সাহসিনী তিনকন্যা

যুক্তরাজ্যের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে লন্ডন শহরে ঘুরে প্রার্থীদের প্রচারের আবহ তুলে এনেছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী

>>বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2015, 01:15 PM
Updated : 6 May 2015, 01:15 PM

নির্বাচনের তিন দিন আগে পূর্ব লন্ডনের পথে পথে হেঁটে রুশনারা আলী যখন প্রচার চালাচ্ছিলেন, আত্মবিশ্বাস ফুটে বেরোচ্ছিল তার চোখেমুখে।     

বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো আসনের ৮০ হাজার ভোটারের মধ্যে প্রায় অর্ধেকই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক। এ আসনের খোঁজখবর যারা রাখেন, তারা অনেকটাই নিশ্চিত যে সিলেটের বিশ্বনাথের মেয়ে রুশনারাকে আরও পাঁচ বছর ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দেখা যাবে।

অক্সফোর্ডে লেখাপড়া করা এই রাজনীতিবিদ মঙ্গলবার ভোটের প্রচারের এক ফাঁকে ব্রিক লেন মসজিদে আসেন এবং ইংরেজি ও সিলেটি মিশিয়ে প্রাণবন্ত বক্তব্য দেন স্থানীয় বাংলাদেশি কমিউনিটির জনা ত্রিশেক প্রতিনিধির সামনে।

 

রুশনারা বলেন, কেবল তাকে এই আসনে বড় ভোটের ব্যবধানে জয়ী করলেই হবে না, লেবার পার্টিকেও বিজয়ী করে ক্ষমতায় পাঠাতে হবে।  

কমিউনিটি নেতারাও তাদের ‘কন্যাসম’ রুশনারার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান; লেবার পার্টিকে সমর্থনের কথা বলেন।    

বাংলাদেশে আলাদা দলের সমর্থক হলেও ব্রিটেনের জীবনে লেবার পার্টির প্রতি সাধারণ বাঙালিদের অকুণ্ঠ সমর্থনের বিষয়টিও উপস্থিত সবাইকে মনে করিয়ে দেন বয়ঃজ্যেষ্ঠ একজন।

“এরপর তিনি (রুশনারা) যখন আবার এখানে আসবেন, মন্ত্রী হিসেবেই আসবেন বলে আমার বিশ্বাস”, বলেন আরেকজন।  

সাধারণ এক কর্মজীবী বাঙালির মেয়ে রুশনারা হলেন তার পরিবারের প্রথম সদস্য, যিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন।

তিনি দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে ডিগ্রি নিয়েছেন অক্সফোর্ডের সেইন্ট জন’স কলেজ থেকে, যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আরও অনেকেই এখন ব্রিটেনের তারকা রাজনীতিবিদ।     

সমর্থকদের বিশ্বাস, লেবার নেতা এড মিলিব্যান্ড যদি শেষ পর্যন্ত ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের দখল পান, তাহলে সিলেটের মেয়ে রুশনারাও মন্ত্রী হবেন।  

ব্রিটিশ বাঙালিদের এই ‘তিন কন্যা’ ভোটে লড়ছেন লেবার পার্টির হয়ে। এবার মোট ১১ জন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রাজনীতিবিদ নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেও এ তিনজনের কাছেই বাংলাভাষী ভোটারদের প্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি।   

বাঙালি ভোটারদের সংখ্যাধিক্যের কারণে বেথনাল গ্রিন অ্যান্ড বো লেবার পার্টির অন্যতম ‘নিরাপদ আসন’ হিসাবে বিবেচিত।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সৈয়দ নাহাস পাশার মতো অনেকেরই ধারণা, গত নির্বাচনে সাড়ে ১১ হাজার ভোটে জয়ী রুশনারা এবার ব্যবধান আরও বাড়াতে যাচ্ছেন।        

অবশ্য বাকি দুই কন্যার অবস্থা ৪০ বছর বয়সী রুশনারার মতো ‘অতোটা’ নিশ্চিত নয়।

৪৩ বছর বয়সী রূপা হক এ নির্বাচনে লড়ছেন ইলিং সেন্ট্রাল অ্যান্ড অ্যাকটন আসনটি রক্ষণশীলদের হাত থেকে পুনরুদ্ধারের জন্য।

২০১০ সালের নির্বাচনে এ আসনে লেবার প্রার্থীকে হারতে হয়েছিল প্রায় চার হাজার ভোটের ব্যবধানে। ওই ফল উল্টে দেওয়ার কাজটি এবার ড. রূপার সামনে।

ব্রিটেনে ৭০ হাজার ভোটারের একটি আসনে, যেখানে গড়ে ৬৫ শতাংশের মতো ভোট পড়ে, সেখানে কাজটি মোটেও সহজ নয়। তবে ভোটের দুই দিন আগে স্থানীয় একটি ক্যাফেতে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে রূপা হককে বেশ নির্ভারই মনে হল।             

এবার বাংলাদেশি কমিউনিটি কেন লেবারকে ভোট দেবে তার একটি ব্যাখ্যাও তিনি দিলেন ভোটের প্রচারে সঙ্গে থাকা একদল সমর্থককে পাশে নিয়ে। বললেন, “লেবার পার্টিই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়ে।”

শিক্ষকতার পেশায় থাকা রূপা হক এর আগে ডেপুটি মেয়র হিসাবে স্থানীয় সরকারে দায়িত্ব পালন করেছেন। নিজের বাঙালি পরিচয় নিয়েও তিনি গর্বিত।

 

শুরুতেই তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম প্রতিবেদকের কাছে জানতে চান, সাক্ষাৎকার বাংলায় হবে, না ইংরেজিতে।

রূপ হক কেমব্রিজে পড়েছেন রাজনীতি, সামাজিক বিজ্ঞান ও আইন। আর পড়াচ্ছেন সমাজ বিজ্ঞান, অপরাধ বিজ্ঞান, গণমাধ্যম ও সংস্কৃতি অধ্যায়নের মতো বিষয়। তার পিএইচডি অভিসন্দর্ভটি ছিল তারুণ্যের সংস্কৃতি নিয়ে। এ জন্য বেশ কিছুদিন তাকে ফ্রান্সেও থাকতে হয়েছে।

লেখক, মিউজিক ডিজে, যুক্তরাজ্যের কয়েকটি প্রধান দৈনিকের কলামনিস্ট হিসাবে পরিচিতি থাকার পরও অনেক সময়ই রূপা হকের পরিচয় দিতে গিয়ে তার ছোট বোনের নামটি উল্লেখ করেন অনেকে। বিবিসির ব্লু পিটার শো উপস্থাপনার কল্যাণে কনি হকের নাম ব্রিটিশদের কাছে খুবই পরিচিত।   

রূপার পশ্চিম লন্ডনের এই আসন থেকে কয়েক মাইল দূরে হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসনের পরিস্থিতি আরও একটু কঠিন। সেখানে ভোটের লড়াইয়ে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তিন প্রার্থীর মধ্যে, যাতে লেবার পার্টির হয়ে লড়ছেন আরেক বাঙালি কন্যা। 

আগামী সেপ্টেম্বরে ৩৩ বছরে পা দেবেন ছোটখাট গড়নের টিউলিপ সিদ্দিক, যাকে নিয়ে এবারের নির্বাচনে ব্রিটিশ বাংলাদেশি এবং দক্ষিণ এশীয় কমিউনিটিতে আগ্রহ সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের রাজনৈতিক বনেদিয়ানার সঙ্গে যোগাযোগ যেন এই ব্রিটিশ রাজনীতিবিদের সামনে এসেছে ‘দুইধারি তলোয়ার’ হয়ে।   

মা শেখ রেহানা গর্বের সঙ্গেই বলেন, তার মেয়ে টিউলিপের এ পর্যন্ত আসার পেছনে পারিবারিক রাজনৈতিক পরিচয় কোনো ভূমিকা রাখেনি। কিন্তু ঠিক ওই কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাতনি টিউলিপকে কিছু নোঙরা রাজনীতির মুখোমুখি হতে হয়েছে।

টিউলিপের খালা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যখনই কোনো ছোটখাট বিষয় সামনে এনেছে, তখনই তা লুফে নিয়ে সমালোচনায় মুখর হয়েছে ব্রিটেনের ডানঘেঁষা সংবাদমাধ্যমগুলো। সম্প্রতি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে একটি গ্রুপ ছবি নিয়ে হৈ চৈ এমনই একটি ঘটনা।

অবশ্য ব্রিটেনের বামপন্থিরাও সবসময় সেই গোষ্ঠীকে সমর্থন দিয়ে এসেছে, যাদের গোড়া বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ডানপন্থীদের ভাবধারায়। এই সমর্থনের পেছনে কোনো তাত্ত্বিক ভিত্তি খুঁজতে যাওয়াও অর্থহীন।

টাওয়ার হ্যামলেটসের পতিত মেয়র লুৎফুর রহমান ও তার ধর্মীয় উগ্রপন্থী সহযোগীদের প্রতি লন্ডনের সাবেক মেয়র কেন লিভিংস্টোনের মতো উজ্জ্বল ব্যক্তিত্বের সমর্থন তারই সাম্প্রতিক নজির।

বাংলাদেশি কমিউনিটির এক নেতা বলেন, “এই ধর্মীয় উগ্রপন্থীদের কেউ কেউ টিউলিপের মতো লেবার প্রর্থীদের বিরুদ্ধে সক্রিয়, কেননা তারা দেশে তাদের লক্ষ্যের সঙ্গে এখানকার বিষয়গুলো এক করে দেখে।”

এ কারণে টিউলিপের সামনে চ্যালেঞ্জ বাকি দুই কন্যার চেয়ে ‘বড়’ বলেই মনে করেন তিনি। 

ব্রিটিশ কোটিপতি এবং তাদের কোটি কোটি পাউন্ডের বিলাসবহুল ম্যানসনের ফাঁকে ফাঁকে দরিদ্র ও বঞ্চিতদের অবস্থান মিলিয়ে জটিল এক আসন এই হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন।  

Tulip Siddiq

নিজের এলাকা ক্যামডেন বরো কাউন্সিলের কেবিনেট সদস্য হিসাবে স্থানীয় স্কুল ও হাসপাতাল রক্ষায় লড়াই করে দরিদ্রদের আস্থা পেয়েছেন টিউলিপ। অন্যদিকে পার্লামেন্ট সদস্য হওয়ার জন্য যে পরিকল্পনা নিয়ে তিনি এগোচ্ছেন তা নিঃসন্দেহে ম্যানসন মালিকদের দুশ্চিন্তায় ফেলছে।

ক্ষমতায় গেলে কর ব্যবস্থা সংস্কারের ঘোষণা রয়েছে লেবার পার্টির; তাতে হ্যাম্পস্টেডের এসব বিলাসবহুল বাড়ির মালিকদের মোটা অংকের সারচার্জের মুখে পড়তে হবে।       

ব্রিটেনের পার্লামেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে অন্যতম হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ে পাঁচ বছর আগে এই আসনে লেবার পার্টিকে ৪২ ভোটের জয় এনে দিয়েছিলেন গ্লেন্ডা জ্যাকসন।

সাবেক এই অভিনেত্রী পেয়েছিলেন ১৭ হাজার ৩৩২ ভোট, যেখানে রক্ষণশীল দলের প্রার্থী পান ১৭ হাজার ২৯০ ভোট। ওই নির্বাচনে লিব ডেম প্রার্থী ছিলেন মাত্র ৭৯৯ ভোট পেছনে। 

কিলবার্ন হাই রোডে টিউলিপের নির্বাচনী কার্যালয়ের কাছে প্রচারের সময় একজন লেবারকর্মী বলেন, “টিউলিপ হয়তো গ্লেন্ডা জ্যাকসন নন, কিন্তু তিনি কঠোর পরিশ্রম করেই এ পর্যন্ত এসেছেন। নিজের নির্বাচনী এলাকার প্রতিটি বাড়িতে তিনি একাধিকবার গেছেন।”  

“প্রচারে তিনি ছিলেন দুর্দান্ত, অবিশ্বাস্য উদ্যম দেখিয়েছেন তিনি”, বলেন এই সমর্থক।

টিউলিপও যথেষ্ট যত্নের সঙ্গে এ দায়িত্বের জন্য নিজেকে গড়ে তুলেছেন। প্রথমে ইংরেজি এবং পরে রাজনীতি, নীতি ও সরকার বিষয়ে তিনি লেখাপড়া করেছেন যুক্তরাজ্যের অন্যতম শীর্ষ দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে।

২০০৮ সালে বারাক ওবামার প্রচারাভিযানে অংশগ্রহণ টিউলিপকে দিয়েছে অভিজ্ঞতা। আর ব্রিটেনের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়ন নিয়ে তার যে আগ্রহ, তার মূলে শিক্ষক বাবার দীর্ঘ অসুস্থতার ইতিহাস কাজ করেছে বলে তিনি জানিয়েছেন।   

 

এই তিন বাঙালি কন্যাই ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস এবং দরিদ্র কমিউনিটিগুলোর জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে এগোচ্ছেন, যা লেবার পার্টিরও অন্যতম মূল প্রতিশ্রুতি। যুক্তরাজ্যের প্রবাসী বাংলাদেশিদের সাহায্য করাও তিনকন্যার অন্যতম লক্ষ্য।     

অবশ্য ভোটারদের দিক থেকে নিঃশর্ত সমর্থন পাওয়ার সম্ভাবনা তাদের সবার জন্য সমান নয়।

যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন বিষয়ক সাবেক জুনিয়র শ্যাডো মিনিস্টার রুশনারা আলীর দাবি, দেশের রাজনীতির কোনো ঘটনা ব্রিটেনে তার ভোটে প্রভাব ফেলবে না; এ বিষয়ে তিনি কথাও বলতে চান না।

লেবার পার্টি ক্ষমতায় গেলে বাংলাদেশ সরকারের জন্য সহযোগিতা অব্যাহত থাকবে বলেও তিনি জানিয়েছেন।  

লন্ডনের বাংলাদেশি রেস্তোরাঁ ব্যবসায়ী আমিন আলীর বিশ্বাস, এই তিন কন্যার আসন এরইমধ্যে লেবার পার্টির ‘হাতে এসে গেছে’।

“আমি নিশ্চিত, আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে এই তালিকায় আমাদের আরও তিনজন যোগ হবেন।... তারা সবাই লেবার পার্টি থেকে এলে আমি খুশি হব। তবে অন্য কোনো দলের হলেও আমার আপত্তি নেই, যদি তারা ব্রিটিশ বাংলাদেশি হন।”

[ছবি ও ভিডিও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন যুক্তরাজ্য প্রতিনিধি সৈয়দ নাহাস পাশা।]