দাবি না মানলে ‘কঠোর কর্মসূচির’ হুমকি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের  

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ঘোষণা এবং প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন কাঠামো পুনর্নির্ধারণের দাবিতে ক্লাস বন্ধ রেখে তিন ঘণ্টা কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2015, 08:49 AM
Updated : 16 August 2015, 12:45 PM

আন্দোলনরত শিক্ষকরা বলছেন, দাবি পূরণ না হলে ‘আরও কঠোর’ কর্মসূচি দিতে তারা বাধ্য হবেন।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ফেডারেশনের ডাকে রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত এই কর্মসূচি চলে। এ সময় শিক্ষকরা সমাবেশ, স্বাক্ষর সংগ্রহসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেন।

সপ্তম বেতন কাঠামোতে সচিব, সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপক ও মেজর জেনারেল পদের কর্মকর্তাদের এক নম্বর গ্রেডে রাখা হলেও প্রস্তাবিত নতুন বেতন কাঠামোতে সিলেকশন গ্রেডের অধ্যাপক ও অধ্যাপকদের বেতন আগের তুলনায় তিন থেকে চার ধাপ নেমে গেছে।

বেতন ও চাকরি কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে গত ১৩ মে সর্বোচ্চ ৭৫ হাজার এবং সর্বনিম্ন আট হাজার ২৫০ টাকা মূল বেতন ধরে সচিব কমিটি এই কাঠামো সুপারিশ করে, যা ১ জুলাই থেকে কার্যকর হওয়ার কথা।

নতুন কাঠামোতে এই ‘অবনমনের’ প্রতিবাদসহ চার দফা দাবিতে গত তিন মাস ধরে আন্দোলন চালিয়ে আসছেন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

তাদের বাকি দাবিগুলো হচ্ছে- বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো ঘোষণা; সিলেকশন গ্রেডপ্রাপ্ত অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা সিনিয়র সচিবদের সমান করা, অধ্যাপকদের বেতন-ভাতা সচিবের সমতুল্য করা এবং সহযোগী, সহকারী অধ্যাপক ও প্রভাষকদের বেতন কাঠামো ক্রমানুসারে নির্ধারণ।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, দেশে উচ্চশিক্ষার সবচেয়ে বড় এ বিদ্যাপিঠের শিক্ষকরা আগের ঘোষণা অনুযায়ী ক্লাস বন্ধ রেখে সকাল ১০টায় বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে জড়ো হন।

চার দফা দাবিতে সেখানে স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়, যাতে সই করেন অন্তত ৭০০ শিক্ষক। পরে সেখানেই একটি সমাবেশে যোগ দেন তারা, যাতে সব পক্ষের শিক্ষকরাই ছিলেন। 

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ফরিদ উদ্দিন আহমেদ সমাবেশে বলেন, “আজ ৩৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ে যুগপৎ আমাদের এই কর্মসূচি চলছে। আমাদের দাবি যদি মেনে না নেওয়া হয়, তাহলে আরও কঠোর কর্মসূচি দিতে আমরা বাধ্য হব।”

আগামী রোববারও একই কর্মসূচি হবে এবং শিক্ষকদের স্বাক্ষর সংবলিত দাবি সরকারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে বলেও জানান এই অধ্যাপক।  

এসময় বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালর শিক্ষক ফেডারেশন সমিতির মহাসচিব ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, “সুচিন্তিতভাবে আন্দোলন করে যাচ্ছি শুধুমাত্র আমাদের মর্যাদা  আদায়ের জন্য। তবে ছাত্রদের কোনো ক্ষতি হোক আমরা সেটা চাই না। উচ্চশিক্ষার পথ সুগম ও জাতি গড়ার কারিগর হিসেবে কাজ করেই যাব।”

সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি সাদা দলের সমর্থক আখতার হোসেন খান বলেন, “দলীয়ভাবে ভিন্ন হলেও শিক্ষক হিসেবে এই দাবিতে আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। তবে এখানে আমলা-সচিবদের নিয়ে এত বেশি আলোচনা করছি যে, তাদের (আমলা) মর্যাদা দিচ্ছি। পিএসসি বোর্ডে যাদের ভাইভা নিয়েছি তারাই তো আজকে আমলা হয়েছেন।

“শিক্ষক সমিতির নেতারা আজকে দলের স্বার্থ না দেখে যেভাবে আমাদের মর্যাদা আদায়ের দাবিকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ আস্থা আছে। যখন সারা দেশে অস্থিরতা চলছিল তখন আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা ক্লাস নিয়েছি। কারণ ছাত্রদের যাতে কোনো অসুবিধা না হয়। এখন আমাদের সম্মান নিয়ে টানাটানি।”

রংপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একে এম নূর-উন-নবীও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে এসে শিক্ষকদের এ কর্মসূচিতে সংহতি প্রকাশ করেন।

অধ্যাপক নুর-উন-নবী বলেন, “শিক্ষকদের দাবি আদায়ে আন্দোলন করতে হবে। ‘সফট বা হার্ড লাইন’ আন্দোলন হবে, এটা আমি বুঝি না। শিক্ষকদের ন্যায্য দাবির জন্য আন্দোলন করতে হবে।”

অধ্যাপক মেজবাহ কামাল বলেন, “আমাদের অস্তিত্ব ও মর্যাদা রক্ষায় আমরা দলের উর্ধ্বে এখানে ঐক্যবদ্ধ হয়েছি। এই আমলারা অনেক বেশি প্রভাব খাটায় যে, তারা প্রধানমন্ত্রীকে পর্যন্ত প্রভাবিত করার চেষ্টা করে।”

“কেন আমলাদের সাথে আমরা তুলনা করছি, যারা শিক্ষকদের সম্মান করতে পারে না” বলেন অধ্যাপক তৌহিদা রশিদ। গবেষণায় অর্থ বাজেট বাড়ানো দাবিও জানান তিনি।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সদস্য অধ্যাপক এ জে এম শফিউল আলম ভূঁইয়া বলেন, “রাষ্ট্রীয় ‘ওয়ারেন্ট অব প্রিসিডেন্সে’ শিক্ষকদের জায়গা না হলে এটা উঠিয়ে দেওয়া হোক।”

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে একই ধরনের কর্মসূচিতে স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবি না মানলে সেপ্টেম্বর থেকে লাগাতার ধর্মঘটের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন শিক্ষকরা।

কর্মসূচী পালনকালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আলী নূর বলেন, “অগাস্ট মাসের মধ্যে যদি আমাদের ন্যায্য দাবি মেনে না নেওয়া হয়, তাহলে সেপ্টেম্বরে দেশের সমস্ত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে।”

সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হোসেন বলেন, “আমলারা আজ সরকারের সমস্ত কিছু চেটেপুটে খেয়ে এখন আসলে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য এ ধরনের কাঠামো তৈরি করছে। সরকারকে বুঝতে হবে আমলারা পরবর্তী সরকারের সুযোগ সুবিধা পাওয়ার অপেক্ষা করছে।”

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন কলা ও মানবিক অনুষদ ভবনের সামনে কর্মবিরতিতে শতাধিক শিক্ষক অংশ নেন।

শিক্ষকরা বলেন, প্রস্তাবিত অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল বাস্তবায়িত হলে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রতিষ্ঠিত ও ন্যায়সঙ্গত অধিকারই ক্ষুণ্ন হবে না, শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত অবমাননার দৃষ্টান্তও স্থাপিত হবে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির কর্মসূচিতে শিক্ষকরা

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি জানান, শিক্ষকদের কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘটের তিন ঘণ্টায় সেখানে ক্লাস বা পরীক্ষা হয়নি।

রোববার সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত সিনেট ভবনের সামনে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক আনন্দ কুমার সাহা বলেন, “যদি আমাদের দাবি না মানা হয়, তাহলে এটা (কর্মসূচি) আর তিন ঘণ্টা থাকবে না; লাগাতার ধর্মঘটে পরিণত হবে। আমরা ক্লাস-পরীক্ষা বাদ দিয়ে ধর্মঘট চালিয়ে সেশনজট বাড়াতে চাই না। কিন্তু আমাদেরকে বাধ্য করা হচ্ছে।”

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের দাবি দ্রুত মেনে নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

তিনি বলেন, “আগামীকাল মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে আমাদের এই বেতন কাঠামো নিয়ে যদি কোনো সুরহা না হয়, তাহলে আগামী ২৩ অগাস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে পূর্ণ দিবস কর্মবিরতি পালন করা হবে।”

চার দফা দাবিতে পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও একই কর্মসূচি পালন করেন। 

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম, সাধারণ সম্পাদক আওয়াল কবির জয়, ছাত্র বিষয়ক উপদেষ্টা ড. মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহসহ বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষকরা অবস্থান কর্মসূচিতে বক্তব্য দেন। 

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কর্মসূচি অনুযায়ী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত কর্মবিরতি পালন করেছে।

শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. কাজী এসএম খসরুল আলম কুদ্দুসী বলেন, “দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত প্রতি রোববার সকালে একই সময়ে তিন ঘণ্টা করে এই কর্মসূচি পালন করা হবে।”

তবে কর্মবিরতিতে ক্লাস নেওয়া বন্ধ থাকলেও সব পরীক্ষা স্বাভাবিক সূচি অনুযায়ী চলবে বলে ড. খায়রুল জানান।

স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের দাবিতে দুই মাসেরও বেশি সময় ধরে কালো ব্যজ ধারণ, মানববন্ধন, অবস্থান ধর্মঘটসহ বিভিন্ন কর্মসুচি পালন করে আসছেন এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে অবস্থান কর্মসূচিতে শিক্ষককদের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা হয়

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির উদ্যোগে শিক্ষকরা সকাল ১০টা থেকে বেলা ১টা র্পযন্ত কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট এবং স্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচি পালন করেছেন। একই কর্মসূচি হয়েছে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়েও।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপার্চায মোহাম্মদ ফায়েক উজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিনিধিকে জানান, কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারাও কর্মসূচি পালন করেছেন। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পূর্ব নির্ধারিত পরীক্ষা সূচি অনুযায়ী হয়েছে।

নির্ধারিত সব কর্মসূচিতেই অংশগ্রহণ করেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মুহাম্মদ আলমগীর।  

ময়মনসিংহে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসেও কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির ব্যানারে সকাল থেকে তিন ঘণ্টা একই কর্মসূচি পালন করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো ক্লাস না হলেও পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি শরিফুল ইসলাম।

গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের অবস্থান

গাজীপুরের ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ডুয়েট) শিক্ষাকরা ‘বৈষম্যমূলক’ বেতন কাঠামো প্রত্যাখ্যান এবং স্বতন্ত্র বেতন কাঠামোর দাবিতে কর্মবিরতি ও অবস্থান ধর্মঘট পালন করেছেন।