বুধবার সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিএনপির যে বক্তব্য আসছে তাতে খুব স্বাভাবিকভাবে প্রচ্ছন্নভাবেই মনে হয় যে, তারা একটা শর্ত দিচ্ছে। এইটা করেন তা না হলে সন্ত্রাস বন্ধ হবে না, জঙ্গিবাদ বন্ধ হবে না।
“সাধারণ মানুষের মনে হবে যে, তারাই জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসের মদদদাতা, কোনো না কোনোভাবে তাদের একটা মদদ রয়েছে, উৎসাহ রয়েছে। কাজেই শুধু তাদের শর্তটা মানলেই তারা এটা বন্ধ করে দেবে। তাদের কথাবার্তায় সেটাই প্রতীয়মাণ হয়। এটাই হচ্ছে দুঃখজনক।”
গুলশানে ক্যাফেতে হামলায় ১৭ বিদেশিসহ ২০ জিম্মি নিহত হওয়ার পর জঙ্গিবাদ মোকাবেলায় জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ওই প্রস্তাব নাকচ করে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জঙ্গিবিরোধী জাতীয় ঐক্য এরইমধ্যে সৃষ্টি হয়ে গেছে।
এর পরেও জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানিয়ে আসা বিএনপি নেতারা বলছেন, জঙ্গিবাদ নির্মূল রাজনৈতিকভাবে করতে হবে, যার জন্য দল-মত নির্বিশেষে সবার ঐক্য দরকার।
এক সম্পূরক প্রশ্নে দীপু মনি প্রধানমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, বিএনপি সরকারের পদত্যাগ দাবির মাধ্যমে সন্ত্রাসের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ করছে কি না এবং ‘বিএনপি নেতাদের বক্তব্য সরাসরি জঙ্গিবাদকে উস্কে দেয়’, তাই তাদেরকে সরকার আইনের আওতায় আনবে কি না?
জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, “যারা এদের উৎসাহিত করবে অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
তিনি বলেন, “মূলত বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এদেশে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটে। তারা বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশকে একটি জঙ্গিবাদী ও অকার্যকর রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করার অপতৎপরতায় লিপ্ত হয়।”
“কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা থেমে থাকেনি। পেট্রোল বোমা মেরে, হরতাল ও অবরোধ করে সরকারের বিরুদ্ধে কোনো সফলতা না পাওয়ায় তারা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকারকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলতে নিরাপরাধ বিদেশি নাগরিকদের ‘টার্গেট কিলিংয়ের’ মাধ্যমে হত্যা করে।
“একইসাথে ব্লগার, প্রকাশক, প্রগতিশীল লেখকদের হত্যার মাধ্যমে পুনরায় এদেশে জঙ্গিবাদের বিস্তার ঘটাতে অপতৎপরতা শুরু করে। এরই ধারাবাহিকতায় হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গিদের দ্বারা সংঘটিত ঘটনা এদেশের ইতিহাসে এক ঘৃণ্যতম কর্মকাণ্ড।”
গত পহেলা জুলাই গুলশানের ওই রেস্তোরাঁয় জঙ্গি হামলায় ১৭ বিদেশি ও দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২২ জন নিহত হন। পরে কমান্ডো অভিযানে পাঁচ জঙ্গিসহ ছয়জন নিহত হন।
এর এক সপ্তাহের মাথায় শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জমায়েতের কাছেই জঙ্গি হামলায় দুই পুলিশ নিহত হন। পরে পুলিশের সঙ্গে গোলাগুলিতে মারা যান এক হামলাকারী।
এর পর মঙ্গলবার রাতে রাজধানীর কল্যাণপুরে জঙ্গি আস্তানায় অভিযানে পুলিশের গুলিতে নয়জন নিহত হন।
শেখ হাসিনা বলেন, “হত্যা, ক্যু, ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে জন্ম নেওয়া একটি রাজনৈতিক দল ‘অবৈধভাবে’ ক্ষমতা দখলের পর সংবিধান সংশোধন করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াতকে রাজনীতি করার সুযোগ করে দিয়েছে।
“এবং এদের দ্বারাই, এই যে যত রকমের সন্ত্রাসী-জঙ্গি কাজগুলি, যে নামেই যে আসুক না কেন তার মধ্যে পরিচয় যদি আমরা নিতে যাই, স্কুল-কলেজে কোথায় পড়েছে, কোন দল করেছে তখনই কিন্তু জানা যায় এরা কোন দল থেকে উঠে এসেছে এবং এদের উত্থানটা কোথা থেকে।
“এইভাবেই কিন্তু তাদেরকে ব্যবহার করা হচ্ছে। এরা আসার পর থেকে এই সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে এবং এদেরকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “বাংলাদেশে অগ্নিসন্ত্রাস বন্ধ করে মোটামুটিভাবে আমরা দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলাম। কিন্তু পহেলা জুলাইয়ের ঘটনা; এটা সত্যিই যেমন আমাদের দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করেছে, আবার সেই সাথে সাথে এটাও ঠিক সারা বিশ্বব্যাপীই এটা ঘটে যাচ্ছে।”
“কিন্তু যারা এই ঘটনা ঘটাচ্ছে; তাদের মদদদাতা, অর্থদাতা, প্রশিক্ষণদাতা বা কারা তাদের মাথায় উদ্ভট চিন্তা ঢোকাচ্ছে বা উৎসাহিত করছে সেটাই হচ্ছে দুঃশ্চিন্তার বিষয়।”
সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি এবং সন্ত্রাসীদের খুঁজে বের করে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওয়ার্ড থেকে জেলা পর্যন্ত জঙ্গি-সন্ত্রাসবিরোধী কমিটি গঠনের কথা উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।
জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সারা দেশব্যাপী ঐক্য সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সন্তানরা যেন বিপথে না যায় সে ব্যাপারে পিতামাতা, শিক্ষকরাও সচেতন।”
বাংলাদেশে সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদবিরোধী যে সচেতনতা সৃষ্টি হয়েছে তা বিশ্ববাসীর কাছে একটা ‘দৃষ্টান্ত’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সন্ত্রাসীদের পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করতে পারে এমন সব প্রচারিত বিষয় নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
“বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জামায়াত আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নিজেদের সুসংগঠিত করার সুযোগ পায়। প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও তারা আধিপত্য বিস্তার করে। ফলে তাদের মতাদর্শের কিছু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াকে সুযোগ পেলেই সরকারবিরোধী কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হতে দেখা যায়।”
তিনি জানান, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ সব বেসরকারি টেলিভিশনে প্রচারের জন্য দুটি ‘টিভিসি’ পাঠানো হয়েছে। একটি ‘টিভিসি’ সন্তানের গতিবিধির ওপর বাবা-মায়ের নজর রাখা এবং অন্যটি অপরিচিত লোকদের বাসা ভাড়া দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করার বিষয়ে।
এছাড়া জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সরকারি গণমাধ্যমগুলোর নেওয়া বিভিন্ন প্রচারণার কথাও সংসদে তুলে ধরেন শেখ হাসিনা।