বিশ্ব ব্যাংককে মাফ চাইতে হবে প্রধানমন্ত্রীর কাছে: আইনমন্ত্রী

পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ তোলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে বিশ্ব ব‌্যাংককে মাফ চাইতে বলেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

সংসদ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 Feb 2017, 12:42 PM
Updated : 12 Feb 2017, 03:47 PM

কানাডার আদালতের রায়ে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ খারিজের পর রোববার সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় এই দাবি তোলেন তিনি।

বাংলাদেশের পদ্মা সেতু প্রকল্পে কানাডার পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে ঘুষের বিনিময়ে কাজ পাইয়ে দেওয়ার অভিযোগ বিশ্ব ব‌্যাংক তোলার পর তা নিয়ে শোরগোল উঠেছিল।

বিশ্ব ব‌্যাংকের চাপে বাংলাদেশে একটি মামলা হলেও দুর্নীতি দমন কমিশন পরে অভিযোগের প্রমাণ না হওয়ার কথা জানিয়েছিল তিন বছর আগে। একই ঘটনায় কানাডায় করা মামলা শুক্রবার খারিজ করে দেয় সে দেশের আদালত।

ওই রায়ের পর আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা বিশ্ব ব‌্যাংকের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন।

রোববার সংসদে এনিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করে জাতীয় পার্টির কাজী ফিরোজ রশীদ আইনমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করেন।

এরপর আনিসুল হক বলেন, “বিশ্ব ব্যাংককে বাংলাদেশের কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে এবং এই মামলার আসামিদের কাছে মাফ চাইতে হবে। যদি মাফ না চান, অর্থমন্ত্রীকে বলব, তিনি যেন প্রটেস্ট নোট পাঠান।”

এ বিষয়টি নিয়ে ঋণদাতা বৈশ্বিক সংস্থাটির কাছে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যায়, বলেন তিনি।

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্ব ব‌্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে অর্থায়ন স্থগিতের পর তাদের ফেরাতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তৎকালীন যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে, ছুটিতে পাঠানো হয়েছিল প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা মসিউর রহমানকে,গ্রেপ্তার করা হয়েছিল সেতু বিভাগের তৎকালীন সচিব মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়াকে।

এরপর বিশ্ব ব‌্যাংক ফিরলেও দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত নিয়ে সরকারের সঙ্গে ফের মনকষাকষি তৈরি হয়। ২০১১ সাল থেকে একের পর এক জটিলতার পর ২০১৩ সালে বিশ্ব ব‌্যাংককে বাদ দিয়ে প্রকল্প এগিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।

ওই সময়কালে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রধান আইনজীবী হিসেবে নিজের জানা নানা ঘটনাও সংসদে তুলে ধরেন বর্তমান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

তিনি জানান, বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিরা নিজেরাই তদন্ত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের বিষয়টি বিবেচনা করে সরকার তা নাকচ করে দিয়েছিল।

“দুদকের এফআইআরে আবুল হোসেনেরর নাম নেই কেন জানতে চেয়েছিল বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি দল। ঝগড়াই প্রায় হয়ে গেল। বললাম তদন্তে যা বেরোয় তাই হবে। হঠাৎ শুনলাম কানাডায় মামলা হয়েছে।”

কানাডার আদালত রায়ে বলেছে, এই মামলায় কোনো প্রমাণ হাজির করা হয়নি। প্রমাণ হিসেবে যেগুলো উপস্থাপন করা হয়েছে সেগুলো ‘অনুমানভিত্তিক, গাল-গল্প ও গুজবের বেশি কিছু নয়’।

‘নাম আছে, সবই বলব’

বিশ্ব ব‌্যাংককে বাদ দেওয়ার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলছেন, সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন আটকানো হয়েছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেন, দুদকের আইনজীবী হিসেবে তার সঙ্গে আলোচনার পর বিশ্ব ব‌্যাংকের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের আরও ব‌্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন।  

“আমার সঙ্গে মিটিং করে সেই রাতেই তারা বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টরের বাসায় কার কার সঙ্গে ডিনার করেছিলেন, তার বিস্তারিত আমার কাছে আছে।”

এসময় সংসদ সদস্যরা সেসব নাম প্রকাশ করার আহ্বান জানালে আনিসুল হক বলেন, “বলব, বলব, সবই বলব। আমার কাছে ডিটেইল আছে। তবে এটা নাম বলার প্ল্যাটফর্ম না।”

আনিসুল হক (ফাইল ছবি)

এরপর বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ এই আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, “আসুন সকলে মিলে একটি ধন্যবাদ প্রস্তাব গ্রহণ করি। বলি আপনি (প্রধানমন্ত্রী) যেটা বলেছিলেন সেটাই ঠিক ছিল।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর অর্থায়ন আটকানোর জন‌্য নোবেলজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসকে দায়ী করে আসছেন। কানাডার আদালতে রায়ের পর প্রধানমন্ত্রীপুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ও একই অভিযোগ তোলেন।

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, “ড. ইউনূস কলকাঠি নেড়েছেন।”

তোফায়েল আহমেদ গণফোরাম সভাপতি কামাল হোসেনের সমকালকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকার উদ্ধৃত করে বলেন, “সে সময় তিনি বলেছিলেন, দুর্নীতির অভিযোগে পদত্যাগ করা একজন মন্ত্রীকে দেশপ্রেমিক বলা হয়েছে। জনগণ বিষয়টি ভালো ভাবে নেবে না।”

জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের দেশীয় দালালদের উন্মোচন করতে হবে। একজন ড. ইউনূস বা ড. কামাল নন, এদের অনেক প্রেতাত্মা আছে। তাদের চিহ্নিত করার আমাদের নৈতিক দায়িত্ব।”

আওয়ামী লীগের শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “এরা বুদ্ধিজীবী না। এরা বিদেশি টাকা খেয়ে তাদের পক্ষে কথা বলে, এরা চুক্তিজীবী। একজন ডক্টর আছে, জানি না কিসের ডক্টর, গরুর না হাঁসের। হিলারি ক্লিনটন কার যেন বান্ধবী, বিশ্ব ব্যাংকের কাছে যেয়ে বলছে, টাকা দেওয়া যাবে না।”

গ্রামীণ ব‌্যাংকের পদ হারানো ইউনূসকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, “টাকা কোথা থেকে আসে? ফতুয়া গায় দেয়, প্লেনে ওঠে ফার্স্ট ক্লাসে। টাকা পায় কোথায়? জনগণের জন্য কোনো কাজ করে নাই, তারে নোবেল পুরস্কার দিয়ে বসে আছে। এরা দেশের শত্রু, জনগণের শত্রু।”

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস‌্য দীপু মনি বলেন, তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত এবং সে দেশের কূটনীতিকরা তার সঙ্গে দেখা করে মুহাম্মদ ইউনূসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে না সরাতে বলেছিলেন।

“তারা তখন বলেছিল, ইউনূসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিলে বিশ্ব ব্যাংক পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন করবে না।”

স্বাস্থ‌্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম বলেন, “এখনও চক্রান্ত চলছে। মিথ্যা অজুহাত দিয়ে রামপাল বন্ধের চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে।”

জাতীয় পার্টির জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু বলেন, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের শনাক্ত করতে হবে।

“বিশ্ব ব্যাংক-টিআইবি কারা করেছে, কেন করেছে আমরা জানি। এখানে যারা দালাল আছে, তাদের ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া উচিৎ। জনসমক্ষে এক্সপোজ করা উচিৎ।”

‘মামলা করা যায়’

পদ্মা সেতৃ প্রকল্পে দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ যাদের বিরুদ্ধে তোলা হয়েছিল, তাদের মধ‌্যে ইতোমধ‌্যে সৈয়দ আবুল হোসেন তার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের জন‌্য দায়ীদের কাছে প্রশ্ন তুলেছেন।

সংসদে আলোচনা তুলে ফিরোজ রশীদও আইনমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, “যারা ক্ষতি করলো তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এতবড় ক্ষতি করল!”

তোফায়েল আহমেদ বলেন, “পদ্মা ব্রিজ নিয়ে যারা বিদেশিদের সাথে কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়েছে, সরকারকে হেয় করেছে, সরকারের সুনাম ক্ষুন্ন করেছে; তারা এদেশের শত্রু। তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে।”

তখন মন্ত্রিত্ব ছাড়তে বাধ‌্য হয়েছিলেন সৈয়দ আবুল হোসেন

কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী বলেন, “শুধু সৈয়দ আবুল হোসেন না, অন্যায়ভাবে অসত্যভাবে যাদের অভিযুক্ত করা হয়েছিল, এতগ্লানি এত কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়ে কেউ যদি আত্মহত্যা করত, আশ্চর্য হতাম না।”

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী আনিসুল হক বলেন, ওই ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তারা মামলা করতে পারবেন।

“আইনজীবীর কাছে গেলে তারা বলে দেবেন কোথায় অধিক্ষেত্র হয়। এখানেও, ওখানেও।”

এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেন, “বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ছিল। আওয়ামী লীগ সরকারকে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য কানাডার কোর্টে মামলা করেছে।”

“বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র (সজীব ওয়াজেদ জয়) একটা কথা বলেছিলেন, হিলারি ক্লিনটন প্রফেসর ইউনূসের চাপে এই মিথ্যা মামলা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। আমরা একটা তথ্য পেয়ে গেছি। এখানে মামলার উপাত্ত আছে, অপরাধ ডিফাইন হয়ে গেছে। কেউ যদি মামলা করতে চান, সে পথ খোলা আছে।”

আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য আব্দুল মান্নান বলেন, “বিশ্ব ব্যাংকের বিরুদ্ধে সরকারের মামলা করা উচিৎ। ক্ষতিপূরণ চাওয়া উচিৎ। আবুল হোসেন সাহেবেরও মামলা করা উচিৎ।”

স্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম আইনমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে বলেন, “আপনি মামলা করেন। টাকা আমি দেব।

“এভাবে চলতে দেওয়া যায় না। সংসদের ক্ষমতা আছে; যে কাউকে ডাকার।”

জাসদের মইনুদ্দিন খান বাদল বলেন, “আমি চাটগাঁইয়া আর ইউনুস সাহেবও চাটগাঁইয়া। আমাদের মাথা মোটা হতে পারি, গোঁয়ার হতে পারি। কিন্তু, আমরা চক্রান্তকারী না।”

“তাই আমি এবং ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এই মামলার বাদী হতে চাই।”