বিএনপিকে ‘রাজাকারদের দল’ আখ্যায়িত করে জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী ছিলেন কি না- সে প্রশ্ন তুলেছেন সজীব ওয়াজেদ জয়।
Published : 14 Nov 2014, 07:39 PM
শুক্রবার এক আলোচনায় তিনি বলেন, “হ্যাঁ, যারা রাজাকার অবশ্যই তাদের বিচার হতে হবে, তারা যুদ্ধাপরাধী। তবে আমি প্রশ্ন করব- যারা তাদের সমর্থক, তারা কি স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাস করতে পারে?
“আমি প্রশ্ন করব, যে ব্যক্তি এই যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফেরত এনেছে সে কি মুক্তিযোদ্ধা হতে পারে? কোনমতেই না।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরোধিতাকারী জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি স্বাধীনতার পর নিষিদ্ধ থাকলেও সাবেক সামরিক শাসক জিয়াউর রহমান দলটিকে রাজনীতিতে ফেরার সুযোগ করে দেন।
দলটির ছয় শীর্ষ নেতাকে ইতোমধ্যে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের দায়ে সাজা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল, আর বহু প্রত্যাশিত এই বিচার শুরু হয় ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরে।
আলোচনায় উপস্থিত বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার প্রতিনিধিদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছেলে জয় প্রশ্ন রাখেন, “যারা রাজাকারদের সঙ্গে রাজনীতি করে তারা কি রাজাকার নয়? অবশ্যই। সত্যি কথা হচ্ছে বিএনপি হচ্ছে রাজাকারদের দল। তারা যদি প্রমাণ করতে চায় তারা রাজাকারের দল নয়; তাহলে এই রাজাকারের দলের সাথে জোট ছেড়ে আসুক।”
ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যারা যুদ্ধাপরাধে লিপ্ত ছিল, দালাল আইনে তাদের বিচার চলাকালীন সময়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। দালাল আইনে আটক ১১ হাজার স্বাধীনতাবিরোধী এরপর জিয়ার আমলে মুক্তি পেয়ে যান।
এরপর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়।
জয় বলেন, “এতোবছর পরে হলেও বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। আওয়ামী লীগ যতোদিন ক্ষমতায় থাকবে তাদের বিচার সম্পন্ন হবে, বিচারের রায় সম্পন্ন হবে।”
আর এজন্য ‘যে দল বাংলাদেশে বিশ্বাস করে’ তাদেরকেই ক্ষমতায় রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষার কারণ ব্যাখ্যায় ১৯৭০ সালের নির্বাচনের প্রসঙ্গ আনেন জয়, যে নির্বাচনে দুটি বাদে সব আসন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ।
জয় বলেন, “সেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনেও কিন্তু এই বাঙালি এই বাংলাদেশের সকল মানুষ আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি, বেশিরভাগ দিয়েছে। তবে এক শ্রেণির মানুষ আওয়ামী লীগকে, একমাত্র বাঙালির রাজনৈতিক দলকে তারা ভোট দেয়নি। তারা সেই পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলকে ভোট দিয়েছে।
“তারা কারা? সেইদিকে আমাদের একটু নজর দিতে হবে। সেইদিকে নজর না দিলে, তাদের আইডেন্টিফাই না করলে আমরা বুঝবো না কেন আমাদের ৪৩ বছর লেগেছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে।”
সজীব ওয়াজেদ বলেন, “১৯৭০ সালে কারা সেই পাকিস্তানি দলকে ভোট দিয়েছে? এক শ্রেণি ছিল তারা তখন খুব ভালো ছিল। তাদের হাতে টাকা-পয়সা ছিল। পাকিস্তানিদের সঙ্গে ব্যবসা করত। পাকিস্তানে থাকাই তাদের জন্য ব্যক্তিগতভাবে লাভ ছিল। তার জন্য তারা কোনো দিন স্বাধীনতা চায়নি।
“বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা আবার পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে ফিরে যেতে চেয়েছিল। আরেক শ্রেণি, সেই শ্রেণি এখনও আছে- অর্থের কারণে নয়, ক্ষমতার কারণে তাো ষড়যন্ত্রে লেগেছিল।”
ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
বাঙালির স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতাকে হত্যার পর যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসেন তাদের সুবিধাবাদী আখ্যায়িত করে বঙ্গবন্ধুর নাতি জয় বলেন, “পঁচাত্তরের পর সেই স্বৈরাচারের সৃষ্টি করা একটি রাজনৈতিক দল এই বিএনপি; সেই দলে গিয়ে যোগ দেয়। ক্ষমতার জন্য, অর্থ কামাই করার জন্য, নিজেদের ভালো রাখার জন্য, দেশের জন্য নয়।”
বিভিন্ন সময় নিজেদের নিরপেক্ষ দাবি করে বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া ব্যক্তিদের সমালোচনা করে জয় বলেন, “এখানে নিরপেক্ষতার নামে আমাদের এক শ্রেণির মানুষ যুদ্ধাপরাধী এবং যুদ্ধাপরাধীদের যারা সমর্থন করে তাদের স্বাধীনতার পক্ষের দলের সঙ্গে এক পাল্লায় ফেলছে। এটাই হচ্ছে আমাদের দুঃখের বিষয়।”
ঢাকার একটি হোটেলে সুচিন্তা ফাউন্ডেশন আয়োজিত এই আলোচনায় অর্থনীতিবিদ কাজী খলিকুজ্জামান আহমদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরীন আফরোজ ও শিল্পী হাশেম খানও বক্তব্য দেন। সঞ্চালনায় ছিলেন সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের আহ্বায়ক মোহাম্মদ এ আরাফাত।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অনুষ্ঠানে দেশের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা নিয়েও কথা বলেন তরুণ তথ্য-প্রযুক্তিবিদ সজীব ওয়াজেদ জয়।
তিনি বলেন, “আমাদের দেশের ইতিহাসে অনেক কালো দিন গেছে, অনেক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমরা এ পর্যন্ত এসেছি। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। একাত্তর সালে বিশ্বের মহান একটি দেশ সেই পাকিস্তানিদেরকে অস্ত্র দিয়ে, প্লেন দিয়ে, ট্যাংক দিয়ে আমাদের স্বাধীনতাকে দাবানোর চেষ্টা করেছিল। আমাদেরকে ঠেকাতে পারেনি।”
বাংলাদেশ এখন আর ‘কোনো দেশকেই’ ভয় পায় না বলেও মন্তব্য করেন জয়।
তিনি বলেন, “এখন আমাদের কোনো দেশকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। আমরা নিজেদের পায়ে দাঁড়িয়েছি, নিজেদের উন্নয়ন আমরা নিজেরা করছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করছি। আমরা বাঙালি, আমাদেরকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আর অন্যান্য দেশ কি বলে না বলে তাতে আমাদের কিচ্ছু যায় আসে না।”
জয় বলেন, “যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিল তখন হতাশ হয়ে অনেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করতো, এই যে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর এগিয়ে গেছে আমরা কেন পারি না? কারণ সেই সব দেশে যে দল স্বাধীনতা দিয়েছে, যে দল আসলেই সেই দেশের ওপর বিশ্বাস রাখে, সেই দেশের মানুষ সেই দলকে ক্ষমতায় রেখেছে ২০ বছর, ৩০ বছর, ৪০ বছর। সেই দল দেশের উন্নয়ন করতে পেরেছে। দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পেরেছে।
“বাংলাদেশে আমরা সেই সুযোগটা পাইনি। তবে এতোবছর পরে হলেও আমার মনে হয়, বাংলাদেশের মানুষ সেই সুযোগ দিয়েছে। আমার বিশ্বাস এখন আমরা যে পথে এগুচ্ছি, গত পাঁচ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে, আর এই পাঁচ বছরে যে উন্নয়ন করতে পারবো এরপরে বাংলাদেশের আর পিছিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ থাকবে না।”
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার
যুদ্ধাপরাধের বিচার বিষয়ে সরকারের অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ নেই বলে মনে করেন সজীব ওয়াজেদ।
ছবি: নয়ন কুমার/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
“জামায়াতকে যদি বাঁচাতেই হত তাহলে জন কেরি আর বান কি মুন ফোন করার পরেও ইলেকশনের কয়েকদিন আগেই কি আমরা কাদের মোল্লাকে ফাঁসি দিতাম? এই সাহস কার হত?”
সজীব ওয়াজেদ বলেন, “সুশাসনের জন্য প্রথম প্রয়োজন হচ্ছে একটি স্বাধীন আদালতের, যারা আইনগতভাবে রায় দেবে, স্বাধীনভাবে রায় দেবে। একটি আদালত যদি রায় দিয়ে থাকে সেখানে সরকারের কী করার আছে? সরকারের তো কিছু করার নেই।
“এটি আদালতের রায়। আমরা বলতে পারি যে এখানে ভূল হয়েছে, তবে বলতে পারি না যে ষড়যন্ত্র হয়েছে।”
অপপ্রচার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বিতর্কিত বক্তব্যের দিকে ইঙ্গিত করে জয় বলেন, “এমন এক একটি মিথ্যে কথা বলা হয় যেগুলো শুনে আমরা হাসি। আমরা বলি এই লোক কি পাগল হয়ে গিয়েছে যে, এরকম কথা বলছে। তবে এখানে একটু সতর্ক থাকতে হবে। তারা কিন্তু পাগল নয়, তাদের একটা উদ্দেশ্য আছে।
“আমরা যারা স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি তাদের সবসময় সত্যকে তুলে ধরতে হবে, মিথ্যাচারকে মোকাবিলা করতে হবে। আমাদের লাজুক হলে চলবে না।”
সংবাদপত্রে মতামত লেখকদেরও সমালোচনা করেন সজীব ওয়াজেদ।
“অনেকেই যারা সংবাদপত্রে এডিটোরিয়াল লেখেন, তাদের এডিটোরিয়ালে দেখা যায় যে, সরকারের এই ভূল হচ্ছে, কোনো কিছুই ভাল হচ্ছে না। আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, দেখেন গত পাঁচ-ছয় বছরে এতো উন্নয়নের কাজ হয়েছে, তারপরেও কিভাবে বলে ভূল হচ্ছে, ভাল হচ্ছে না, এটা খারাপ হচ্ছে, ওটা খারাপ হচ্ছে।
“আমি তাদের বলি, দেখেন বাংলাদেশ কোথায় ছিল পাঁচ-ছয় বছর আগে। দুর্নীতি, বিদ্যুতের অভাব, জঙ্গিবাদ- সেখান থেকে আজকে আমরা কোথায় চলে এসেছি। আজকে পাঁচ বছরের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি হচ্ছে দ্রুতগতির দিক থেকে চতুর্থ, পাঁচ বছরের মধ্যে দারিদ্রের হার আমরা অর্ধেক করে ফেলেছি। জঙ্গিবাদ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দিয়েছি।”