পাকিস্তানের স্কুলে জঙ্গি হত্যাযজ্ঞ

পাকিস্তানের পেশোয়ারে সেনাবাহিনী পরিচালিত একটি স্কুলে বর্বর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে তালেবান জঙ্গিরা, যাতে নিহত হয়েছে ১৩২ শিক্ষার্থীসহ অন্তত ১৪১ জন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 Dec 2014, 08:13 AM
Updated : 16 Dec 2014, 08:13 AM

নিহত শিক্ষার্থীদের বয়স ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, যাদের অনেকেই সেনা কর্মকর্তার সন্তান। জঙ্গি হামলায় একই বয়সী আরও অন্তত ১২১ স্কুলশিশু আহত হয়েছে।

পাকিস্তানে গত কয়েক বছরের মধ্যে ভয়ংকরতম এ হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বিভিন্ন দেশ। দেশটির সরকার তিন দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করেছে।

স্থানীয় গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, মঙ্গলবার দুপুরের আগে আট থেকে ১০ জন জঙ্গি সামরিক পোশাকে খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের রাজধানী পেশোয়ারের আর্মি পাবলিক স্কুলে ঢুকে পড়ে।

খবর পেয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা স্কুলের দিকে অগ্রসর হলে শুরু হয় তুমুল গোলাগুলি। এ সময় ভেতরে বিস্ফোরণের শব্দও পাওয়া যায়।

প্রায় আট ঘণ্টার অভিযানের পর বিদ্যালয়টির নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাসদস্যরা। তখন নয়জন জঙ্গির লাশ পাওয়া যায়, যার মধ্যে তিনজন আত্মঘাতী বিস্ফোরণে প্রাণ হারান বলে রয়টার্স জানিয়েছে। 

জঙ্গি হামলার সময় স্কুলটিতে ১১শর মতো শিক্ষার্থী ছিল জানিয়ে স্থানীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, সাড়ে ৯শর মতো শিক্ষার্থীকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।

পাকিস্তানের জঙ্গি সংগঠন তেহরিক-ই-তালেবান এ হামলার দায় স্বীকার করেছে বলে রয়টার্সসহ পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে বলা হয়েছে।

তালেবান মুখপাত্র মুহাম্মদ উমর খোরাসানি এক বিবৃতিতে বলেন, উত্তর ওয়াজিরিস্তান ও খাইবার উপত্যকায় সামরিক বাহিনীর অভিযানের জবাবেই তাদের এই হামলা।

অন্যদিকে স্কুলশিশুদের ওপর এই হামলায় ক্ষোভ জানিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুখপাত্র আইএসপিআরের ডিজি আসিম বাজওয়া বলেছেন, “মুসলমান তো দূরের কথা, এরা মানুষও বলা যায় না।”

আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী পেশোয়ারে জঙ্গি হামলার খবর পেয়ে রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ছুটে যান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ। জঙ্গি দমনে করণীয় ঠিক করতে বুধবার একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডেকেছেন তিনি।

ক্ষুব্ধ নওয়াজ জঙ্গি দমনে কঠোর হওয়ার ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, “আজ আমাদের যত শিশুর রক্ত ঝরেছে, তার প্রতিটি ফোঁটার প্রতিশোধ আমরা নেব।”

এদিকে স্কুল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার কিছু সময়ের মধ্যে পেশোয়ারে বোমা হামলার মুখে পড়েন নওয়াজের উপদেষ্টা এবং ওই প্রদেশের সাবেক গভর্নর আমির মুকাম।

পাকিস্তানের দৈনিক ডন জানায়, হাসপাতালে শিশুদের দেখে ফেরার পথে রাস্তার পাশে পেতে রাখা বোমার বিস্ফোরণের মধ্যে পড়ে ‍মুকামের গাড়ি। তিনি অক্ষত থাকলেও তার চালক এবং দুই দেহরক্ষী আহত হন।

স্কুলের একজন কর্মীর বরাত দিয়ে পাকিস্তানের জিও টিভির খবরে বলা হয়, দুপুরে আগে জঙ্গিরা যখন স্কুলে ঢুকে পড়ে, তখন স্কুল মিলনায়তনে সেনাবাহিনীর একটি দল শিক্ষার্থীদের প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল।

এক শিক্ষার্থী জানায়, গোলাগুলি শুরু হতেই শিক্ষকরা তাদের শুয়ে পড়তে বলেন। পরে সেনাবাহিনীর লোকজন তাদের বের করে আনে।

বেরিয়ে আসার সময় বারান্দায় সহপাঠীদের রক্তাক্ত লাশ পড়ে থাকতে দেখার কথাও জানিয়েছে ওই শিক্ষার্থী।

স্কুলটির বাসচালক জামশেদ খান বলেন, “আমরা স্কুলের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম। হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলে আর্ত চিৎকার ও হুড়োহুড়ি শুরু হয়ে যায়।”

দীর্ঘ সময়ের অভিযানে স্কুলের ওপর দিয়ে ঘন ঘন সামরিক হেলিকপ্টার উড়তে দেখা যায়। এলাকাটি ঘিরে ফেললেও উদ্বিগ্ন অভিভাবকদের সামাল দিতে হিমশিম খেতে হয় পুলিশকে।

আট ঘণ্টার অভিযানে জঙ্গিরা নিহত হওয়ার পর সংবাদ সম্মেলনে এসে সেনা মুখপাত্র আসিম বাজওয়া বলেন, শিশুদের জিম্মি করার কোনো উদ্দেশ্যই হামলাকারীদের ছিল না।

“তাদের উদ্দেশ্যই ছিল, নিষ্পাপ এই শিশুদের হত্যা করা এবং ঢোকার পর তারা তাই করতে শুরু করে।”

পায়ে গুলিবিদ্ধ এক স্কুলছাত্র হাসপাতালে সাংবাদিকদের বলেন, জঙ্গিরা ঢুকেই ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনি তুলে গুলি চালাতে থাকে। তখন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সবাই শুয়ে পড়ে। প্রাণ বাঁচাতে অনেকে বেঞ্চের নিচে ঢুকে পড়ে।

জঙ্গিরা খুঁজে খুঁজে আহতদের দেহে গুলি চালিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করছিল বলে এই শিশুরা জানায়, যাদের অনেকে দীর্ঘ সময় বন্ধু-সহপাঠীদের লাশের পাশে মরার ভান করে শুয়ে বেঁচে যায়।

শাহরুখ খান নামে ১৫ বছরের একটি শিশু বর্ণনা করেছে, কিভাবে জঙ্গিরা তাদের আহত শিক্ষককে মারে।

“আমাদের একজন শিক্ষকের হাতে গুলি লেগেছিল, তিনি কাতরাচ্ছিলেন। কাতরানির শব্দ শুনে শুনে তাকে বের করে তিনি নিঃশব্দ না হওয়া পর্যন্ত তার ওপর গুলি চালানো হয়।”

শুয়ে থাকা অবস্থায় এক জঙ্গির কালো বুট পরে আসার দৃশ্য বর্ণনা করে আরেক শিশু বলেন, “গলার টাইটি ভাঁজ করে মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলাম, যাতে আমার মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের না হয়।  দুই চোখ বন্ধ করে যতটা পারি মড়ার মতো শুয়ে থাকি, আবারো গুলি খাওয়ার ভয় হচ্ছিল।

“আমি থর থর করে কাঁপছিলাম। মৃত্যুকে এত কাছ থেকে দেখেছি যে, আমার দিকে এগিয়ে আসা কালো বুট জোড়া জীবনেও ভুলব না।”

সেনা মুখপাত্র আসিম বাজওয়া জানান, জঙ্গিরা ১৩২টি শিশু এবং স্কুলের নয়জন শিক্ষক-কর্মীকে হত্যা করেছে।

জঙ্গিরা স্কুলের ভেতরে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন স্থানে ফাঁদ তৈরি করায় এ অভিযানে অনেক সময় লেগে যায় বলে সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে। পেছনের একটি দিক দিয়ে সেনাসদস্যরা স্কুলে ঢুকে পড়ে জঙ্গিদের পরাস্ত করে।

“আমাদের ভাবনায়ও ছিল না, নিরীহ স্কুলশিশুদের ওপর এই রকম কোনো হামলা হতে পারে,” বলেন জঙ্গিদের সঙ্গে লড়াইয়ে থাকা পাকিস্তানের এই সেনা কর্মকর্তা।

এই হামলার কারণ তুলে ধরে তেহরিক-ই-তালেবান মুখপাত্র মুহাম্মদ উমর খোরাসানি এক বিবৃতিতে বলেন, “সরকার আমাদের পরিবার, আমাদের নারীদের টার্গেট করেছে। এ কারণেই আমরা এই আর্মি স্কুলকে বেছে নিয়েছি।”

সাম্প্রতিক সময়ে ওই দুটি এলাকায় জঙ্গি দমনে সেনা অভিযানে কয়েক হাজার তালেবান সদস্য নিহত হয়েছে বলে গণমাধ্যমের খবর।

খোরাসানি বলেছেন, হামলাকারী তালেবান যোদ্ধাদের মধ্যে স্নাইপার ও আত্মঘাতী হামলাকারীও ছিল।

পেশোয়ারে পৌঁছানোর পর নওয়াজ শরিফ বলেন, পাকিস্তানের সেনাবাহিনী জঙ্গি দমনে অভিযান শুরু করায় এই আঘাত এল।

“আমার মনে হচ্ছে, এই দেশ থেকে জঙ্গিবাদ নির্মূল না করা পর্যন্ত এই যুদ্ধ থামবে না। আমরা আফগানিস্তানের বিষয়েও একই কথা বলেছি। আমরা একসঙ্গে এ যুদ্ধে লড়ব।”

এ ধরনের আক্রমণে মনোবল না হারাতে পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ক্ষমতাসীন দল তেহরিক-ই-ইনসাফের চেয়াম্যান ইমরান খানও হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। ১৮ ডিসেম্বর সারা দেশে বিক্ষোভ কর্মসূচিও তিনি স্থগিত করেছেন।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এই হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, নিষ্পাপ শিশুদের ওপর এই বর্বরতা অবর্ণনীয়।

“আজ যারা প্রিয়জনকে হারিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকের জন্য আমার সমবেদনা। আমরাও আপনাদের ব্যথা অনুভব করছি।”

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, এই ধরনের বর্বরতায় বিশ্ববাসী স্তম্ভিত। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এই হামলাকে ধর্মের নামে পৈশাচিকতা বলে আখ্যায়িত করেছেন।

জাতিসংঘ মহাসচিব বান-কি মুনও এই জঙ্গি হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। নিন্দা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা বলেছেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তার দেশ পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে আছে।

যে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই সারাবিশ্বে পরিচিত করার পর নোবেল এনে দিয়েছে মালালা ইউসুফজাইকে, সেই কিশোরী নিজ দেশের শিশুদের এই ট্রাজেডির প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, এই ঘটনা তার হৃদয় ভেঙে দিয়েছে।