কলম্বিয় এবং বাংলা সাহিত্য: কোনো সাদৃশ্য আছে কি?

আন্দ্রেস মাউরিসিও মুনঞস
Published : 28 Feb 2018, 06:09 PM
Updated : 28 Feb 2018, 06:09 PM


গত ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমি কর্তৃক আয়োজিত আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনে কলম্বিয় লেখক আন্দ্রেস মাউরিসিও মুনঞস যে-বক্তৃতা স্প্যানিশ ভাষায় দিয়েছিলেন তার বাংলা তর্জমা এখানে উপস্থাপিত হলো। তর্জমা করেছেন কবি-প্রাবন্ধিক রাজু অালাউদ্দিন ও অনুবাদক আনিসুজ্জামান

আন্দ্রেস মাউরিসিও মুনঞস

জন্ম কলম্বিয়ার পোপইয়ান-এ ১৯৭৪ সালে। ২০০৬ সালে Libros y Letras আয়োজিত সাহিত্য প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্ত আন্দ্রেস পরবর্তী বছর ২০০৭ সালে Premio Literario Fundacion Gilberto Alzate Avendaño পুরস্কারে অভিষিক্ত হন। ২০১১ সালে Premio Nacionales de Literatura Libros y Letras কর্তৃক সেই বছরের শ্রেষ্ঠ পাঁচটি গ্রন্থের একটি হিসেবে Desasosiegos Menores বইটিকে নির্বাচিত হয়। তার বইগুলো ইতিমধ্যে আরবী, জার্মান ও ইতালিয় ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তার অন্যান্য উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে: El Ultimo Donjuan ( 2016) এবং Hay dias en que estamos idos( 2017)

প্রথমেই আমি বলতে চাই যে এক বীরোচিত ঘটনার উদযাপন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের জন্য আমাকে আমন্ত্রণ জানানোয় খুবই গর্বিত অনুভব করছি। এই বীরোচিত ঘটনাটি ছিল আসলে এক ন্যায়সঙ্গত লড়াই যা আমাদের ভাষাকে, আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষার জন্য করা হয়েছিল। আর ভাষা হচ্ছে আমাদের অস্তিত্বের চূড়ান্ত ভিত্তি।
আমি এসেছি এমন এক দেশ থেকে যেখানে স্প্যানিশ ভাষার মহান লেখকদের একজন জন্মগ্রহণ করেছেন, যিনি গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস নামে পরিচিত। তিনি এমনই একজন যিনি কেচ্ছাকে তুলে এনেছেন, যা যুগ যুগ ধরে আমাদের পূর্বপুরুষদের মাঝে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে উঠেছে এবং তা এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে আছে। মার্কেস জানতেন ওরাল ট্র্যাডিশন, এছাড়া জানতেন স্বতঃস্ফূর্ত উপায় অবলম্বনের মাধ্যমে কিভাবে আমাদের পূর্বপুরুষদের মুখ-নিসৃত কিংবদন্তীকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় এবং তাকে প্রজন্মের পর প্রজন্মে ধরে রাখা যায়। ইনি সেই লেখক যিনি ভাষাকে পৌঁছে দিয়েছেন তার উচ্চতম আসনে। যিনি জন্ম দিয়েছেন নতুন এক ধারার, সমালোচকরা যার নামকরণ করেছেন ম্যাজিক রিয়ালিজম বলে, যার হাতে সত্যিকার অর্থেই ছিল জাদু। তার প্রধানতম কাজ নিঃসঙ্গতার একশ বছর যেখানে আউরেলিয়ানোদের, আর্কাদিওদের, উরসুলাদের, রেমেদিওসদের বংশধরদের কথা বলা হয়েছে, আর ওরাই হচ্ছে আমাদের বর্তমান সমাজের মানচিত্র। ওরাই হচ্ছে সেই বিস্মৃত ব্রাত্য-উত্তরাধিকারী।

এখানেও আছেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা হুমায়ূন আহমেদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কথাসাহিত্যিক। হুমায়ূন আহমেদ যিনি কিছুদিন আগে চলে গিয়ে জাতিকে শোকে মুহ্যমান করে রেখেছেন। উনি এমন এক লেখক যিনি তার সাহিত্যে তুলে ধরেছেন মধ্যবিত্ত সমাজের হৃদয়, দুঃখবেদনা ও দৈনন্দিন যন্ত্রনাকে। স্রষ্টা হিসেবে এই ধরনের সাহিত্যের প্রতিই আমার আগ্রহ প্রবল। আমার প্রথম গল্পের বই সামাজিক অস্থিরতা নিয়ে, দ্বিতীয়টি দৈনন্দিন জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অবক্ষয় নিয়ে যা আমাদের জীবনকে গ্রাস করে। আমার প্রথম উপন্যাস ইন্টারনেট যুগের প্রেম-ভালোবাসা নিয়ে। আর শেষ গল্পের বইটি হচ্ছে জীবনের কাকতালীয় ঘটনার গুরুত্বকে নিয়ে।
কিন্তু যখন হুমায়ূন আহমেদের কথা ভাবি, আর তার প্রচণ্ড লেখনি-শক্তির কথা যা তৈরি করে এমন সব চরিত্র যারা কাগজের বুক থেকে উপচে পড়ে যুগ যুগ ধরে বংশানুক্রমিকভাবে বাড়তে থাকে এবং মিশে যায় তাদের জীবনের সঙ্গে, যেমনটি তিনি তৈরি করেছেন 'বাকের ভাই' চরিত্রের মাধ্যমে। কিন্তু এটাই তার একমাত্র পরিচয় নয় যার সঙ্গে আমার মিল আছে, কারণ তিনি নিজেই তার এক আলাপচারিতায় বলেছেন যে পড়াশুনা এক জিনিস আর জীবন আরেক জিনিস। ওর মতো যদিও আমিও লেখাপড়া করেছি ইলেকট্রনিক্স ও টেলি কমিউনিকেশন, তবুও জীবন থেকে কিছু কিছু সময় চুরি করে মগ্ন হয়েছি আমার চরিত্রগুলিকে জীবন দিতে, তাদেরকে এমন এক জগত দিতে যেখানে তারা চলাফেরা করবে।
খুব সম্ভবত, পাশ্চাত্য সাহিত্য সম্বন্ধে যা বলতে পারি তাহলো বাংলা সাহিত্যের কাছে তাদের কিছু ঋণ আছে, যদিও খুঁজলে অনেকের নামই উঠে আসে, উঠে আসবে অনেক গভীর দর্শন তবু তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যার জীবন-দর্শন আমাদের পুষ্টি জোগায় এবং আরও গভীরভাবে এই সাহিত্যকে জানতে উদ্বুদ্ধ করে।


আমাদের এক প্রধান কবি রাউল গোমেজ হাত্তিন যিনি প্রাচ্যের সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলা সাহিত্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। আপনাদের চরিত্রের আধ্যাত্মিকতা এবং মানবচরিত্রকে মূল্যায়নের ক্ষমতা প্রাণের অস্তিত্বের ভিত্তিকে দৃঢ় করে। কলম্বিয়ান লেখক পাউল ব্রিত, হাত্তিন সম্বন্ধে এক প্রবন্ধে লিখেছেন " যদিও কলম্বিয়ান কবি রাউল গোমেজ হাত্তিন ড্রাগ, পাগলামী, ভিক্ষাবৃত্তি এবং সর্বশেষে ১৯৯৭ সালেরে ২২শে মে'তে কার্তাহেনায় নিজেকে দুঃখজনকভাবে শেষ করে দিয়েছেন বাসের চাকার নিচে, তবুও তার কবিতা এখনও অব্যাহত সুক্ষ্ণতায় ছড়িয়ে পরছে। "আমার কবিতা হচ্ছে অধিবিদ্যা"—এমনই বলেছিলেন তিনি। তার কবিতার সুর ছুঁতে পারতো এক্কেবারে নিচু স্তরকে আর রক্ষা করতে পারত সৌন্দর্য ও উন্মত্ততার ভারসাম্য। তার বিশ্বাস ছিল পৃথিবীর প্রতিটি মানুষই যুগপৎ অনন্য ও অভিন্ন, যেমনটি বিশ্বাস করতেন বোর্হেস, শোপেনহাওয়ার এবং হিন্দু-মুসলিম সুফি দর্শনও। হাত্তিন চিন্তা ও বিশ্বাসের উর্ধে উঠে এমন গভীরভাবে অনুভব করেছিলেন যে সমাজের এই ভিন্নতার দুঃখ তাকে নিয়ে গিয়েছিল সম্পূর্ণভাবে নিজেকে ধ্বংসের দিকে। উপরন্তু, তিনি অবাধ মিলনেও বিশ্বাসী ছিলেন এবং ব্যক্তিগতভাবে নিজেও তাতে লিপ্ত ছিলেন। শুধুমাত্র তাই নয়, টেলিপ্যাথির মাধ্যমে তার যোগাযোগ ছিল সি পি কাভাফি ও প্লাতোনের সাথে, যিনি কবিতা লিখতেন আর কার্তাহেনা বেইয়াস আর্তেস স্কুলের ছাত্রদের কাছে সামান্য পয়সার বিনিময়ে বিক্রি করে দিতেন। " তুলনা করতে হলে বলা যায়, প্রাচ্য হচ্ছে প্রাণের একমুখী অসীমতা নিয়ে বেঁচে থাকা আর পাশ্চাত্য হলো বহুমুখী প্রয়োজনীয়তার সমন্বয়।
প্রশ্ন হতে পারে বর্তমান কলম্বিয়ান সাহিত্য ও বাংলাসাহিত্য কী সূত্রে বাধা? উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে তমাস গনসালেস ও এবেলিও রোসেরোদের নাম, যারা কিনা বর্তমানের সবচেয়ে শক্তিশালী লেখক, যাদের লেখনীর মাধ্যমে এটাই প্রকাশিত হয় যে প্রাণ শুধু প্রাণই নয়, প্রাণ হচ্ছে মানবসত্তার গভীরতম অবলোকন।

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক এবং গুরুত্বপূর্ণ লেখক শামসুজ্জামান খান আমাকে এই অনুভূতি জানাবার সুযোগ করে দিয়েছেন বলে তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই। ধন্যবাদ জানাই শ্রোতাদেরকেও ধৈর্য ধরে এসব কথা শুনবার জন্য।