উপহারে অনিয়ম: শেষ মুহূর্তে আটকালো এরশাদের রায়

দুই যুগ আগের একটি দুর্নীতি মামলায় নিম্ন আদালতের সাজার বিরুদ্ধে জাতীয় পার্টি চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের আপিলের রায় শেষ মুহূর্তে আটকে গেছে।   

মেহেদী হাসান পিয়াসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 March 2017, 10:31 AM
Updated : 23 March 2017, 12:01 PM

হাই কোর্টে শুনানি শেষে বৃহস্পতিবার রায়ের দিন রাখা হলেও এ মামলায় এরশাদের সাজা বাড়াতে রাষ্ট্রপক্ষের দুটি আপিল অনিষ্পন্ন থাকায় রায় আর হয়নি।

বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের এই একক বেঞ্চ এ মামলার সব ফাইল পাঠিয়ে দিয়েছেন প্রধান বিচারপতির কাছে। তিনি নতুন বেঞ্চ ঠিক করে দিলে সেখানেই দুই পক্ষের আপিল নিষ্পত্তি হবে।

দুদকের পক্ষে আদালতে উপস্থিত ছিলেন খুরশীদ আলম খান, এরশাদের পক্ষে ছিলেন শেখ সিরাজুল ইসলাম। আর রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নাজিবুর রহমান এ সময় উপস্থিত ছিলেন।

তবে এই তিন পক্ষের কেউ এ মামলায় আরও আপিল অনিষ্পন্ন থাকার বিষয়টি আদালতকে জানায়নি। বিচারক নিজেই এদিন পুরনো আপিলের ফাইল আইনজীবীদের সামনে তুলে ধরেন।  

দুদক বলছে, তারা পরে এ মামলায় পক্ষভুক্ত হওয়ায় ২৫ বছর আগে রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিল নিয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। আর রাষ্ট্রপক্ষ বলেছে, অন্য সরকারের সময়ে ওই আপিল হওয়ায় এবং বর্তমান সরকারের কোনো নির্দেশনা না থাকায় এক্ষেত্রে তাদেরও কোনো দায় নেই।

সাবেক রাষ্ট্রপতি এরশাদ বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের মর্যাদায় রয়েছেন। বিএনপিবিহীন সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার ভূমিকায় রয়েছেন তার স্ত্রী রওশন এরশাদ।

এর আগে জজ আদালতে শুনানির শেষ পর্যায়ে গিয়েও এরশাদের বিরুদ্ধে মঞ্জুর হত্যা মামলায় পুনঃতদন্তের আদেশ হয়েছিল ২০১৪ সালে।

১৯৯০ সালে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিভিন্ন অভিযোগে প্রায় তিন ডজন মামলা হয় এরশাদের বিরুদ্ধে। এর মধ্যে তিনটিতে তার সাজার আদেশ হয়, যার একটি হল এই উপহারে অনিয়মের মামলা।

আরও আপিল আছে, আদালতকে জানায়নি কেউ

রাষ্ট্রপতি থাকা অবস্থায় উপহার নিয়ে তা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দেওয়ায় দুর্নীতির দায়ে বিচারিক আদালত ১৯৯২ সালে এ মামলায় এরশাদকে তিন বছর কারাদণ্ড দেয়।

দুই যুগের বেশি সময় পর গতবছর অগাস্টে হাই কোর্টে এ মামলায় এরশাদের আপিল শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে গত ৯ মার্চ বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের একক বেঞ্চ রায়ের জন্য ২৩ মার্চ দিন ঠিক করে দেন।

বৃহস্পতিবার দুই পক্ষের উপস্থিতিতে বিচারক তার আদেশে বলেন, “এ মামলাটি শুনানি শেষে আজ রায়ের জন্য রাখা হয়েছিল। কিন্তু এই পর্যায়ে এসে দেখা যাচ্ছে যে, একই মামলায় আরও দুটি আপিল আছে, যা হাই কোর্টে বিচারাধীন। একটি রায় থেকে তিনটি আপিলের উদ্ভব হয়েছে। ফলে এগুলোর একসঙ্গে শুনানি হওয়া উচিৎ। তাই তিনটি আপিলই প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠানো হল।”

দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, আসামির তিন বছরের সাজা বাড়ানোর জন্য ১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপক্ষ ওই আপিল দুটি করেছিল।

“ওই দুটি আপিল আদালতের নজরে এসেছে। সেটি আমাদের (দুদকের) জানার কথা নয়। আমরা এর পক্ষভুক্তও ছিলাম না। ১৯৯৬ সালে ওই দুটি আপিলের সঙ্গে এই (এরশাদের) আপিলটির শুনানি করতে হাই কোর্টেরও একটি আদেশ ছিল। সেটিও আদালতের নজরে এসেছে।

“ফলে আদালত সিদ্ধান্ত নিলেন, আলাদা করে একটি আপিলের রায় দিতে গেলে সাংঘর্ষিক হতে পারে। কাজেই ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনটা আপিলের নথিই প্রধান বিচারপতির কাছে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখন প্রধান বিচারপতি এই তিনটা আপিল যে কোর্টে পাঠাবেন সেই কোর্টে শুনানির পর নিষ্পত্তি হবে।”

দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা এই মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি হবে বলে আশা প্রকাশ করেন দুদকের এই আইনজীবী। 

ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নাজিবুর রহমান বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “দীর্ঘ শুনানির পর রায় দেওয়ার সময়ে এসে এই মামলায় আরও দুটি আপিল যখন আদালতের নজরে এলো, তখন শেখ সিরাজুল ইসলামকে (এরশাদের আইনজীবী) বিচারক জিজ্ঞেস করেছেন, ‘আপনি এ দুটি আপিল নজরে আনলেন না বা খেয়াল করলেন না?’।”

তিনি বলেন, “নিশ্চয়ই ওই দুটি আপিলও তার জানা ছিল, কিন্তু তিনি তা আদালতকে জানাননি।”

বাকি দুটি আপিলের বিষয়ে আদালতকে জানানোর ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো দায় ছিল না বলেও দাবি করেন রষ্ট্রের এই আইন কর্মকর্তা।

“এতে রাষ্ট্রপক্ষের কোনো দায় নেই। দুটি আপিলই ছিল অন্য সরকারের। তাছাড়া সরকারের পক্ষ থেকে এ দুটি আপিলের বিষয়ে কোনো যোগাযোগ করা হয়নি। নতুন কোর্ট, আমরা নতুনভাবে এই আদালতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছি, আমাদের নলেজে এটি ছিল না। সরকার যদি বলত- তাহলে হয়ত এটি আমাদের নলেজে থাকত। তবে আসামিপক্ষের উচিৎ ছিল বিষয়টি আদালতের নজরে আনা।”

কেন তা করা হয়নি সে বিষয়ে এরশাদের আইনজীবী শেখ সিরাজুল ইসলামের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

তিনি বলেন, “হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ। আমরা আশা করি, এ মামলা থেকে তিনি খালাস পাবেন।”

হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ (ফাইল ছবি)

মামলা বৃত্তান্ত

এরশাদের বিরুদ্ধে ১৯৯১ সালের ৮ জানুয়ারি দায়ের করা এ মামলায় অভিযোগ করা হয়, তিনি রাষ্ট্রপতি থাকাকালে ১৯৮৩ সালের ১১ ডিসেম্বর থেকে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ে পাওয়া বিভিন্ন উপহার রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা না দিয়ে এক কোটি ৯০ লাখ ৮১ হাজার ৫৬৫ টাকার আর্থিক অনিয়ম ঘটিয়েছেন।

ঢাকার বিশেষ জজ আদালত ১৯৯২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি এ মামলার রায়ে এরশাদকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেয়। এরশাদ ওই বছরই হাই কোর্টে আপিল করলে দণ্ড স্থগিত হয়ে যায়।

দুই দশক পর ২০১২ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন এ মামলায় পক্ষভুক্ত হয়। শুনানির জন্য এর আগে একবার বিষয়টি আদালতে উপস্থাপন করা হলেও পরে তা আর এগোয়নি।

গতবছর অগাস্টে আবারও এই আপিল শুনানির উদ্যোগ নেয় দুদক। বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুসের একক বেঞ্জে ১৫ নভেম্বর বিষয়টি তোলা হলে এরশাদের আইনজীবী সময়ের আবেদন করেন। 

শুনানির জন্য ৩০ নভেম্বর নতুন তারিখ রেখে বিচারক ওইদিন এরশাদের আইনজীবীকে বলেছিলেন, ১৯৯২ সালের মামলা এখনও যদি বিচারাধীন থাকে তাহলে হাই কোর্টের দরজা বন্ধ করে দেওয়া উচিৎ।

“তিনি সাবেক প্রেসিডেন্ট হলেও আলাদা কোনো সুযোগ পাবেন না। আইন সবার জন্য সমান। আপনাকে শেষ সুযোগ দেওয়া হল। এরপর আপনাকে আর সুযোগ দেওয়া হবে না।”

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে এরশাদ নির্বাচন কমিশনে যে হলফনামা দেন, তাতে তখনও আটটি মামলা থাকার কথা বলা ছিল। বাকি মামলাগুলো থেকে তিনি খালাস বা অব্যাহতি পেয়েছেন, অথবা মামলার নিষ্পত্তি হয়ে গেছে।

এই আট মামলার মধ্যে চারটির কার্যক্রম উচ্চ আদালতের আদেশে স্থগিত রয়েছে। মঞ্জুর হত্যাসহ তিনটি মামলা বর্তমানে চালু রয়েছে।