জাকির নায়েক: বিতর্ক যার সঙ্গী

জঙ্গিবাদে প্ররোচনার অভিযোগে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ হওয়া পিস টিভির মালিক ভারতের ইসলামী বক্তা জাকির নায়েককে ঘিরে বিতর্ক বহু দিনের।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2016, 12:27 PM
Updated : 14 July 2016, 11:14 AM

ঢাকার গুলশানে গত ১ জুলাইয়ের জঙ্গি হামলায় জড়িতদের মধ্যে অন্তত দুজন জাকির নায়েকের মতো ইসলামি বক্তাদের অনুসরণ করতেন বলে অভিযোগ ওঠার পর নতুন করে আলোচনায় এসেছেন ভারতের মহারাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া জাকির নায়েক।

চিকিৎসা শাস্ত্রে লেখাপড়া করা নায়েক বিভিন্ন সময়ে ইসলাম ধর্ম, জঙ্গিবাদ, জিহাদ নিয়ে বক্তব্যের জন্য বিতর্কিত হয়েছেন; নিষিদ্ধ হয়েছেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে।

গত বছর উসকানিমূলক কথাবার্তা বলার অভিযোগে ভারতের কর্নাটক রাজ্যে তাকে নিষিদ্ধ করা হয়৷ আর গুলশানের খুনিদের আগ্রহের বিষয়টি উঠে আসার পর নায়েকের বিরুদ্ধে ভারতে শুরু হয় নতুন তদন্ত।

১৯৬৫ সালে মুম্বাইয়ে জন্ম নেওয়া জাকির নায়েক কিষানচাঁদ চেলারাম কলেজের পর টোপিওয়ালা ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজে মেডিসিন বিষয়ে পড়ালেখা করেন। পরে বিওয়াইএল নায়ার চ্যারিটেবল হাসপাতালেও তিনি লেখাপড়া করেন।

১৯৮৭ সালে ইসলামী বক্তা আহমেদ দিদাতের সংস্পর্শে আসেন নায়েক। এর কয়েকবছর বাদে ১৯৯১ সাল থেকে শুরু করেন ধর্ম প্রচারের কাজ।

এরই ধারাবাহিকতায় গড়ে তোলেন ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন (আইআরএফ); এই ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানেই চলে পিস টিভির কার্যক্রম।

সুবক্তা হিসেবে পরিচিত জাকির নায়েক তার অসাধারণ স্মরণশক্তির জন্যও খ্যাত। যে কোনো বক্তৃতায় তাকে কুরআন, গীতা কিংবা বাইবেলের যে কোনো পাতা, যে কোনো অংশ থেকে অনর্গল উদ্ধৃত করতে দেখা যায়।

বিভিন্ন সময়ে টেলিভিশন অনুষ্ঠানে ধর্মীয় আলোচনায় হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মের উপর নিজের দখলের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ফলে অল্প সময়ের মধ্যে ভারতের গণ্ডি পেরিয়ে তার জনপ্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলমানদের মধ্যে।

জাকির নায়েকের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ ভারতে

তবে সেই সঙ্গে তার কিছু বক্তব্যকে জঙ্গিবাদের প্রতি তার সমর্থন হিসেবে চিহ্নিত করেন অনেকে; এ নিয়ে তার সমালোচনা চলতে থাকে।

ভারতের কয়েকজন মুসলমান পণ্ডিত জাকির নায়েককে ‘সৌদি আরবের পৃষ্ঠপোষকতায় ওহাবি মতবাদ প্রচারকারী’ হিসেবে সন্দেহের চোখে দেখেন।

অন্যদিকে সৌদি আরব সরকার নায়েককে ‘ইসলামের সেবক’ বিবেচনা করে ২০১৫ সালে ‘বাদশাহ ফয়সাল আন্তর্জাতিক পুরস্কার’ দেয়।

ভারতের আল্লামা সাইয়্যিদ খালিক সাজিদ বোখারী কয়েক বছর আগে ড. জাকির নায়েকের বিপক্ষে একটি বই লেখার পর বাংলাদেশেও হক্কানি আলেমরা তার সমালোচনায় মুখর হন।

মাওলানা নূরুল ইসলাম ওলীপুরী বলেন, “জাকির নায়েক আলেম বলে আমি কোনো প্রমাণ পাইনি।”

আশিক্কীনে আউলিয়া ঐক্য পরিষদ বাংলাদেশের সভাপতি শাহ সূফী সাইয়েদ আলম নূরী আল-সুরেশ্বরী বলেন, “ডা. জাকির নায়েকের বক্তব্য ইসলাম ধর্ম ও এর অনুসারীদের বিভ্রান্তিতে নিপতিত করছে।”

আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতও জাকির নায়েকের ধর্মীয় ব্যাখ্যার বিরোধিতা করে আসছে।

ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের চেয়ারম্যান মিছবাহুর রহমান মনে করেন, জাকির নায়েকের দর্শন জামায়াতে ইসলামীর দর্শনের ‘কাছাকাছি’।

আর বাংলাদেশে পিস টিভি নিষিদ্ধের কারণ ব্যাখ্যা করে তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, “পিস টিভি বহু ক্ষেত্রে মুসলমান সমাজের কোরান, সুন্নাহ, হাদিস, বাংলাদেশের সংবিধান, দেশজ সংস্কৃতি, রীতি-নীতি, আচার-অনুষ্ঠানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।”

নায়েক উবাচ

# সৃষ্টিতত্ত্ব: ডারউইনের বিবর্তনবাদ কেবল একটি তত্ত্ব মাত্র, বাস্তবতা নয়; আমি বিশ্বাস করে সৃষ্টিতত্ত্বে।... আমি একজন ডাক্তার, এ বিষয়ে আমি বোকাদের সঙ্গে তর্ক করতে চাই না।

# সন্ত্রাসবাদ: সন্ত্রাসীদের ভয় দেখাতে হলে সব মুসলমানকেই টেররিস্ট হতে হবে। ওসামা বিন লাদেন যদি ইসলামের শত্রুদের বিপক্ষে লড়েন, আমি তার পক্ষে আছি। তিনি যদি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী আমেরিকার বিরুদ্ধে ত্রাস সৃষ্টি করেন, আমি তার পক্ষে আছি।   

# নাইন-ইলেভেন: ওই হামলার জন্য আল কায়েদা দায়ী নয়। এমন কি একজন বোকাও বলবে, ওই ঘটনা তারা (যুক্তরাষ্ট্র) নিজেরাই ঘটিয়েছে।

# সমকাম প্রসঙ্গে: তারা পাপিষ্ঠ, মানসিক অসুস্থতায় তারা ভুগছে। সমকামের শাস্তি হওয়া উচিৎ মৃত্যুদণ্ড।

# অন্য ধর্ম: ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো ধর্ম আল্লাহ গ্রহণ করবেন না। গির্জা আর মন্দির বানানো আমরা কীভাবে সমর্থন করতে পারি, যেখানে তাদের ধর্মই ভ্রান্ত? 

# অন্য ধর্মে বিয়ে: যদি আপনার একটি বাহন থাকে যার এক টায়ার সাইকেলের, আরেকটি ট্রাকের, তাহলে সেই বাহন চলবে না। যে মুসলমান মেয়ে কোনো হিন্দু ছেলেকে বিয়ে করবে, তাকে আল্লাহ কখনও ক্ষমা করবেন না। তার উচিৎ হবে স্বামীকে আল্টিমেটাম দেওয়া, যাতে সে ইসলাম গ্রহণ করে।

# পোশাক: শরীর দেখানো যদি আধুনিকতা হয়, তাহলে পশুরা মানুষের চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক।

২০১০ সালে ব্রিটেন জাকির নায়েককে নিষিদ্ধ করার তিন বছর পর বিবিসি-তে একটি বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়; যেখানে বলা হয়, তাকে নিষিদ্ধ করা হলেও ব্রিটেনের লাইব্রেরিতে তার বই রয়েছে৷

বিবিসির ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, লন্ডনের পাবলিক লাইব্রেরিতে জাকির নায়েকের অন্তত তিনটি বই রয়েছে, যেগুলোতে তিনি জঙ্গিবাদ, নারী এবং ইহুদিদের বিষয়ে ‘চরম আপত্তিকর’ মন্তব্য করেছেন৷

পিস টিভি, তার প্রচারসঙ্গী

উর্দুতে লেখা একটি বইয়ে জাকির নায়েক বলেছেন, তিনি ‘মৌলবাদী হতে পেরে গর্বিত'৷ প্রত্যেক মুসলমানেরই ‘জঙ্গি হওয়া উচিৎ’ এমন বক্তব্যও উঠে এসেছে তার জবানিতে।

পিস টিভি, তার প্রচারসঙ্গী

তবে সাম্প্রতিক বিভিন্ন বক্তব্যে জাকির নায়েক নিজেকে জঙ্গিবাদবিরোধী বলে দাবি করেছেন। এক অনুষ্ঠানে তিনি আইএসের কর্মকাণ্ডেরও সমালোচনা করেন।

মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক ওই উগ্র সংগঠনটিকে ‘এন্টিইসলামিক স্টেট অফ ইরাক অ্যান্ড সিরিয়া’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তিনি বলেন, “কুরআনে বলা আছে, যদি কেউ কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করে, তাহলে নিহত ব্যক্তি মুসলিম-অমুসলিম যা-ই হোন না কেন, সেই হত্যা পুরো মানবতাকে হত্যার শামিল৷

“….এখন যারা নিজেদের ‘আইএস' বলে দাবি করে, তারা নিরপরাধ মানুষকেই তো হত্যা করছে৷ নিরপরাধ অমুসলিমদের হত্যা করার কথাও কোরআনে বলা নেই৷ তাই আমার মতে, তারা (আইসিস বা আইএসআইএস বা আইএস) মুসলমানই হতে পারে না।”

কিন্তু আল কায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন সম্পর্কে মূল্যায়ন জঙ্গিবাদের বিপক্ষে তার অবস্থানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয়।

অবশ্য নিজের অবস্থান ব্যাখ্যা করে সর্ব সাম্প্রতিক এক ভিডিও বার্তায় নায়েক বলেন,“সারা বিশ্বে আমার কোটি কোটি ভক্ত আছে। বাংলাদেশের অর্ধেক মানুষই আমার ফ্যান। কিন্তু আমি তাকে মানুষ খুন করতে উৎসাহ দিয়েছি- এটা বলা শয়তানি।”