‘শয়তান.. শয়তান..’

রায় পড়া শুরুর সময় ট্রাইব্যুনালের কাঠগড়ায় ফুরফুরে মেজাজে দেখা গেলেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির আদেশ শুনে উঠে দাঁড়ান মীর কাসেম; ক্ষিপ্ত ভঙ্গিতে বলে ওঠেন- ‘শয়তান.. শয়তান..’।

সুলাইমান নিলয়ও কাজী শাহরিন হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Nov 2014, 09:05 AM
Updated : 2 Nov 2014, 02:20 PM

একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান রোববার জনাকীর্ণ আদালতে এই রায় দেন।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও ১৯৮৫ সাল থেকে জামায়াতের শুরা সদস্য কাসেমের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের সময় অপহরণ, নির্যাতনের আটটি এবং হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার দুটি অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় সর্বোচ্চ সাজার রায় আসে।

রায়ের জন্য সকাল ৯টা ১৭ মিনিটে আসামি মীর কাসেমকে পুলিশের একটি প্রিজন ভ্যানে করে পুরাতন হাই কোর্ট এলাকায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নিয়ে আসা হয়। এরপর প্রায় আধা ঘণ্টা তাকে রাখা হয় ট্রাইব্যুনালের হাজতখানায়।

সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন যুদ্ধাপরাধ মামলার আসামি আরেক জামায়াত নেতা আবদুস সুবহান। তাদের সেখানে কিছু সময় খোশ-আলাপ করতে দেখা যায়। এই ফাঁকে কাসেম পত্রিকাতেও চোখ বুলান।

১৯৭৭ সাল থেকে জামায়াতকে শক্ত আর্থিক ভিত্তি দিতে কাজ করে আসা মীর কাসেমকে ১০টা ৪৩ মিনিটে কাঠগড়ায় তুলে একটি চেয়ারে বসতে দেওয়া হয়। আদালতকক্ষের পেছন দিকে বাঁ পাশে কাঠগড়ায় পৌঁছেই সামনে ও ডানে বসা সবার দিকে হাত তুলে সালাম দেন তিনি।

হালকা আকাশী শার্ট, ঘিয়ে কোট আর চশমা চোখে এ সময় তাকে বেশ ফুরফুরে মেজাজেই দেখা যায়। চেয়ারে বসেই পায়ের ওপর পা তুলে দেন আসামি কাসেম। ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম এ সময় তার সঙ্গে কথা বলেন।

মীর কাসেমের এই মামলাটির অভিযোগ গঠন হয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এ। পরে মামলাটি দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালে চলে যায়, সেখানেই শুনানি হয়।

ওই আদালতকক্ষটি আকারে ছোট হওয়ায় বরাবরের মতো এবারো ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালের বিচারকক্ষই রায় ঘোষণার স্থান হিসাবে নির্ধারিত ছিল। তবে এক নম্বর ট্রাইব্যুনালের কয়েকটি মামলা শুনানির জন্য থাকায় রায়ের আগে প্রথম ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা প্রথমে এজলাসে আসেন।

রীতি অনুসারে বিচারকরা আসার আগেই তাদের আসন ঠিক করে দিতে এবং কাগজপত্র নিয়ে আর্দালিরা এজলাসে হাজির থাকেন। আরদালিরা প্রবেশের পরই আদালতকক্ষে উপস্থিত সবাই দাঁড়িয়ে যান।

অন্য সবার সঙ্গে মীর কাসেমও এ সময় দাঁড়িয়ে যান। তার দুই হাত তখন প্যান্টের পকেটে। বিচারকদের আসতে দেরি দেখে তিনি বসে যান। আদালতকক্ষে থাকা আইনজীবী-সাংবাদিকসহ অন্য সবাই তখনো দাঁড়িয়ে।

এক মিনিট যেতে না যেতেই বিচারকরা এজলাসে এলে এক হাত পকেটে রেখেই উঠে দাঁড়ান কাসেম। বিচারকরা আসন গ্রহণ করলে এই যুদ্ধাপরাধী জামায়াত নেতাও বসে পড়েন। বসেই পায়ের ওপর পা তুলে দেন।

কার্যতালিকায় থাকা কয়েকটি মামলা মুলতুবির আদেশ দিয়ে ১ নম্বর ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা এজলাস ত্যাগ করলে দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের আর্দালিরা প্রবেশ করেন। আবার সবাই দাঁড়িয়ে যান।

তবে মীর কাসেম না দাঁড়িয়ে এজলাসের পাশে থাকা কয়েকজন সাংবাদিককে সরিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে বলেন। সাংবাদিকরা সরে গেলে বিচারকদের প্রবেশের দৃশ্য তার সামনে উন্মুক্ত হয়। এবার তিনি হাত পকেটের বাইরে রেখেই দাঁড়ান।

দ্বিতীয় ট্রাইব্যুনালের বিচারকরা আসার পর অন্য কয়েকটি মামলার বিষয়ে কথা হয়। তারপর কাসেমের মামলার ডাক আসে। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান প্রারম্ভিক বক্তব্য দিয়ে নিজেই ৩৫১ পৃষ্ঠার রায়ের ১১ পৃষ্ঠার সংক্ষিপ্তসার পড়েন।

এ সময় মীর কাসেমকে বেশ কয়েকবার পায়ের ওপর পা তুলে বসতে দেখা যায়। মাঝে মধ্যেই তিনি নড়েচড়ে বসছিলেন, ঠোঁটে উঁকি দিচ্ছিল তাচ্ছিল্যের হাসি।

শুরুর দিকে হালকা মেজাজে হাঁটুর ওপর আঙুল নাচাতে দেখা গেলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার চেহারায় উদ্বেগ বাড়তে থাকে।

ফাঁসির সাজা ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে মীর কাসেম বলে ওঠেন, “শয়তান.. শয়তান..।

“মিথ্যা ঘটনা... মিথ্যা সাক্ষ্য... কালো আইন... ফরমায়েশি রায়। সত্যের বিজয় হবে শীঘ্রই... শীঘ্রই।”

রায়ের পর কাসেমকে নামিয়ে আনা হয় নিচতলার হাজতখানায়। সেখানে না বসে গরাদের শিক ধরে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে।

আদালত থেকে কারাগরে নেওয়ার পথে প্রিজন ভ্যানে তোলার সময় আলোকচিত্র সাংকাদিকদের দিকে আঙুল তুলে বিজয়ের চিহ্নও দেখান এক ফাঁকে।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতায় ছাত্রসংঘের বাছাই করা সদস্যদের নিয়ে গঠিত সশস্ত্র আলবদর বাহিনীর চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার হিসেবে মীর কাসেম যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটান, তা উঠে এসেছে এই রায়ে।

একাত্তরে তার নির্দেশেই চট্টগ্রাম টেলিগ্রাফ অফিস সংলগ্ন এলাকায় হিন্দু মালিকানাধীন মহামায়া ভবন দখল করে নাম দেওয়া হয় ডালিম হোটেল। সেখানে গড়ে তোলা হয় বদর বাহিনী চট্টগ্রাম অঞ্চলের ঘাঁটি এবং বন্দিশিবির। মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময় সেখানে অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন ও হত্যা করা হয়, যাদের লাশ পরে ফেলে দেওয়া হতো চাক্তাই চামড়ার গুদাম সংলগ্ন কর্ণফুলী নদীতে। এসব ঘটনায় তার জড়িত থাকার অভিযোগও বিচারে প্রমাণিত হয়।

রায় ঘোষণার সময় মীর কাসেমের ছেলে ব্যারিস্টার মীর আহমেদ বিন কাসেম আদালতে উপস্থিত ছিলেন।

রায়ের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কাসেমের আইনজীবী মিজানুল ইসলাম বলেন, “যে সকল প্রমাণাদির ভিত্তিতে দণ্ড দেওয়া হয়েছে, তাতে এই রায় দেওয়া যায় না। প্রসিকিউশন প্রমাণ করতে পারেনি। এই রায়ের মধ্য দিয়ে ন্যায় প্রতিষ্ঠিত হয়নি।”

এর বিরুদ্ধে আপিল করার কথাও বলেছেন তিনি।