জ্যাকব: মুক্তিযুদ্ধের এক কুশলী সেনানায়ক

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের একজন জে এফ আর জ্যাকব। বাংলাদেশ সেনা প্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদের বিশেষ আমন্ত্রণে স্বাধীনতার ৩৭ বছর পালন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে মঙ্গলবার ঢাকায় এসেছেন তিনি।

সুমন মাহমুদঅরুণ দেবনাথ ওবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 March 2008, 09:28 AM
Updated : 13 Jan 2016, 08:10 AM

মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্বে পূর্ব পাকিস্তানের রণাঙ্গনে সরাসরি যোগ দেয় ভারতীয় সেনাবাহিনী। ঢাকা দখলের মূল পরিকল্পনায় মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি ছিলেন ভারতীয় সেনানায়করাও। অথচ রণকৌশল নির্ধারণকারী ভারতীয় সেনা কর্মকর্তাদের স্বীকৃতি এখনও তেমনভাবে আলোচিত নয়।

মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয়দের অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে যেটুকু আলোচনা তার বেশিরভাগই তৎকালীন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম মানেক্শকে ঘিরে, যিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ও বীরত্বের জন্য 'মিলিটারি ক্রস' অর্জন করেন।

চওড়া গোঁফ, গোর্খা টুপি ও ব্যাটনধারী জেনারেল মানেক্শ ভারতীয়দের কাছে একজন অনুসরণীয় ব্যক্তিত্ব। তার অধীনেই ছিলেন প্রায় সমপ্রতিভা সম্পন্ন একদল সহযোদ্ধা, যারা নিজেরাই চৌকসভাবে রণকৌশল ঠিক করতেন। তাদের একজন কলকাতায় ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় সেনা কমান্ডের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা। মেজর জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ছিলেন তার চিফ অফ স্টাফ।

মুক্তিযুদ্ধে 'এস ফোর্স' এর অধিনায়ক ও মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার কে এম সফিউল্লাহ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "জে এফ আর জ্যাকবের সহযোগিতাতেই ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল এ এ কে নিয়াজীর আত্মসমর্পণ পত্রের খসড়া তৈরি এবং এ সংক্রান্ত সব আনুষ্ঠানিকতা ঠিক করা হয়।"

তিনি বলেন, "জ্যাকব একজন দক্ষ সেনা কর্মকর্তা। পাকিস্তানি বাহিনীর বিপর্যয়ের শুরুতেই জ্যাকব তাদের আত্মসমর্পণে বাধ্য করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী কখন, কোথায় ও কীভাবে আত্মসমর্পণ করবে সেটাও ঠিক করেছিলেন তিনি।"

সাবেক সেনাপ্রধান সফিউল্লাহ বলেন, "আমার মনে আছে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টায় যৌথবাহিনীর কাছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণ করার কথা ছিল। পরে তা ছয় ঘণ্টা পেছানো হয় এবং জেনারেল জ্যাকবের সঙ্গে আলোচনা করে প্রস্তাবগুলো মেনে নেওয়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেন নিয়াজী।"

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইব্রাহিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, "জে এফ আর জ্যাকব ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিনিয়র কর্মকর্তা। তার বাংলাদেশ সফর দুই দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ককে আরও মজবুত করতে পারে।"

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর শীর্ষস্থানীয়দের পরিকল্পনার সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত ছিলেন না জ্যাকব। এ সম্পর্কে ভারতীয় নিরাপত্তা গবেষণা সংস্থা এসএপিআরএ- কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, "সেনা সদর দপ্তর থেকে পাঠানো পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল খুলনা ও চট্টগ্রাম বন্দরের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ। এ বন্দর দুটিকে বাংলাদেশে ঢোকার প্রবেশ পথ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড ভিন্ন পরিকল্পনা নেয়।"

তিনি বলেন, "আমরা উপলব্ধি করছিলাম বাংলাদেশের ভূ-রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ঢাকা। তাই যেকোনো সামরিক তৎপরতা সফল করতে আগে ঢাকা দখল করতে হবে।"

পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড নিজস্ব পরিকল্পনা অনুসারেই রণাঙ্গনে অগ্রসর হয় যদিও ভারতীয় সেনা সদরদপ্তর ভাবছিল পরিকল্পনাটি উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবায়নযোগ্য নয়। পরে জ্যাকবকে পূর্ণ সমর্থন দেন জেনারেল অরোরা। এমনকি তিনি চীনের হামলা মোকাবেলায় প্রস্তুত রিজার্ভ বাহিনীকেও মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত করার অনুমতি দেন।

ওই বাহিনীর একটি অংশকে দ্রুত রনাঙ্গনে পাঠানোর জন্য 'প্যারাড্রপে'র কোনো বিকল্প ছিল না সেসময়।

যুদ্ধের স্মৃতিচারণায় এসএপিআরএ-কে জ্যাকব বলেন, "আমরা বুঝতে পারছিলাম সফলতা পাওয়ার একমাত্র উপায় হচ্ছে অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আক্রমণ করা। জাতিসংঘ আমাদের ওপর চাপ দিয়ে যাচ্ছিল যুদ্ধ বিরতির জন্য, রাশিয়াও এমন ইঙ্গিত দিচ্ছিল যে, তারা আর 'ভিটো' ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চায় না।"

তিনি বলেন, "আমরা জানতে পেরেছিলাম নিয়াজী শহরগুলোতে ঘাঁটি গড়ে তুলে নিজেদের শক্তি বাড়ানোর পরিকল্পনা করছিল। তাই আমরা শহরগুলোকে পাশ কাটিয়ে মূল লক্ষ্য ঢাকার দিকে এগোতে থাকি।"

সিএনবিসিকে আরেক সাক্ষাৎকারে জ্যাকব বলেন, "যুদ্ধে জিততে হলে ঢাকার দখল পেতেই হবে এটা আমরা বুঝেছিলাম। পূর্ব পাকিস্তানে ভূ-কৌশলগত দিক থেকে ঢাকাই মূল কেন্দ্র। কাজেই এর দখল নেওয়া ছাড়া কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়নই সম্ভব নয়।"

নদী ও জলাভূমির প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে গোলাবারুদসহ সৈন্যদের ঢাকার দিকে দিকে এগিয়ে যাওয়াটা ছিল একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু স্থানীয়দের সহায়তায় ভারতীয় সেনা প্রকৌশলীরা খুব দ্রুত যোগাযোগ ব্যবস্থা পুনরুদ্ধারে সক্ষম হন।

বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অগ্রসরমান সেনা কন্টিনজেন্ট শত্র"র প্রতিরোধ গুড়িয়ে দিয়ে দ্রুততার সঙ্গে ঢাকার দিকে এগিয়ে যায়। বিস্ময়কর এ অগ্রযাত্রা পাকিস্তানি সৈন্যদের মনোবল ভেঙে দিয়েছিল। মাত্র ছয় দিনের মধ্যেই মূল লক্ষ্যের কাছাকাছি পৌঁছে যায় ভারতীয় সেনাবাহিনী। শত্রুর অবস্থানের তথ্য আগেভাগেই জানিয়ে ও বিপদসঙ্কুল জলাভূমিগুলো এড়ানোর পথ দেখিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় সেনাদের অগ্রযাত্রায় গতি সঞ্চার করেন।

প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা ছাড়া ভারতীয় সেনারা এত দ্রুততার সঙ্গে ঢাকার দিকে এগুতে পারতো না।

জ্যাকবকে একজন দক্ষ ও সাহসী সেনা কর্মকর্তা হিসেবে বর্ণনা করেছেন সেক্টর কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল মীর শওকত আলী।

ইরাক থেকে প্রায় ১৫০ বছর আগে কলকাতায় বসতি গড়া এক ইহুদি পরিবারের সন্তান জ্যাকব ফার্জ রাফায়েল জ্যাকব। জন্ম ১৯২৩ সালে। ব্যবসায়ী বাবা ছেলেকে লেখাপড়ার জন্য পাঠিয়েছিলেন দার্জিলিংয়ের একটি স্কুলে। ১৯৪১ সালে ১৮ বছর বয়সে ব্রিটিশ সরকারের অধীন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে নাম লেখান জ্যাকব। বাবা শুরুতে জ্যাকবের সেনাবাহিনীতে যোগদানের বিষয়টি মেনে নিতে না পারলেও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ইহুদিদের ওপর নাৎসী বাহিনীর নির্যাতনের বিভৎসতা তার মনোভাব পাল্টে দেয়।