আল জাজিরাকে দেয়া ‍মুঈনুদ্দীনের সাক্ষাৎকার

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 July 2013, 07:18 PM
Updated : 3 Nov 2013, 02:00 PM

একাত্তরে জামায়াতের সহযোগী সংগঠন ছাত্রসংঘের নেতা চৌধুরী মুঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে ৪ জুন বুদ্ধিজীবী নিধনের অভিযোগে বিচারকাজ শুরু করার আদেশ দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর ২৪ জুন তার অনুপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করা হয়। অভিযোগ রয়েছে, বুদ্ধিজীবী নিধনের অপারেশন-ইন-চার্জ ছিলেন মুঈনুদ্দীন।

শনিবার কাতারভিত্তিক সম্প্রচার মাধ্যম আল জাজিরাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারের ওপর তার আস্থা নেই। তাই ট্রাইব্যুনালে তিনি হাজির হবেন না।

ওই সাক্ষাৎকারটি নেন আল জাজিরার জোনা হল। পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারটি হুবহু তুলে দেয়া হলো।

আল জাজিরা: তদন্ত সংস্থা আপনার বিরুদ্ধে বুদ্ধিজীবী হত্যার যে অভিযোগ এনেছে এ সম্পর্কে আপনার বক্তব্য কি?

মুঈনুদ্দীন: হ্যাঁ এটা সত্য যে আমি পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সমর্থন করেছিলাম। কিন্তু একটা সার্বভৌম রাষ্ট্রকে সমর্থন করা এক কথা আর অপরাধে যুক্ত থাকা ভিন্ন বিষয়। আমি ১৯৭১ সালে বা তার পর থেকে কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলাম না। মূলত, আমি এমনকি সামরিক পদক্ষেপেরও সমর্থক ছিলাম না এবং সামরিক হামলার পর আমি দলের পদও ছেড়ে দিয়েছি।

আল জাজিরা: আপনি তো আগে বলেছিলেন আদালতে উপস্থিত হয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবেন। এখন যে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে তার মুখোমুখি কি আপনি হবেন?

মুঈনুদ্দীন: না, কারণ সোজা কথা হলো বাংলাদেশের ওই ট্রাইব্যুনাল একটি ‘প্রহসন’ এবং তাদের পরিচালিত বিচার ‘লজ্জাজনক’। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অনেকেই এই বিচারের প্রক্রিয়া ও মান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ইকোনোমিস্টের অনুসন্ধানে স্পষ্টভাবে এতে দুর্নীতির বিষয়টি উঠে এসেছে। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা, প্রসিকিউশন দল, বিচারক ও বাইরের কর্মীদের মধ্যে সাংঘর্ষিক অবস্থানের কথাও প্রকাশিত হয়েছে, যা ভয়ানক। একইসঙ্গে আদালতের ওপর সরকারের মন্ত্রীদের হস্তক্ষেপের চেষ্টার কথাও প্রকাশিত হয়েছে। এটা একটা ক্যাঙ্গারু কোর্ট, প্রকৃত আদালত নয়। এ ধরনের বিচারের আদালতে কেউ-ই নিজেকে সমর্পণ করতে চাইবে না।

আল জাজিরা: আপনার সঙ্গে কী আদালতের কোনো ধরনের যোগাযোগ হয়েছে, অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানানো হয়েছে?

মুঈনুদ্দীন: মোটেই না। এটা অবাক করার ব্যাপার। এটা প্রহসন। আমি কখনো আমার পরিচয় গোপন করি নাই। যুক্তরাজ্যে আমি স্বচ্ছ জীবন যাপন করি। কমিউনিটির সদস্য হিসেবে আমি অনেকগুলো চ্যারিটি ও কল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত। আমি নিজেকে লুকিয়ে রাখিনি। আমি বুঝি না কেন তারা আমার কাছে ওগুলো পৌঁছাতে পারেনি।

আল জাজিরা: মুক্তিযুদ্ধের সময় কখনো কি আপনি আল বদর ব্রিগেডের সদস্য ছিলেন, যেটি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে এবং পাকিস্তানি সেনাদের পক্ষে গণহত্যা চালায়?

মুঈনুদ্দীন: না, আমি কখনোই আলবদর বা এ ধরনের কোনো সংগঠনের সদস্য ছিলাম না। আমি আগেই বলেছি যে, আমি সামরিক আক্রমণের পর আমার রাজনৈতিক সব পদ ছেড়ে দিয়েছি। আমি আমার সাংবাদিকতা পেশায় মনোযোগী ছিলাম। ১৯৭১ এর ৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত আমি আমার এই পেশায় নিযুক্ত ছিলাম। ফলে একজন সাংবাদিক হিসাবে আপনি জানেন, সাংবাদিকতা পেশায় একজন প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করে এ ধরনের কোনো কাজে যুক্ত থাকা সম্ভব না।

আল জাজিরা: আলবদর বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বানচাল করতে হিটলিস্ট তৈরি করে সাংবাদিক ও শিক্ষাবিদসহ বুদ্ধিজীবীদের হত্যার অভিযোগ সম্পর্কে সাংবাদিক হিসেবে আপনি কী জানেন?

মুঈনুদ্দীন: আমার কাছে এ ধরনের কোনো খবর নেই বা অন্য কারো কাছেই এ ধরনের খবর ছিলো না, যা স্বাধীনতার মাত্র দুদিন আগে ঘটেছিল। এর জন্য কারা দায়ী ছিল তা নিয়ে অনেক তত্ত্ব থাকলেও স্বাধীনতার আগে এটা নিয়ে কোনো প্রতিবেদন হয়নি। পরে অবশ্য নানা ধরনের বানানো প্রতিবেদন পত্রিকা ও অন্যান্য গণমাধ্যমে ছাপা হয়।

আল জাজিরা: আপনি বলেছেন যে, রাজনৈতিক অবস্থান থেকে আপনি মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছেন এবং পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। অবস্থানের কারণ ব্যাখ্যা করবেন কি?

মুঈনুদ্দীন: আমার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, পাকিস্তান একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। হ্যাঁ, সেখানে দোষ ছিল, বৈষম্য ও অসমতা ছিল পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে। কিন্তু ওই বিষয় রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা যেত। আলোচনা সংলাপের মাধ্যমে, দেশকে দুভাগ করে নয়। সেটা ছিল আমাদের দৃষ্ঠিভঙ্গি ও অনেকের দৃষ্টিভঙ্গি। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করা এক জিনিস আর কোনো ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকা আরেক জিনিস। আমি কখনোই কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলাম না। আমি সমর্থনও করি নাই। আমি ২৫ মার্চ রাতে সামরিক হামলায় এবং এর নৃশংসতায় নাখোশ ছিলাম।

আল জাজিরা: আপনার সম্পর্কে বলা হয় যে, আপনি ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল দল জামায়াতে ইসলামীর সদস্য ছিলেন?

মুঈনুদ্দীন: না, আমি জামায়াতের ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলাম, যা সামরিক হামলার পর ছেড়ে দেই। আমার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল দেশটি ইসলামী আদর্শের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছিল। যদিও সেখানে ন্যায়বিচার করা হতো না। কখনো পাকিস্তানে প্রকৃত ইসলাম বাস্তবায়ন করা হয়নি। কিন্তু সেখানে একটা আশা ছিল, কোনো এক সময় দেশে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। তাই দেশের সব অংশের আলেম ও ধর্মীয় পণ্ডিতদের পাকিস্তানের পক্ষে অবস্থান নেয়ার কারণ ছিল। খণ্ডিত না হয়ে উম্মাহকে একত্রিত রাখাই উত্তম কাজ বলে মনে করেছিলেন তারা। এটি ঠিকও হতে পারে, আবার ভুলও হতে পারে। ওটা ছিল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।

আল জাজিরা: এর পর থেকে বাংলাদেশ যে পথে চলছে সে বিষয়ে আপনার মত কি?

মুঈনুদ্দীন: এটা এখন একটা স্বাধীন রাষ্ট্র, এটা একটা বাস্তবতা। প্রত্যেকেরই বাস্তবতা মেনে নেয়া উচিত। আমি নিজেও একাধিকবার বাংলাদেশে গিয়েছি।  

আল জাজিরা: বর্তমান পরিস্থিতিতে আপনি কি বাংলাদেশে যাবেন?

মুঈনুদ্দীন: না, যতক্ষণ না পরিস্থিতি স্বাভাবিক হচ্ছে। দেশ এখন যেভাবে চলছে তাতে আন্তর্জাতিক মহল সমালোচনার চোখে দেখছে। পুরো শাসন ব্যবস্থায় যা চলছে তাতে আমার মতো যে কারো সেখানে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ।

আল জাজিরা: বেশ কয়েক বছর আগে যুক্তরাজ্যে একটি ভিডিও তথ্যচিত্র প্রচারিত হয়, যাকে প্রামাণ্য দলিল হিসেবে প্রসিকিউশন আদালতে উপস্থান করেছে। সেখানে দেখানো হয়েছে, ওই সময়কার আপনার কর্মস্থল দৈনিক পূর্বদেশের সম্পাদক আতাউর রহমান বলেছেন যে আপনার কাছে আলবদর বাহিনী সম্পর্কে বিশেষ তথ্য থাকতো। কারণ আপনি আল বদরের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

মুঈনুদ্দীন: ওই তথ্য চিত্রটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কাছে ও স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড ওয়ার ক্রাইমস ট্রায়ালের কাছে জমা দেয়া হয়েছিল। তারা এফসিও অফিসে যোগাযোগ করে আমাকে চিঠি দিয়ে জানিয়েছে যে, এ বিষয়ে তাদেরকে না আগাতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আইনি প্রক্রিয়ায় বাধা তৈরি করতে পারে বলে ওই বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আলোচনায় যাবো না আমি।

আল জাজিরা: তাহলে আপনি কী বলতে চান, এই ভিডিওতে বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় আপনার সংশ্লিষ্টতা নিয়ে দেয়া সাক্ষ্যগুলো মিথ্যা ও বানানো?

মুঈনুদ্দীন: এই বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছে। এবং দেখা গেছে এসব সাক্ষ্য সত্যের বিপরীত।

আল জাজিরা: ফেনী কলেজে স্থাপিত পাকিস্তানি ক্যাম্প সম্পর্কে বলুন।

মুঈনুদ্দীন: ওই ৯ মাসে আমি অনেকবার ফেনী গিয়েছি। তাই বলে একজন লোকের পক্ষে একইসঙ্গে ঢাকা ও ফেনীতে এ ধরনের কাজ চালানো সম্ভব না। বরং উল্টো এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ভিডিও আছে যেখানে স্বাধীনতার পর মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা লোকজনকে পিটিয়ে মারছে।

আল জাজিরা: মুক্তিযুদ্ধের একবছর বা তার কিছু সময় পর আপনি কেন বাংলাদেশ ছাড়লেন?

মুঈনুদ্দীন: আসলে আমি কয়েক সপ্তাহ পরেই বাংলাদেশ ছেড়েছি। কারণ ওই সময় বাজে প্রচারণা চলছিল এবং রাস্তায় চলছিল উম্মাদনা, যা আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে এসেছে। তাই আমি ও আমার পরিবার দেশ ছেড়ে চলে যাওয়াই সঠিক মনে করেছি। 

আল জাজিরা: আপনি কেন মনে করেন ওইসব বাজে প্রচারণা আপনাকে উদ্দেশ্য করেই ছিল?

মুঈনুদ্দীন: এখনকার মতোই তখনও অনেক রাজনৈতি খেলা ছিল, যা আমি বিস্তারিত বলতে চাই না। আর এখন খেলোয়াড়দের অনেকেই মারা গেছেন।

আল জাজিরা: একজন সাংবাদিক হওয়ার পরও ঢাকায় আপনার নবীন সহকর্মীরা (সাংবাদিকরা) কেন আপনার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাচ্ছে?

মুঈনুদ্দীন: সংক্ষেপে বলতে গেলে এটা শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও পেশাগত বৈরিতার কারণে। ঈর্ষার কারণেও এমনটি হতে পারে।

আল জাজিরা: এটাকে আপনি হুমকি মনে করছেন?

মুঈনুদ্দীন: না আমি একে হুমকি হিসেবে নিচ্ছি না।

আল জাজিরা: ২০১০ সালে ট্রাইব্যুনাল চালু হওয়ার পর থেকে কয়েকজন জামায়াত নেতার বিচার এবং কয়েকজনের সাজা হয়েছে, ফাঁসি হয়েছে, হচ্ছে। ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে, অনেক আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী প্রশ্ন তুলেছে। এ ক্ষেত্রে সেখানে কোনো ধরনের আন্তর্জাতিক তদন্ত হওয়া উচিত বলে মনে করেন কি?

মুঈনুদ্দীন: অবশ্যই হওয়া উচিত। এবং আন্তর্জাতিক মহলকে পর্যবেক্ষণের অনুমতি দেওয়া স্বচ্ছ বিচারের একটা সংস্কৃতিও।

আমি বলতে চাই- ট্রাইব্যুনালের ফটক থেকে সাক্ষীকে অপহরণ করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। মানুষজন সুস্পষ্টভাবে মিথ্যা সাক্ষ্য প্রমাণ দিয়েছে সেখানে। সেটা প্রমাণও হয়েছে। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ সে বিষয়েও গ্রহণ করা হয়নি। সরকারের মন্ত্রীরা ট্রাইব্যুনালের উপর চাপ প্রয়োগ করছে।

শ্রুতিলিখন: হোসাইন আহমদ ও ফয়সাল আতিক