রাজধানীতে ‘জামায়াতের’ তাণ্ডব

জুমার নামাজে পর রাজধানীর বায়তুল মোকাররম, পল্টন ও কাঁটাবন, মিরপুর, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকায় পুলিশের সঙ্গে সংঘাতে জড়িয়ে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে গণজাগরণ মঞ্চবিরোধীরা, যার পেছনে জামায়াতের ইন্ধন দেখছে পুলিশ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 Feb 2013, 03:42 AM
Updated : 22 Feb 2013, 07:47 AM

হামলা-সংঘর্ষের খবর পাওয়া গেছে চট্টগ্রাম, সিলেট, রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকেও। চট্টগ্রাম ও সিলেটে জাগরণমঞ্চে হামলা হয়েছে। সিলেটে ভাংচুর করা হয়েছে শহীদ মিনার। হামলার অন্যতম লক্ষ ছিলেন সংবাদ কর্মীরাও।

পুলিশ বলছে, ইসলামী ১২ দলের কর্মসূচিকে ব্যবহার করে জামায়াতে ইসলামী কর্মীরা এই সহিংসতা চালিয়ে থাকতে পারে।

যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসি ও জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধের দাবিতে শাহবাগের আন্দোলনকারীরা শুক্রবার সব ধর্মের উপাসনালয়ে প্রার্থনা ও দোয়ার কর্মসূচি দেয়ার পর ‘ধর্ম অবমাননাকারী’ ব্লগারদের শাস্তি এবং ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ‘ষড়যন্ত্রে’র প্রতিবাদে ইসলামী ও সমমনা ১২ দলসহ কয়েকটি সংগঠনের ব্যানারে সারাদেশে জুমার পর বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দেয়া হয়।

দেশব্যাপী আন্দোলনের মধ্যেই বৃহস্পতিবার বিভিন্ন বাহিনীকে একটি গোয়েন্দা বার্তা পাঠানো হয়, যাতে শাহবাগ, বায়তুল মোকাররম মসজিদ, সচিবালয়সহ গুরুত্বপূর্ণ স্থানে আত্মঘাতী হামলার মতো নাশকতার আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়।

গোয়েন্দা সংস্থার পাঠানো বার্তায় বলা হয়, “আমাদের সূত্রগুলো নিশ্চিত করেছে, রাষ্ট্রবিরোধী চক্র দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নাজুক করে তুলতে আত্মঘাতী হামলাসহ বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে।”

ইসলামী দলগুলোর কর্মসূচি ও নাশকতার আশঙ্কার কারণে সকাল থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধি কামাল তালুকদার জানান, শুক্রবার দুপুর পৌনে ১টার দিকে রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতর থেকে উত্তর গেইটের দিকে রাস্তায় অবস্থান নেয়া পুলিশের দিকে ঢিল ছোড়া হয়।

এ সময় মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আব্দুল্লাহ তুহিন ও এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান ইমরান তুহিন ছবি তুলতে তুলতে মসজিদের দিকে এগোলে কয়েকজন তাদের মারধর করে।

পরে জুমার নামাজ শেষে ইসলামী সংগঠনগুলোর কর্মীরা বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে প্রেসক্লাবের দিকে এগোনোর সময় তোপখানা রোডে ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তৈরি তোরণ ভাংচুর করে।

এক পর্যায়ে তারা পুলিশের ওপর হামলা চালালে শুরু হয় সংঘর্ষ। পুলিশ পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে রাবার বুলেট ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকে। অন্যদিকে হামলাকারীরা বৃষ্টির মতো ঢিল ছুড়তে থাকে। এ সময় বেশ কিছু হাতবোমা বিস্ফোরণেরও শব্দ পাওয়া যায়।

সহিংসতা ঠেকাতে পুলিশ শটগানের ছররা গুলি ব্যবহার করে। এ সময় চার সাংবাদিক, দুই পুলিশসহ অন্তত ২৩ জন আহত হন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। 

এদের মধ্যে গাজী টেলিভিশনের প্রতিবেদক মাসুদুর রহমান, দৈনিক সংবাদের প্রতিবেদক সাইফ বাবলু, ইন্ডিপেনডেন্ট টেলিভিশনের ক্যামেরা পার্সন নুরুল ইসলাম, দৈনিক জনকণ্ঠের আলোকচিত্রী সাংবাদিক শেখ মামুন রশীদকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।

সংঘর্ষ চলাকালে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সামনে আহত হনঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) আপ্যায়ন সম্পাদক আমিনুল হক ভূঁইয়াও।

এছাড়া কাপ্তানবাজার এলাকায় বিক্ষোভকারীদের ছোড়া ইটের আঘাতে আহত ওয়ারী থানার কনস্টেবল আব্দুল জলিলকেও (৪০) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।

প্রায় দেড় ঘণ্টা সংঘর্ষ চলাকালে শাহবাগ থেকে মতিঝিলমুখী রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ থাকে।

দুপুর আড়াইটার দিকে বায়তুল মোকাররম মসজিদের ভেতর আটকে পড়া সাধারণ মুসল্লীদের বেরিয়ে আসার জন্য পুলিশ হ্যান্ড মাইকে ঘোষণা দিতে থাকে।

মসজিদের উত্তরে গেইট থেকে মাইকে বলা হয়, “ভিতরে যারা সাধারণ মুসল্লী আছেন তারা বেরিয়ে আসুন। আমরা আপনাদের নিরাপত্তা দেব। আপনারা বেরিয়ে এলে ভেতরে থাকা সন্ত্রাসীদের ওপর আমরা আইন প্রয়োগ করব।”

নামাজের পর কাঁটাবন মসজিদ থেকেও ইসলামী সংগঠনগুলোর কর্মীরা মিছিল নিয়ে বের হয়ে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়ায়। পুলিশকে লক্ষ্য করে বৃষ্টির মতো ঢিল ছুঁড়তে শুরু করে তারা। পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস ব্যবহার করে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।

এ সময় লালবাগ পুলিশের সহকারী কমিশনার (পেট্রোল) রেজাউল করিম আহত হন বলে একজন পুলিশ কনস্টেবল জানান।   

সংঘর্ষের পর কাঁটাবন মসজিদ এলাকা থেকে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দিকে যাওয়ার সময় একটি মাইক্রোবাস থেকে দুজনসহ মোট চারজনকে আটক করে শাহবাগ থানা পুলিশ।

পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ কমিশনার শেখ নাজমুল আলম সাংবাদিকদের বলেন, “ইসলামী ও সমমনা ১২ দলের নেতারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন, তারা বলেছিলেন ব্লগে ইসলাম নিয়ে কটূক্তির প্রতিবাদে তারা মসজিদের সামনে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করবেন। এ প্রতিশ্রুতিতেই তাদের কর্মসূচি পালনের অনুমতি দেয়া হয়।

“কিন্তু তাদের মিছিল নির্ধারিত এলাকা পেরিয়ে প্রেসক্লাবের দিকে যায় এবং ব্যাপক ভাংচুর করা হয়। এ কারণে পুলিশ টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট ছুড়তে বাধ্য হয়েছে।”

গত তিন মাস ধরে সারা দেশে বিভিন্ন স্থানে সহিংসতা চালিয়ে আসা জামায়াত কর্মীরা অন্য ইসলামী সংগঠনের কর্মসূচিকে ব্যবহার করে সংঘাতে জড়াচ্ছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন,   

“আমার কাছে তেমনই মনে হচ্ছে। বিষয়টি আমার খতিয়ে দেখব।”

নামাজের আগে কয়েকজন মুসুল্লিও জানান, খেলাফত মজলিশ, খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোটসহ সমমনা দলগুলোর পেছনে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা ইন্ধন যোগাচ্ছে।

মিরপুর ১১ থেকে ১০ নম্বর গোলচক্কর পর্যন্ত এলাকায় গণজাগরণ মঞ্চবিরোধীদের মিছিল শুরু হয়। পুলিশ বাঁধা দিলে শুরু হয় সংঘর্ষ।

পরে পুলিশ লাঠিপেটা করে মিছিলকারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এ সময় অন্তত পাঁচজনকে আটক করা হয়।    

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দোয়েল চত্বর থেকে হাইকোর্টের দিকের রাস্তার মাঝামাঝি স্থানে দুপুর সোয়া ২টার দিকে ৮-১০টা ককটেল বিস্ফোরিত হয়।

এ সময় সেখানে উপস্থিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এনামুল জানান, ককটেল বিস্ফোরণের সঙ্গে সঙ্গে ওই এলাকায় মানুষ ছুটোছুটি শুরু করে। বিস্ফোরণে একজন পথচারীও আহত হন।