ব্রেক্সিটে জিতলেও রাজনীতির খেলায় হেরে যাওয়া নেতা জনসন

তিন বছর আগে এই জুলাই মাসেই বরিস জনসনের বৃহস্পতি ছিল তুঙ্গে, ব্রেক্সিট নিয়ে বেহাল দশায় টেরিজা মে-র পদত্যাগের পর নেতৃত্ব নির্বাচনে জিতে কনজারভেটিভ দলের প্রধানের পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন জনসন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2022, 01:48 PM
Updated : 7 July 2022, 03:33 PM

দেড় যুগের সাংবাদিকতা আর রাজনৈতিক জীবনের নানা উত্থান-পতন পেরোনো জনসন ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ঠিকানা গেড়েছিলেন ১০ ডাউনিং স্ট্রিটে। তিন বছর পর সেই জুলাই মাসেই ১০ ডাউনিং স্ট্রিট ছাড়ার ঘোষণা দিতে হচ্ছে তাকে।

অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি আর লকডাউনের বিধি লংঘন করে মদের পার্টির কেলেঙ্কারির জেরে সমর্থনের পড়তি দশা, দলে একা হয়ে পড়া জনসন এই কিছুদিন আগেও আস্থা ভোটে জিতে দলের ভেতর তার শক্ত অবস্থানের প্রমাণ দিয়েছিলেন।

কনজারভেটিভ দলের নিয়ম অনুযায়ী, কেউ একবার আস্থা ভোটে উৎরে গেলে তার বিরুদ্ধে পরের এক বছর কোনও অনাস্থা প্রস্তাব আনার সুযোগ নেই।

কিন্তু আস্থা ভোটে জিতে গেলেও শেষ পর্যন্ত ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হওয়ার উদাহরণ জনসনের সামনেই ছিল। তার পূর্বসুরি টেরিজা মে আস্থা ভোটে জিতেও ছয় মাসের মাথায় ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয়েছিলেন।

তাই জনসন জুনের আস্থা ভোটে উৎরে গেলেও তার ক্ষমতায় থাকার নিশ্চয়তা পাওয়া যাচ্ছিল না এবং সেই সংশয়কে সত্য প্রমাণ করে তিনি অবশেষে সরে গেলেন।

বৃহস্পতিবারই তিনি দলীয় প্রধানের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রীত্ব ছাড়বেন বলেও ঘোষণা দিয়েছেন। তবে তার আগে নতুন একজন নেতা নির্বাচন কিংবা নতুন প্রধানমন্ত্রী বাছাই না হওয়া পর্যন্ত জনসন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করবেন বলে জানিয়েছেন।

দলের ভেতর অনাস্থা

উদ্ভট কাণ্ড আর উল্টোপাল্টা মন্তব্য করে নিয়মিতই দলের নেতাদের বিব্রত করেছেন জনসন। তার দলের অনেক প্রভাবশালী নেতাই তার কট্টর সমালোচক হয়ে উঠেছিলেন। তারমধ্যে জনসন এ বছরের শুরুতে ক্রিস পিনচারকে দলের ডেপুটি চিফ হুইপের পদে নিয়োগ দিলে দলের অনেক নেতা তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরাসরি আপত্তি জানান। পরে অবশ্য জনসন বলেছেন, তার ওই সিদ্ধান্ত ‘অত্যন্ত ভুল’ ছিল।

দলের ভেতর জনসনের উপর আস্থা কতটা কমে গেছে তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ পাওয়া যায় গত মঙ্গলবার। ওই দিন ১০ মিনিটের ব্যবধানে প্রভাবশালী দুই মন্ত্রী অর্থমন্ত্রী ঋষি সুনাক এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ পদত্যাগ করেন। যদিও তাদের পদত্যাগের পরও ১০ ডাউনিং স্ট্রিট বেশ আত্মবিশ্বাসী ছিল। আশা করেছিল প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ করতে হবে না। কিন্তু ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই তাদের সেই আশা গুড়ে বালি হয়েছে।

ঋষি সুনাক ও সাজিদ জাভিদের সরে দাঁড়ানোর পর পদত্যাগের হিড়িক শুরু হয়। পরদিন আরো বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, জুনিয়র মন্ত্রী এবং জনসনের সহযোগীরা এক কাতারে সামিল হন। পদত্যাগের কারণ হিসেবে তারা সবাই এক সুরেই কথা বলেছেন। সেটা হলো প্রধানমন্ত্রীর উপর আস্থাহীনতা।

মহামারী, লকডাউন ও মদেরপার্টি

বিশ্ব যখন কোভিড-১৯ মহামারীর দখলে, জনসনের ভাগ্যেও যেন শনির দশা শুরু হয়। করোনা ভাইরাসকে শুরুতে গুরুত্ব না দেওয়া এবং এটি প্রতিরোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ না করা বিশ্বনেতাদের একজন জনসন।

পরে অবশ্য তিনি নিজেই এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর দুয়ারে চলে গিয়েছিল। আইসিইউতে তাকে নিয়ে যমে-মানুষে টানাটানি হয়েছে। তিনি মারা গেলে কী হতে পারে সেটা পর্যন্ত ঠিক হয়ে গিয়েছিল।

জনসন সঠিক সময়ে সঠিক সিন্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই ইউরোপের মধ্যে যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ কোভিড-১৯ মহামারীতে আক্রান্ত এবং মারা গেছেন বলে মনে করেন তার সমালোচকরা।

বিশ্ব যখন মহামারীর সেই সঙ্কট কাটিয়ে উঠেছে। ঠিক তখনই সামনে আসে জনসনের মদেরপার্টির কেলেঙ্কারির খবর। ২০২০ সালে লকডাউনের মধ্যে দেশবাসীকে বিধিনিষেধে আটকে রেখে তিনি নিজে তার কার্যালয়ে হওয়া মদপানের পার্টিতে উপস্থিত থেকেছেন। যা ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যমে ‘পার্টিগেইট’ বা ‘পার্টি কেলেঙ্কারি’ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। খবর প্রকাশের পর যা নিয়ে তিনি শুরুতে প্রকাশ্যে মিথ্যাচারও করেছেন।

এছাড়াও, ২০২১ সালের ১৬ এপ্রিলে রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ যখন তার স্বামী প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান, তখনও প্রধানমন্ত্রীর ডাউনিং স্ট্রিটের কার্যালয়ে কর্মীরা আরও দুটো মদের পার্টি করেছিলেন। তখনও বদ্ধ জায়গায় জনসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল, প্রিন্স ফিলিপের মৃত্যুতে চলছিল জাতীয় শোক।

উপ-নির্বাচনে ধরাশায়ী

দলের ভেতর আস্থাহীনতা, মদের পার্টির কেলেঙ্কারিতে নিজের ইমেজ নিয়ে দারুণ সংকটে পড়া জনসনের জন্য মরার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্টের দুটি আসনের উপ-নির্বাচন। যেখানে ধরাশায়ী হয় তার দল কনজারভেটিভ পার্টি। পরাজয়ের মুখে পদত্যাগ করেন দলের সহ-চেয়ারম্যান অলিভার ডাউডেন। জনসনে যে দেশবাসীরও আর আস্থা নেই সেটি যেন ওই উপ-নির্বাচন দিয়েই প্রমাণ হয়ে যায়। তাকে সরিয়ে দেওয়ার আবেদন আরও জোরাল হয়।

বরিস জনসনের জন্ম পরিচয়

পিতৃকূলের দিক থেকে জনসনের আছে একইসঙ্গে ব্রিটিশ ও তুর্কি উত্তরাধিকার। তার দাদার বাবা আলি কামাল ছিলেন অটোমান সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। উদারপন্থি এ সাংবাদিক সুলতানের গ্র্যান্ড উজির (প্রধানমন্ত্রী) ফরিদ পাশার মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

জনসনের দাদার নানি মেরি লুই দে পিফেল ছিলেন উর্তেমবার্গের যুবরাজ পলের বংশধর; সেই সূত্রে গ্রেট ব্রিটেনের রাজা জেমস ওয়ান ও রাজা জর্জ টু-রও বংশধর তিনি।

ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের সাবেক কনজারভেটিভ সাংসদ স্ট্যানলি জনসন ও তার প্রথম স্ত্রী চিত্রকর শার্লট ফসেটের সন্তান আলেক্সান্ডার বরিস দে পিফেল জনসনের জন্ম ১৯৬৪ সালের জুনে, যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কে।

রাজনীতিতে আসার আগে স্ট্যানলি বিশ্ব ব্যাংক ও ইউরোপিয়ান কমিশনে কর্মরত ছিলেন। জনসনের নানা স্যার জেমস ফসেট ইউরোপিয়ান মানবাধিকার কমিশনেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন।

চার ভাইবোনের মধ্যে সবার বড় জনসনের শৈশব কেটেছে নিউ ইয়র্ক, লন্ডন ও ব্রাসেলসে। বধির ছিলেন তিনি। যে কারণে শৈশবেই তাকে বেশ কয়েকবার অপারেশনের টেবিলে যেতে হয়েছিল; জনসন সেসময় তুলনামূলক চুপচাপ ছিলেন বলে তার আত্মীয়স্বজনরা জানিয়েছেন।

কিং স্কলারশিপে বার্কশায়ারের ইটন কলেজে পড়ার পর অক্সফোর্ডের বেলিওল কলেজে ক্ল্যাসিকসে ডিগ্রি নেন জনসন। তিনি বিতর্ক সংগঠন অক্সফোর্ড ইউনিয়নেরও প্রেসিডেন্ট ছিলেন; ছিলেন বুলিনডং ক্লাবের সদস্য, যেখানে তার সঙ্গী ছিলেন ডেভিড ক্যামেরনও।

সাংবাদিকতা ও রাজনীতি:

ব্যবস্থাপনা উপদেষ্টা হিসেবে কিছুদিন কাজ করার পর জনসনের সাংবাদিকজীবন শুরু হয়। ১৯৮৭ সালে টাইমসে প্রতিবেদক হিসেবে যোগ দেওয়ার পর একজনের উদ্ধৃতি জাল করায় চাকরি হারাতে হয় তাকে।

ডেইলি টেলিগ্রাফে জনসন ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন ৫ বছর। পরে ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত তিনি একই প্রতিষ্ঠানের সহকারী সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৯৪ সাল থেকেই জনসন ম্যাগাজিন ‘দ্য স্পেকটেটরে’ রাজনৈতিক কলাম লেখা শুরু করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি ম্যগাজিনটির সম্পাদক হন; ২০০৫ পর্যন্ত তিনি এ পদেই ছিলেন।

টেলিগ্রাফে থাকার সময় ১৯৯৭ সালে ক্লয়েড সাউথ এলাকা থেকে হাউস অব কমন্সে নির্বাচন করেন জনসন। সেবার লেবার পার্টির মার্টিন জোন্সের সঙ্গে জিততে পারেননি।

সাংবাদিক হিসেবে সুপরিচিত জনসনকে ১৯৯৮ সাল থেকে বিবিসি’র ‘হ্যাভ আই গট নিউজ ফর ইউ’সহ টেলিভিশনের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে দেখা যেতে থাকে।

২০০১ সালের পার্লামেন্ট নির্বাচনে হেনলি অন টেমস আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয়ী হন এ কনজারভেটিভ সদস্য।

টেলিভিশন ও রাজনৈতিক অঙ্গনে সুপরিচিত হলেও জনসনের রাজনৈতিক উত্থান মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ ছিল না।

স্পেকটেটরের একটি সম্পাদকীয় প্রকাশের জেরে তাকে লিভারপুল সিটির কাছে ক্ষমা চাইতে হয়েছিল; এক সাংবাদিকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জনে ছায়া শিল্পমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকেও তাকে সরিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য এর কোনোটিই ২০০৫ এর নির্বাচনে তার ফের জয়ী হওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।

দুই বছর পর লন্ডনের মেয়র নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন জনসন। অপরাধ দূর ও যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে আস্থা জিতে নেন ভোটারদের। সেবার লেবারের কেন লিভিংস্টোনকে সামান্য ভোটের ব্যবধানে হারিয়ে তিনি যুক্তরাজ্যের রাজধানী জয় করে রক্ষণশীলদের মুখে হাসি এনে দিয়েছিলেন।

২০১২ সালের নির্বাচনে ফের লিভিংস্টোনকে হারিয়ে দলকে দিয়েছিলেন স্বস্তি; মধ্যবর্তী নির্বাচনে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড ও ওয়েলসে ৮০০-র বেশি আসন হারিয়ে কনজারভেটিভ পার্টি তখন হাঁসফাঁস করছিল।

২০০৭ সালে মেয়র নির্বাচনে জয়ী হওয়ার আগেই সংসদ সদস্যপদ ছেড়ে দিয়েছিলেন; আট বছর পর, ২০১৫ সালে পশ্চিম লন্ডনের উক্সব্রিজ অ্যান্ড সাউথ রুইস্লিপ আসনে জয়ী হয়ে ফের পার্লামেন্টে ঢোকেন জনসন। ১৯৯০ এর পর সেবারই কনজারভেটিভ পার্টি যুক্তরাজ্যে সবচেয়ে বেশি আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতাগ্রহণ করেছিল।

দুই মেয়াদের পর আর মেয়র নির্বাচনে দাঁড়াননি জনসন; তার বদলে থাকা কনজারভেটিভ প্রার্থীকে সহজেই হারিয়ে রাজধানী ফের বগলদাবা করে লেবাররা; মেয়র হন সাদিক খান।

যুক্তরাজ্য ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকবে কিনা, তা নিয়ে গণভোটের প্রচারে জনসনকে দেখা যায় ‘ব্রেক্সিটপন্থিদের’ অন্যতম প্রভাবশালী মুখপাত্র হয়ে উঠতে।

ইউরোপকে এক করতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেষ্টাকে নেপোলিওন ও অ্যাডলফ হিটলারের চেষ্টার সঙ্গে তুলনা করেও বেশ সমালোচিত হন তিনি।

২০১৬-র ২৩ জুনের গণভোটে ৫২ শতাংশ ভোটার ‘ব্রেক্সিটের’ পক্ষে মত দিলে, ডেভিড ক্যামেরন প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেন।

অনেকেই তখন জনসনকেই নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখলেও তৎকালীন বিচারমন্ত্রী মাইকেল গোভসহ ঘনিষ্ঠ অনেকেই লন্ডনের সাবেক এ মেয়রের পাশ থেকে সরে যান।

জনসন সঠিকভাবে নেতৃত্ব দিতে পারবেন না এবং ব্রেক্সিট সম্পন্নে কাজ করতে পারবেন না- এমন মন্তব্য করে গোভ নিজেই নিজের নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করেন।

ঘনিষ্ঠ আরও কয়েকজন প্রভাবশালী সাংসদও গোভকে সমর্থন দিলে শেষ পর্যায়ে প্রার্থীতাই প্রত্যাহার করে নেন জনসন।

পারিবারিকভাবে ঘনিষ্ঠ এবং রাজনীতিতে একসঙ্গে বেড়ে ওঠা ক্যামেরন, জনসন ও গোভের ‘একে অপরের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতার’ এ চিত্রকে সেসময় শেকসপিয়ারের কাহিনীর সঙ্গে তুলনা দিয়েছিল ব্রিটিশ গণমাধ্যম।

টেরিজা মে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর জনসন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। ২০১৭ সালের জুনে আগাম নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারানোর পর কনজারভেটিভ নেতৃত্বাধীন সংখ্যালঘু সরকারের নতুন মন্ত্রিসভায়ও জনসনের পদ বহাল থাকে।

পরের বছরের এপ্রিলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টকে পাশ কাটিয়ে সিরিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সের সঙ্গে যুক্তরাজ্যের যৌথ বিমান হামলায় বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রীর কড়া সমালোচনা করলেও জনসন মে-কে অকুণ্ঠ সমর্থন দেন।

সিরিয়ার সাধারণ মানুষের ওপর সরকার রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে এমন অভিযোগে দেশটির প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ সমর্থিত বাহিনীর ওপর তিন দেশ ওই বিমান হামলা করেছিল।

২০১৮ সালের মার্চে যুক্তরাজ্যে পক্ষত্যাগী এক রুশ গুপ্তচর ও তার মেয়ের ওপর হামলায় ব্যবহৃত নার্ভ এজেন্ট ‘নোভিচক’ রাশিয়া থেকে এসেছিল- ব্রিটিশ সামরিক পরীক্ষাগারের উদ্ধৃতি দিয়ে করা জনসনের এমন মন্তব্য নিয়েও লন্ডনে উত্তাপ ছড়িয়েছিল।

যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি পরীক্ষাগার হামলায় ব্যবহৃত নার্ভ এজেন্টটি সোভিয়েত আমলের ‘নোভিচক’ হিসেবে চিহ্নিত করলেও, এটি যে রাশিয়া থেকেই এসেছিল এমন কিছু বলেনি।

সামরিক পরীক্ষাগারের বক্তব্যকে ভুলভাবে হাজির করে জনসন জনগণকে বিভ্রান্ত করেছিলেন বলে বিরোধীরা সেসময় অভিযোগ করেছিল। পক্ষত্যাগী গুপ্তচর ও তার মেয়ের ওপর হামলার ওই ঘটনায় পরে লন্ডন কয়েক ডজন রুশ কূটনীতিককে বহিষ্কারও করে।

ব্রেক্সিট কার্যকরের পন্থা নিয়ে মে-র সঙ্গে লন্ডনের সাবেক এ মেয়রের দূরত্বও বাড়তে শুরু করে।২০১৮ সালের জুলাইয়ে ব্রেক্সিটের খুঁটিনাটি নিয়ে মে তার মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে অবকাশযাপন কেন্দ্র চেকারে বসলে সেখানেই প্রধানমন্ত্রীর নমনীয় অবস্থানের সঙ্গে অন্যদের বিরোধ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছায়।

৮ জুলাই মে-র মন্ত্রিসভার ব্রেক্সিট বিষয়ক মন্ত্রী ডেভিড ডেভিস পদত্যাগ করলে পরদিন একই পথ ধরেন জনসনও।

পদত্যাগপত্রে ব্রেক্সিট নিয়ে মে-র পদক্ষেপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে মধ্যস্থতার পন্থারও তীব্র সমালোচনা করেন তিনি। জেরেমি হান্ট পরে জনসনের স্থলাভিষিক্ত হন।

মে ক্ষমতাসীন টোরি দলের নেতৃত্ব ও প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর কয়েক সপ্তাহের নেতৃত্ব নির্বাচন প্রক্রিয়া শেষে ২০১৯ সালের জুলা্ইয়ে‘কট্টর ব্রেক্সিটপন্থি’ জনসন ওই পদগুলোতে স্থলাভিষিক্ত হন।

দলের নেতৃত্ব নির্বাচনের চূড়ান্ত পর্যায়ে জনসনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেরেমি হান্টের সঙ্গে। তবে দলের নিবন্ধিত কর্মী-সমর্থকরা শেষ পর্যন্ত লন্ডনের সাবেক মেয়রকেই বেছে নিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রথম কয়েক মাস বেশ অস্বস্তিতেই কাটাতে হয়েছে জনসনকে। দলের বেশ কয়েকজন তার বিপক্ষে অবস্থান নেন, অনেকে পদত্যাগও করেন। সেসবের ধারাবাহিকতায় ওই বছরের অক্টোবরে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া হয়।

অনেকে সেসময় জনসনের শেষ দেখলেও ডিসেম্বরের নির্বাচনে কনজারভেটিভ পার্টিকে বড় জয় এনে দিয়েছিলেন খ্যাপাটে এই রাজনীতিক; এমন অনেক আসনে টোরিরা জিতেছিল, যেগুলো তাদের বিরোধী শিবিরের আসন বলে খ্যাত ছিল।

নির্বাচনে ভূমিধস বিজয় দলে জনসনের প্রভাবকে সুসংহত করে। এরপর আসে কোভিড মহামারী। বিশ্বজুড়ে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণ, বিধিনিষেধের বেড়াজালের মধ্যে অর্থনীতি সচল রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হয় তাকে।

এর মধ্যেও নানা ছোটখাট বাধাবিপত্তি অতিক্রম করতে হয়েছে তাকে।

সেগুলো পার করতে পারলেও কোভিডের ধাক্কার পর ইউক্রেইন যুদ্ধ এবং তার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার ওপর যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমাদেশগুলোর নিষেধাজ্ঞায় বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির যে টালমাটাল পরিস্থিতি, তার ছোঁয়া লাগে ‍যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতেও। বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতি।

এত চাপ কাটাতে জনসন ইউক্রেইন যুদ্ধকে ঢাল হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা করেছিলেন। পদত্যাগ তো দূর ২০৩৫ পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার আগ্রহও ব্যক্ত করেছিলেন তিনি।

কিন্তু দলের ভেতর প্রবল হয়ে ওঠা অনাস্থায় শেষ পর্যন্ত নেতৃত্ব থেকে সরে যাওয়ার ঘোষণা দিতে হয়েছে তাকে।