মুজাহিদের রিভিউয়ের রায় বুধবার

যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) জন্য আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের আবেদন শুনেছে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ; এই জামায়াত নেতার সাজা বদলাবে কি না, তা জানা যাবে বুধবার।

সুপ্রিম কোর্ট প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 Nov 2015, 06:14 AM
Updated : 17 Nov 2015, 06:37 PM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নেতৃত্বাধীন চার সদস্যের আপিল বেঞ্চে মঙ্গলবার সকাল ৯টার পর এ শুনানি শুরু হয়, চলে বেলা ১২টা পর্যন্ত।

বেঞ্চের অন্য সদস্যরা হলেন- বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ও বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী।

আদালত থেকে বেরিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “যে রায় আপিল বিভাগ দিয়েছেন, তাকে (মুজাহিদ) দণ্ড দিয়েছে, একটা চার্জে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন, সেটা বহাল থাকবে, এটাই আমার প্রত্যাশা।”

অন্যদিকে প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে আসামি পক্ষের প্রধান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “আমরা যখন মামলা করতে যাই, তখন আমরা সব সময়েই প্রত্যাশা করি, আসামি খালাস পাবে। আসামির আইনজীবী হিসেবে আশাবাদী আমরা যে যুক্তি দিয়েছি, তা গ্রহণ করা হবে, এ ব্যাপারে আমরা রেমিডি (প্রতিকার) পাব।”

সকাল ৯টার দিকে এজলাসে আসেন বিচারপতিরা। বিচারপতিদের আসন গ্রহণের পর ৯টা ৫ মিনিটে শুনানি শুরু হয়।

প্রথমে মুজাহিদের পক্ষে শুনানি করেন খন্দকার মাহবুব। বেলা ১১টার কিছু আগে তার যুক্তি উপস্থাপনের পর অ্যাটর্নি জেনারেল বক্তব্য উপস্থাপন শুরু করেন। দুপক্ষের শুনানি নিয়ে ১২টা ১০ মিনিটের দিকে আদালত বলে, শুনানি শেষ হল, বুধবার আদেশের জন্য রাখা হল।

সুপ্রিম কোর্টের বুধবারের কার্যতালিকায় দেখা যায়, মুজাহিদের রিভিউ আবেদনটির আদেশ হবে বেলা সাড়ে ১১টায়।

মঙ্গলবার যুদ্ধাপরাধে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর রিভিউ আবেদনের শুনানির দিনও ঠিক ছিল। তবে তার আইনজীবীদের আবেদনে শুনানি একদিন পেছানো হয়।  

আদালতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপু, অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মোমতাজ উদ্দিন ফকির ও ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একরামুল হক টুটুল উপস্থিত ছিলেন। আসামিপক্ষে ছিলেন আইনজীবী এস এম শাজাহান ও শিশির মনির।

সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশ মুখে সতর্ক পাহারা

সাবেক দুই মন্ত্রীর রিভিউ শুনানির দিন থাকায় সকাল থেকেই সুপ্রিম কোর্টের সবগুলো প্রবেশ পথে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছিল। প্রবেশের সময় সবার পরিচয়পত্র দেখছিল পুলিশ, সন্দেহ হলে করা হয় তল্লাশি।

একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সাংবাদিক, শিক্ষকসহ বুদ্ধিজীবী হত্যা এবং সাম্প্রদায়িক হত্যা-নির্যাতনের দায়ে ২০১৩ সালের ১৭ জুলাই মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

প্রসিকিউশনের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে প্রথম অভিযোগে সাংবাদিক সিরাজুদ্দীন হোসেনকে অপহরণের পর হত্যা এবং ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবীসহ গণহত্যার ষড়যন্ত্র ও ইন্ধনের অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে ওই দণ্ড কার্যকর করার আদেশ দেওয়া হয়েছিল।

একই রায় এসেছিল সপ্তম অভিযোগে, ফরিদপুরের বকচর গ্রামে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর বর্বর হামলা চালিয়ে হত্যা-নির্যাতনের ঘটনায়।

চূড়ান্ত রায়ে চলতি বছরের ১৬ জুন আপিল বিভাগ মুজাহিদের আপিল আংশিক মঞ্জুর করে প্রথম অভিযোগে আসামিকে খালাস দেওয়া হয়। সপ্তম অভিযোগে তার সাজা কমিয়ে দেওয়া হয় যাবজ্জীবন কারাদণ্ড।

আর ষষ্ঠ অভিযোগে বুদ্ধিজীবী হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের রায় বহাল রেখে মুজাহিদের ফাঁসির আদেশ দেয় সর্বোচ্চ আদালত।

তবে রিভিউ শুনানিতে মুজাহিদের আইনজীবী শুধু মৃত্যুদণ্ডের সাজাটি নিয়েই কথা বলেছেন। এটি আইনসম্মতভাবে হয়নি দাবি করে তার পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন তিনি।

দুই পক্ষের যুক্তি

খন্দকার মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, যে অভিযোগে মুজাহিদকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে, তা বেআইনি হয়েছে। আদালত এটা পুনর্বিবেচনা করতে পারে।

তিনি বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার অভিযোগে এর আগে ৪২টি মামলা হয়েছে, সেখানে মুজাহিদের নাম ছিল না। আল বদরের কোনো তালিকায় তার নাম পাওয়া যায়নি বলে তদন্ত কর্মকর্তাও বলেছিলেন।

“আমরা দেখিয়েছি, আল বদরের কমান্ড ছিল আর্মি কমান্ড। সেটা আমরা মুনতাসির মামুনের একটা বই থেকে নিয়াজী সাহেবের ইন্টারভিউ থেকে দেখিয়েছি। নিয়াজী সাহেব বলেছেন, আল বদর, আল শামস সরাসরি আর্মি কমান্ডে ছিল।”

শুনানি শেষে বেরিয়ে আসছেন খন্দকার মাহবুব হোসেনসহ আসামি পক্ষের কৌঁসুলিরা

তিনি বলেন, “আমরা বলেছি, অন্য কেস যখন আমরা করেছি, তখন মামলায় যারা আসামি ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল, অমুক স্থানে তারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, আগুন দিয়েছে, নির্যাতন করেছে। কিন্তু মুজাহিদ সাহেবের বিরুদ্ধে চার্জে তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ নেই।

“উনি সুনির্দিষ্ট কোনো অভিযোগে অভিযুক্ত হননি। তার বিরুদ্ধে একটা … অভিযোগ এসেছে, বাংলাদেশে যে ইনটেলেকচুয়াল কিলিং হয়েছে, যেহেতু তিনি ইসলামী ছাত্রসংঘের সেক্রেটারি ছিলেন, সে কারণে এর দায় দায়িত্ব তাকে গ্রহণ করতে হবে। সুপিরিয়র কমান্ড যেটাকে বলা হয়।”

“তার বিরুদ্ধে আমরা বলেছি, আমরা একটি  ইন্টারভিউ দিয়েছি, সেখানে বলা হয়েছে, এই আল বদররা সরাসরি সেনাবাহিনীর আওতায় ছিল, নিয়াজীর আওতায় ছিলে।”

“এই ক্ষেত্রে যে অপরাধ হয়েছে, সেখানে যদি তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকে, তাহলে এই দায় দায়িত্ব তার ঘাড়ে চাপানো যাবে না। এই কারণে তাকে এই ধারায় সাজাও দেওয়া যায় না,” বলেন তিনি।

খন্দকার মাহবুব বলেন, “আদালত জিজ্ঞাসা করেছিল, যে আপনি কি কমিউটেশন (দণ্ড কমানো) চান? আমি বলেছি, না, আমি তো খালাস চাই। এটা আদালতের বিষয়, খালাস দেবে, না দণ্ড কমাবে। আমরা শুধু কমিউটেশন চাইনি, আমরা বলেছি সাক্ষী-প্রমাণ যে আছে, তার ওপর ভিত্তি করে শুধু এই চার্জে সাজা দেওয়া যায় না।”

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, “তাদের (আসামি পক্ষ) মোদ্দাকথা হল, তিনি তো নিজে কোনো লোককে মেরেছেন বা কোন বুদ্ধিজীবীকে  হত্যা করেছেন-এরকম তো সাক্ষ্য মামলায় নাই, এ ছিল তাদের মুখ্য বক্তব্য। সুতরাং তাকে মুত্যুদণ্ড থেকে অন্তত পক্ষে যাবজ্জীবন করা হোক, এই মর্মে তারা আদালতের কাছে বক্তব্য রেখেছেন।

“এর প্রতিউত্তরে আমরা বলেছি, তিনি সেসময় ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি হিসেবে বিভিন্ন জায়গায় যে বক্তব্য রেখেছেন এবং যেভাবে এই স্বাধীনতাকামী জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য যে সমস্ত আহ্বান জানিয়েছেন যেসব বক্তব্য রেখেছেন এবং সেইসব বক্তব্যের ফলশ্রুতিতে এই মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করা হয়েছে এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে।”

শুনানি শেষে বেরিয়ে আসছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম

তিনি বলেন, “বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকাণ্ডের যে হেডকোয়ার্টার ছিল মোহাম্মদপুরে ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ সেখানেও মুজাহিদকে দেখা গেছে। সেখানে মতিউর রহমান নিজামীকে ও গোলাম আযমকেও দেখা গেছে। সুতরাং বুদ্ধিজীবী হত্যার ব্যাপারে সরাসরি তাকে হত্যা করতে হবে এটা কোন কথা না, তিনি এই ব্যপারে প্ল্যান করেছেন, এ ব্যাপারে উৎসাহিত করেছেন এবং এব্যপারে তার যারা সহকর্মী তাদেরকে উজ্জীবিত করেছেন-এটাও বিরাট অপরাধ। এই অপরাধে তাকে যে শাস্তি দেওয়া হয়েছে আপিল বিভাগ থেকে সঠিক ভাবেই শাস্তি দেওয়া হয়েছে, এই ছিল আমার বক্তব্য।”

আপিলের রায়ের পর্যালোচনা তুলে ধরে মাহবুবে আলম বলেন, আলবদর বাহিনী পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা গঠিত হলেও স্থানীয় বেসামরিক নেতারাই বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনা করত।

“আমাদের বুদ্ধিজীবীদের হত্যার দায়ে দণ্ডিত মুজাহিদের দণ্ড যদি কমানো হয় বা মৃত্যুদণ্ড থেকে যাবজ্জীবন করা হয়, তাহলে আমরা সারা দেশবাসী এবং আমরা প্রসিকিউশন হতাশ হব,” বলেন তিনি।

রাষ্ট্রপক্ষের যুক্তি, বুদ্ধিজীবী হত্যার বিষয়ে বা মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের ক্ষেত্রে আসামিকে যে সব সময় হত্যাকাণ্ডের স্থানে থাকতে হবে এই রকম কোনো কথা নেই।

পরবর্তী ধাপ

দণ্ড কার্যকরের আগে যুদ্ধাপরাধী মুজাহিদের শেষ আইনি সুযোগ এই রিভিউ আবেদন। এ আবেদনে রায়ের কোনো পরিবর্তন না হলে তাদের সামনে কেবল রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চাওয়ার সুযোগ থাকবে।

এর আগে যুদ্ধাপরাধী আব্দুল কাদের মোল্লা ও মো. কামারুজ্জামানের রিভিউ আবেদন একদিনের মধ্যে শুনানি শেষে খারিজ হয়ে গিয়েছিল। তারা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা চাননি বলে সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, পরে তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।

২০১৩ সালের ১৭ জুলাই রায়ের দিন কারাগার থেকে ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাওয়ার পথে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ

নিয়ম অনুযায়ী, রিভিউ নিষ্পত্তির আগে দণ্ড কার্যকর করা যাবে না। রিভিউ খারিজ হয়ে গেলে সেই রায়ের অনুলিপি কারাগারে যাবে এবং কারা কর্তৃপক্ষ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসামিদের ফাঁসি কার্যকর করবে।

আপিল বিভাগের এই বেঞ্চ গত ১৬ জুন একাত্তরের বদর প্রধান মুজাহিদের আপিলের রায় ঘোষণা করে। আপিলের রায়েই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের দেওয়া ফাঁসির রায় বহাল থাকে। আপিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয়, ৩০ সেপ্টেম্বর।

এরপর নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনাল দুজনের মৃত্যু পরোয়ানা জারি করে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠায়। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মুজাহিদকে সেই মৃত্যু পরোয়ানা ১ অক্টোবর পড়ে শোনানো হয়।

মুজাহিদ রিভিউ আবেদন দায়েরের পর রাষ্ট্রপক্ষ শুনানির দিন নির্ধারণের জন্য গত ১৫ অক্টোবর আবেদন করে।

২০ অক্টোবর এই আবেদন অবকাশকালীন চেম্বার বিচারপতির আদালতে ওঠে,  রিভিউ আবেদন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের নিয়মিত বেঞ্চে পাঠিয়ে দেয়।

ধার‌্য তারিখে ২ নভেম্বর আপিল বিভাগ রিভিউ শুনানির জন্য ১৭ নভেম্বর দিন ঠিক করে দেয়।