ওই ম্যাচে আমি মাত্র ৯ রান করেছিলাম। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ৯ রানের ইনিংসটাই আমাকে বদলে দিয়েছে। দুটি চার মেরেছিলাম, এমন টাইমিং হলো, সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি নিজের মত ব্যাটিং করতে পারছি। আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। বললে অনেকেই হাসতে পারে ভেবে কাউকে বলিনি। আপনাকেই প্রথম বলছি, ওই ৯ টা রান আমাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে।
এখন কি সেই আত্মবিশ্বাস ও মানসিক শক্তি হয়েছে যে এভাবে ব্যাটিং করে যাবেন?
তামিম: বলছি না, সেই মানসিক শক্তি হয়ে গেছে, কিন্তু আমি চেষ্টা করছি। আমার পরীক্ষাটা হবে, যখন আবার খারাপ সময় আসবে। ক্রিকেটে খারাপ সময় আসবেই। আমি জানি, তখন আবার সমালোচনা হবে, ব্যাটিং নিয়ে কাটাছেঁড়া হবে। ওই সময় যদি নিজেকে ঠিক রাখতে পারি, তাহলে হয়তো বোঝা যাবে যে মানসিক শক্তি বেড়েছে। কয়েক দিনে বা একটা সিরিজে এটা হয়ে যায় না। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি। অনেকের সঙ্গে কথা বলেছি। নিজেও কাজ করে যাচ্ছি।
কার কার সঙ্গে কথা বলেছেন?
তামিম: আমাদের মনোবিদ ছিল ফিল (ড. ফিল জোনসি), তার কয়েকটা কথা আমার খুব কাজে লেগেছে। কোচের সঙ্গে বলেছি। চন্ডিকার একটা দারুণ গুণ হলো, কেউ নিজের মতো খেলতে গিয়ে আউট হলে কিছু বলে না। আমি ছক্কা মারতে গিয়ে আউট হলে কিছু বলবে না। অন্যরকম খেলে আউট হলে বলবে। সুজন ভাই (খালেদ মাহমুদ) মেন্টালি অনেক টাফ ক্রিকেটার ছিলেন। সুমন ভাই (হাবিবুল বাশার)..উনারা এমন একটা সময় খেলেছেন, দেশের ক্রিকেটের অনেক কঠিন সময় ছিল। উনাদের সঙ্গে কথা বলেছি।
দেশের বাইরে?
তামিম: গত বছর লর্ডসের শতবর্ষ পূর্তি ম্যাচে যখন খেলতে গেলাম, তখন শচিন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, রাহুল দ্রাবিড়ের সঙ্গে কথা বলেছি। সবচেয়ে ভালো উত্তর দিয়েছিলেন আমাকে কেভিন পিটারসেন। প্র্যাকটিসের সময় গিয়ে কথা বলেছিলাম, ওর ক্যারিয়ারেও অনেক উত্থান-পতন, বিতর্ক। কেপি হাত দিয়ে বাতাসে বৃত্ত এঁকে আমাকে বলল, ‘তামিম, আমাদের ক্যারিয়ার এই বৃত্তের মত একটা চক্র। তুমি ভালো খেলবে, খারাপ খেলবে, অতিরিক্ত ভালো খেলবে, আবার অতিরিক্ত খারাপ খেলবে। আবার ভালো খেলবে, আবার খুব খারাপ খেলবে। তুমি টেন্ডুলকার হও, লারা হও, কেপি হও বা তামিম, এই চক্র তোমার আসবেই। তুমি যদি ভালো ক্রিকেটার না হতে, আজ এখানে আমাদের পাশে থাকতে না। তোমার ব্যাটিং তো আমি দেখেছি, জানি তুমি কি করতে পারো। নিজের সামর্থ্যে বিশ্বাস রাখো।’ ওর কথাগুলো আমি এখন সবসময়ই মনে রাখি।
১৮০-এর ঘর থেকে তিন ছক্কায় দুইশ'…এখন ভাবলে কেমন লাগে?
ট্রিপল সেঞ্চুরি করার স্বপ্ন দেখেন?
এক সময় আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যাটিং নিয়ে খাটতেন। এখনও কি অতটা পরিশ্রম করেন?
তামিম: একটা সময় আমি অনেক বেশি ব্যাটিং প্র্যাকটিস করতাম। আবার কখনও অনেক কম করেছি। বুঝে উঠতে পারিনি ব্যালান্সটা কিভাবে করা উচিত। এবার অস্ট্রেলিয়া গিয়ে গ্রেগ চ্যাপেলের সঙ্গে কথা বলেছি এটা নিয়ে। চন্ডিকার সঙ্গে কথা বলি। ওরা বলেছে, প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ব্যাটিং করা আসলে লাভ হবে না। পণ্ডশ্রম। নিজেকেই জানতে হবে, কতটুকু ব্যাটিং প্র্যাকটিস দরকার। এখন তাই আমি স্পেসিফিক সমস্যা ধরে কজি করি। ব্যালান্স করার চেষ্টা করি।
এক সময় আপনি দারুণ ফিল্ডার ছিলেন। বাউন্ডারিতে এমন কিছু ক্যাচ আছে আপনার, বাংলাদেশের ইতিহাসেই সেরাগুলোর মধ্যে থাকবে। কিন্তু এখন আপনার ফিল্ডিং প্রশ্নবিদ্ধ হয় প্রায়ই…
২০১০ সালে যেভাবে খেলেছেন, বাংলাদেশের ক্রিকেটে তো বটেই, বিশ্ব ক্রিকেটেই আপনাকে ভাবা হচ্ছিল ভবিষ্যৎ মহাতারকা। ২০১৫ সালে এসে সেই হিসাব মিলছে না। আপনার নিজের কি মনে হয়?
তামিম: অবশ্যই আমার হিসাবও মেলে না। লক্ষ্য যা ছিল বা যা অর্জন করতে চেয়েছি, তার ধারে কাছে যেতে পারিনি। বড়জোর পঞ্চাশ ভাগ পেরেছি বলা যায়। তবে সময় শেষ হয়ে যায়নি। পরের দু'বছর খুব ভালো খেলতে পারলে হয়ত সেই জায়গাটায় যেতে পারি।
সেই জায়গাটা কোথায় বা কি? বিশ্বসেরাদের একজন হওয়া কিংবা এমন কিছু?
তামিম: প্রথম দেশের ক্রিকেটে আরও ভাল জায়গায় নিজেকে নিয়ে যাওয়া। যেমন বাংলাদেশের ক্রিকেট বললেই সাকিবের নাম আসে। গত কিছু দিনে মুশফিকের নামও আসছে। আমি চাই, ওদের পাশে আমার নামও আসুক। বিশ্ব ক্রিকেটেও এমন কিছু করতে চাই যে লোকে মনে রাখবে। আরও সুনির্দিষ্ট কিছু লক্ষ্য আছে আমার। সেগুলো নিজের কাছেই রাখতে চাই।
আপনার বয়স এখন ২৬। ৩০ বছর বয়সে নিজেকে কোথায় দেখতে চান? ৩৫ বছর বয়সে কোথায় দেখতে চান?
তামিম: নিজের লক্ষ্যের কথা নিজের মাঝেই রাখতে চাই। দলের কথা বলি। আমি যখন ২৮-৩০-৩৩ হব, সাকিব-মুশফিক-রিয়াদের বয়সও তখন এরকম থাকবে, অনেক দলেই এরকম তিন-চারজন ছিল বা থাকে পুরো খেলাটা নিয়ন্ত্রণ করে। নিজেরা খেলে, অন্যদের খেলায়। সাঙ্গাকারা-জয়াবর্ধনে যেমন নিজেরা অনেক রান করেছে, দলকে জিতিয়েছে, তরুণদেরও গড়ে তুলেছে। আমরা যদি ওদের কাছাকাছি বা অর্ধেকও করতে পারি, তাহলেও দারুণ কিছু হবে বাংলাদেশের জন্য।
টেস্ট দলের সহ-অধিনায়ক আপনি, নেতৃত্ব দেওয়ার স্বপ্ন দেখেন?
তামিম: ম্যাচের সময় মুশফিকের চোটের কারণে দু'বার নেতৃত্ব দিলাম মাঠে। একবার সাঙ্গাকারা ট্রিপল সেঞ্চুরি করল (গত বছর চট্টগ্রামে), এবার হাফিজ ডাবল সেঞ্চুরি করল। আমার অধিনায়ক ভাগ্যই খারাপ! বলতে গেলে, আমি এখনও শিখছি। মুশফিকের কাছ থেকে শিখি। সাকিব খুব চতুর অধিনায়ক, ওর কাছ থেকে শিখি। মাশরাফি ভাইকে দেখে মাঠের বাইরের ম্যানেজমেন্ট শিখছি। এখনও সেভাবে ইচ্ছে নেই নেতৃত্বের। কে জানে, ১-২ বছর পর ইচ্ছে হতে পারে!
ক্যারিয়ার শেষে দেশের ক্রিকেটকে কোথায় দেখতে চান?
তামিম: অসম্ভব স্বপ্ন আমি দেখতে চাই না। কে জানে হয়ত, এক নম্বরে উঠতে পারি আমরা। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ওয়ানডেতে যদি দলকে র্যাঙ্কিংয়ের ৪-৫ নম্বরে নিতে পারি, টেস্টে অন্তত ৬ নম্বরে, তাহলেই যথেষ্ট খুশি থাকব।
প্রথম পর্ব: চোট আর সমালোচনা জয়ী 'আবেগী' তামিম