বাংলাদেশ

নড়িয়ার হাহাকার

Byমোস্তাফিজুর রহমান

পুরনো খবর

অব্যাহত ভাঙনে মানচিত্রের মুক্তারের চর, কেদারপুর ইউনিয়ন ও নড়িয়া পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ড এখন অস্তিত্বহীন প্রায়। নড়িয়ার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সনজিদা ইয়াসমিনের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এসব এলাকার পাঁচ হাজারের মত পরিবার ভাঙনের কারণে বাস্তুহারা হয়ে পড়েছে।
মুলফতগঞ্জের আমিরজান বিবির বয়স ১০০ বছরের বেশি, স্বামী হারিয়েছেন পঁচিশ বছর আগে। স্বামীর রেখে যাওয়া ছোট্ট বসতবাড়িটিই ছিল তার একমাত্র সম্বল। পদ্মার পেটে সে বাড়িও চলে গেছে তিন দিন আগে। এখন তার যাওয়ার জায়গা নেই। বললেন, পদ্মার এমন ভয়াল রূপ এ জীবনে আর কখনও দেখেননি।
আমিরজান বিবির প্রতিবেশী কাদির ফকির। মুলফতগঞ্জে বসত ভিটা ছাড়াও ১২ শতক জমি ছিল তার। সবকিছুই রাতের অন্ধকারে হারিয়ে গেছে পদ্মায়। এখন খোলা আকাশের নিচে বসে তিনি সরকারি সহায়তার অপেক্ষায়।
ভাঙনের তীব্রতা দেখে কাঠের বাড়ি ভেঙে জিনিসপত্র প্রতিবেশীর উঠানে সরিয়ে রেখেছেন মুলফতগঞ্জের শাহেদা আক্তার। তার এখন রাত কাটে খোলা আকাশের নিচের এই চৌকিতে শুয়ে। দিনমজুর স্বামীর সামান্য আয়ে এতদিন সংসার চলত। এখন ভিটেমাটি হারিয়ে জীবন কীভাবে যাবে তা শাহেদা ভাবতেও পারছেন না।
দুই শিশু সন্তানকে নিয়ে স্বামী পরিত্যক্তা মনি বেগমের দিন কাটছিল বাবার বাড়িতে। মানুষের বাড়িতে কাজ করে সন্তানদের খাবার জোটাতে হত। বাবার বাড়ি পদ্মার পেটে গেছে, যাদের বাড়িতে কাজ করতেন তারাও এখন বাস্তুহারা। মুলফতগঞ্জে পদ্মার এই তীরের মতই ভয়ঙ্কর অনিশ্চিয়তা মনি বেগমের সামনে।
নড়িয়ার দাসপাড়ার মাসন চন্দ্র দাসের জন্ম এই ভিটাতেই। ভাঙতে ভাঙতে নদী এগিয়ে আসায় ঘর খুলে ফেলেছেন তিনি। কিন্তু পরিবার নিয়ে কোথায় যাবেন- তা বুঝতে পারছেন না।
কেদারপুরের নাজমা বেগমের ঘর গেছে সাত দিন আগে। প্রতিবেশীর উঠানে একটুকু জায়গায় খোলা আকাশের নিচে সন্তানদের নিয়ে অস্থায়ী আশ্রয় পেয়েছেন তিনি। কিন্তু এ জায়গাটিও আছে ভাঙ্গনের হুমকিতে। নাজমা আক্ষেপ করে বলেন, “বিদেশি রোহিঙ্গাদের জন্য এত সাহায্যের কথা শুনি, বিন্তু এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে কেউ আসল না।”
কেদারপুরের দাসপাড়ার সীমা দাসের বাড়ির বড় একটি অংশ দিন তিনেক আগে পদ্মায় বিলীন হয়ে গেছে। বাড়ির পেছনের কিছু অংশ এখনও জেগে আছে ডাঙায়। ভগবানের কৃপা হলে এ জায়গাটুকু বেঁচে যেতে পারে- এ আশা নিয়েই আছেন সীমা।
কেদারপুরের তমিজুদ্দীনের ঘর যেখানে ছিল, সেখানে এখন দেড়শ ফুট পানি। জীবনের শেষ প্রান্তে এসে এমন দুর্যোগে পড়তে হবে, তা কখনও ভাবেননি এই বৃদ্ধ।
কেদারপুরের মজিবুর রহমান কাজ করেন নারায়ণগঞ্জের এক পোশাক কারখানায়। ভাঙনের খবর শুনে ছুটে এসেছেন বাড়িতে, কিন্তু তার আগেই বেশিরভাগ জমি হারিয়ে গেছে পদ্মায়। অবশ্য এটাই প্রথম নয়, বছর পাঁচেক আগে পদ্মায় বাপের ভিটা হারিয়েই কয়েক কিলোমিটার দূরে কেদারপুরে এই জমি কিনে বাড়ি তুলেছিলেন মজিবুর। নতুন ভাঙন জীবনের সব সঞ্চয় কেড়ে নেওয়ায় এখন তার আর ঘুরে দাঁড়ানোরও শক্তি নেই।
নড়িয়ার আড়াই লাখ মানুষের স্বাস্থ্য সেবার একমাত্র সরকারি প্রতিষ্ঠান নড়িয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছিল ২০১৪ সালে। এ সপ্তাহের শুরুতে সেই হাসপাতালও গিলতে শুরু করেছে পদ্মা। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নতুন ভবনের বেশিরভাগ অংশ ইতোমধ্যে চলে গেছে নদীগর্ভে। হাসপাতালের একটি আবাসিক ভবনে জরুরি বিভাগ ও বহিঃবিভাগের কাজ চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হলেও হাসপাতালে প্রবেশের সড়কটি নদীতে চলে যাওয়ায় রোগী আসার উপায় নেই।
২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত নড়িয়া উপজেলার মানুষ একসময় কৃষির ওপর নির্ভর করলেও এখন এ এলাকার আয়ের একটি বড় উৎস প্রবাসী আয়। অনেক পরিবারেই কেউ না কেউ ইটালিসহ ইউরোপের বিভিন্ন থাকেন। তাদের পাঠানো টাকায় সুদৃশ্য তিন-চার তলা বাড়িও তুলেছিলেন অনেকে। কিন্তু পদ্মা কেড়ে নিচ্ছে সব।
গত এক সপ্তাহে সাধুর বাজার, ওয়াপদা বাজার, মুলফৎ বাজার, চর জুজির গাঁও, দাসপাড়া, উত্তর কেদারপুর এলাকার বহু ঘরবাড়ি, রাস্তা, সেতু, কালভার্ট আর চার শতাধিক দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চোখের সামনে চলে গেছে পদ্মার পেটে। ভাঙনের ঝুঁকিতে থাকা এলাকার বাসিন্দারা তাদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নিচ্ছেন।
সবহারা পরিবারগুলোর আশ্রয়ের ব্যবস্থা হচ্ছে ৩৯টি সাইক্লোন সেন্টারে। খাদ্য সহায়তা হিসেবে দেওয়া হচ্ছে চাল ও শুকনা খাবার। পাশাপাশি পুনর্বাসনের জন্য টিন আর টাকা দেওয়ারও উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।
পদ্মা তীরের কৃষিজমি ভাঙতে ভাঙতে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকার দিকে এগোতে থাকায় কয়েক বছর ধরেই ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছিল এলাকাবাসী। সরকারের তরফ থেকে গত জানুয়ারিতে হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্পও অনুমোদন করা হয়েছিল। কিন্তু সেই কাজ শুরুর আগেই জুলাই মাসে পদ্মায় নতুন করে ভাঙন শুরু হয়।
শরীয়তপুরের পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, জরুরি ব্যবস্থা হিসেবে এক লাখ ১০ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে নদীতে। তাতে নদী তীরে স্রোতের তীব্রতা কিছুটা কমলেও ভাঙন থামেনি। আর বর্ষার পানি না কমা পর্যন্ত তীর রক্ষা প্রকল্পের কাজও করা সম্ভব নয়।
SCROLL FOR NEXT