গর্ভপাত: যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের আদেশে বিশ্বজুড়ে ক্ষোভ, উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের আদেশে মার্কিন নারীদের গর্ভপাতের সাংবিধানিক অধিকার উল্টে যাওয়ার ঘটনা বিশ্বজুড়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 June 2022, 07:59 AM
Updated : 26 June 2022, 08:00 AM

অনেকেই একে নারীর অধিকারের ওপর বড় ধরনের আঘাত হিসেবে দেখছেন, যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের অনেক দেশের কাছে ‘মডেল’ হওয়ায় এখন অন্যান্য দেশেও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারি হতে পারে বলে কেউ কেউ আশঙ্কাও করছেন।  

প্রায় ৫০ বছর আগে রো বনাম ওয়েড মামলার রায়ের কারণে এতদিন মার্কিন নারীরা গর্ভধারণের ৬ মাস পর্যন্ত তুলনামূলক সহজেই গর্ভপাত করতে পারতেন।

শুক্রবার সুপ্রিম কোর্ট ওই রায় পাল্টে দেওয়ায় শিগগিরই দেশটির অনেক রাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে দেশটির গণমাধ্যমগুলো।

তবে বেশকিছু রাজ্য বলছে, সর্বোচ্চ আদালত কেড়ে নিলেও তারা নারীর গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষেই থাকবে।

এ সুবিধা থাকলে অন্য রাজ্যের তুলনামূলক ধনী নারীরা চাইলেই যেসব রাজ্যে গর্ভপাত বৈধ সেখানে যেতে পারলেও দরিদ্ররা বিপাকে পড়বেন বলেই মনে করা হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সুপ্রিম কোর্টের আদেশে ‘স্তম্ভিত’ হওয়ার কথা জানিয়েছেন।

গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ। ছবি রয়টার্স থেকে নেওয়া

ইতালিকে ‘চমকে দিয়েছে’ যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট রো বনাম ওয়েড মামলায় আপিলের রায় দিয়েছিল ১৯৭৩ সালে। তার ৫ বছর পর ইতালিতেও ‘ল ১৯৪’ পাস হলে গর্ভপাত বৈধ হয়।

গর্ভপাত ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো ইতালিতে এতটা গুরুত্বু না পেলেও সাম্প্রতিক সময়ে ক্যাথলিক গির্জাসংশ্লিষ্ট কট্টর-ডানপন্থি কিছু গোষ্ঠী বিষয়টি সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। সে কারণে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তে ইতালিকেও নড়েচড়ে বসতে হচ্ছে।

দেশটির বাম ও মধ্যপন্থি ঘরানার রাজনীতিকরা সমস্বরে মার্কিন আদালতের আদেশের নিন্দা জানাচ্ছেন।

বামপন্থি, সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমা বনিনো বলছেন, ইতালিও যে পেছন পানে হাঁটা শুরু করতে পারে এবং ‘স্থায়ী মনে হওয়া অনেক অর্জনই যে হাতছাড়া হতে পারে’ যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের সিদ্ধান্ত তাই দেখাচ্ছে।

‘ল ১৯৪’ পাসের ক্ষেত্রে বনিনো দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিলেন।   

ডান ঘরানার অনেকে অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে আপ্লুত।

“অসাধারণ বিজয়,” বলেছেন কট্টর ডানপন্থি লেগা নর্দের সিমন পিলন। তার চাওয়া, ইতালি ও ইউরোপও এখন যুক্তরাষ্ট্রের পথ অনুসরণ করুক। 

তবে তার দলের নেতা মাতিও সালভিনি, যিনি আরও গোঁড়া রক্ষণশীল হিসেবে পরিচিত, তার সুর অন্যরকম।

“জীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলেও গর্ভপাতের ক্ষেত্রে শেষ কথা নারীদেরই থাকা উচিত,” বলেছেন তিনি।

এ কারণে শিগগিরই ইতালিতে গর্ভপাতের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসার সম্ভাবনা কম মনে হলেও ‘ল ১৯৪’ তে চিকিৎসকদের গর্ভপাতে আপত্তি জানানোর অধিকার দেওয়া রয়েছে। আর এ অধিকারকে কাজে লাগিয়ে দেশটির প্রায় ৭০ শতাংশ, কোথাও কোথাও ৯০ শতাংশ চিকিৎসকই এখন গর্ভপাতে আপত্তি জানাচ্ছেন বলে জানিয়েছে বিবিসি।

উঠোনে ভ্যাটিকান থাকায়, সমকামিতাসহ বিভিন্ন সংবেদনশীল ইস্যুতে ইতালি এখনও ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মতো উদার নয়। ভ্যাটিকান গর্ভপাত নিয়ে মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে, যার প্রভাবে ইতালিতেও পড়তে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন।    

আয়ারল্যান্ডে উদ্বেগ

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের আদেশ আয়ারল্যান্ডকে তীব্র ঝাঁকুনি দিয়েছে। দেশটিতে গর্ভপাত বৈধতা পেয়েছে মাত্র কয়েক বছর হল, এর মধ্যে মার্কিন আদালতের এমন রায়!

এর প্রতিক্রিয়ায় অনেকে ২০১৮ সালে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে আইরিশ জনগণের দেওয়া গণরায়ের স্মৃতি শেয়ার করছেন, অনেকে মনে করিয়ে দিচ্ছেন ভারতীয় নারী সবিতা হলপ্পনবারের করুণ মৃত্যুর কথাও।

দন্তচিকিৎসক সবিতা স্বামীর সঙ্গে আয়ারল্যান্ডে থাকতেন। অন্তঃসত্ত্বা সবিতা ২০১২ সালে মিসক্যারিজের পর ইনফেকনে ভুগে মারা যান।

মিসক্যারিজের সময় তার প্রাণ বাঁচাতে পরিবারের পক্ষ থেকে গর্ভপাতের আবেদন করা হলেও আইনি বাধা থাকায় আইরিশ চিকিৎসকরা তাতে রাজি হননি। কয়েক দিনের দুর্বিসহ যন্ত্রণা ভোগ করে শেষ পর্যন্ত রক্তে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ায় মারা যান ৩১ বছর বয়সী সবিতা।

তার ওই মৃত্যুর পর আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। তারই ধারাবাহিকতায় হয় গণভোট, যা দ্বীপদেশটিতে গর্ভপাতকে বৈধতা দেয়।

ওই আন্দোলনে অংশ নেওয়া অনেকে এখন আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের পরিস্থিতি নিয়ে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, দেশটিকে এখন হয়তো সবিতার মতো অসংখ্য ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে। 

“বিশ্ব দেখছে, যুক্তরাষ্ট্র ক্রমাগত অচেনা হয়ে উঠছে,” টুইটারে এমনটাই লিখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক ড. জেনিফার ক্যাসিডি, যিনি ২০১৮ সালের গণভোটের ফল ঘোষণার পর ডাবলিনে তা উদ্‌যাপন করা উচ্ছ্বসিত হাজারও মানুষের একজন ছিলেন।

কেবল আয়ারল্যান্ডেই নয়, প্রতিবেশী নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের অনেকেও যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে হতাশ।

“লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত,” বলেছেন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের গ্রেইনি টাগার্ট, যিনি নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডে গর্ভপাতের অধিকারের সমর্থনে লড়াই করেছেন।

মুদ্রার অন্য পিঠও আছে। নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের গর্ভপাতবিরোধীরা এখন খুশিতে আটখানা।

“আমাদের এখানে এই রায় হয়তো ঘুম খানিকটা ভাঙাবে। যুক্তরাষ্ট্রে যা হচ্ছে, তা থেকে আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে।

“আমার ব্যক্তিগত আশা হচ্ছে, ভবিষ্যতে কোনো একদিন আমাদের এখানেও আইন বদলাবে। আমার মনে হয়, যুক্তরাষ্ট্রে খুবই বুদ্ধিদীপ্ত আন্দোলন হয়েছে। এটাই আশা দিচ্ছে। লড়াই চলবে,” বলেছেন নর্দার্ন আয়ারল্যান্ডের সুপরিচিত গর্ভপাতবিরোধী কর্মী বার্নি স্মিথ।

গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ। ছবি রয়টার্স থেকে নেওয়া

লাতিনে, মধ্য আমেরিকায় রক্ষণশীলদের উদ্দীপ্ত করবে

সাম্প্রতিক সময়ে গর্ভপাত নিয়ে আগের কট্টর অবস্থান থেকে খানিকটা সরতে দেখা যাচ্ছিল লাতিন আমেরিকার দেশগুলোকে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের আদালতে রো বনাম ওয়েড মামলার রায় উল্টে যাওয়ায় পরিস্থিতির বড় ধরনের অবনতির আশঙ্কা করছেন অধিকার কর্মীরা।

“আমাদের দেশের যে রক্ষণশীলরা নারীর অধিকার দিতে নারাজ তারা এই আদেশে উৎসাহিত হবে,” বলেছেন এল সালভাদরে গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাওয়া মারিয়ান মোইসা। মধ্য আমেরিকার এ দেশটিতে গর্ভপাত পুরোপুরি নিষিদ্ধ; ধর্ষণ বা নারীর জীবন বিপন্ন হলেও সেখানে গর্ভপাত করানো যায় না।

“নারীর মানবাধিকার অস্বীকার এবং নিপীড়নের শিকার মেয়েদের সন্তান ধারণে বাধ্য করার কারণে এমনিতেই সমাজের সবচেয়ে দরিদ্ররা ভয়াবহ অবিচারের শিকার হচ্ছে,” বলেছেন মোইসা।

তবে এল সালভাদরের পার্লামেন্টের যে সদস্যরা গর্ভপাতবিরোধী তারা যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন এবং পুরো অঞ্চলজুড়ে বেশিরভাগ মানুষ যে গর্ভপাতের বিরোধী সেই কথাই জোর দিয়ে বলার চেষ্টা করছেন তারা।

‘ভয়াবহ ধাক্কা’

কানাডা সাধারণত তার প্রতিবেশী এবং সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদারের অভ্যন্তরীণ ব্যাপরে নাক গলায় না।

কিন্তু শুক্রবার মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রো বনাম ওয়েড মামলার রায় পাল্টে দেওয়ার পর জাস্টিন ট্রুডো চুপ করে থাকতে পারেননি। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের আদেশকে ‘ভয়াবহ ধাক্কা’ ও ‘নারীর জন্য ভয়ানক’ বলে অভিহিত করেছেন।

“সত্যি কথা বলতে, এটি প্রত্যেকের স্বাধীনতা ও অধিকারের ওপর আঘাত,” রুয়ান্ডায় কমনওয়েলথ সম্মেলনে বলেন কানাডার এ প্রধানমন্ত্রী।

১৯৮৩ সাল থেকে বৈধ হলেও কানাডায় গর্ভপাতের সুযোগ সুবিধা তেমন নেই। দেশটির একটি প্রদেশ নিউ ব্রুনসউইকে কোনো গর্ভপাত ক্লিনিক নেই; অনেক এলাকার নারীদের গর্ভপাত করাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে নির্ধারিত হাসপাতালে যাওয়া লাগে।

কানাডায় গর্ভপাতবিরোধীর সংখ্যাও কম নয়, তবে এই ইস্যুটি যুক্তরাষ্ট্রের মতো এত গুরুত্ব পায় না।

মার্কিন আদালতের রায়ের পর কানাডার একটি গর্ভপাতবিরোধী সংগঠন টুইটারে তাদের প্রতিক্রিয়ায় বলেছে, “যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের বন্ধুদের জন্য এটি সত্যিকার অর্থেই একটি ঐতিহাসিক দিন’। 

গর্ভপাতের অধিকারের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রে বিক্ষোভ। ছবি রয়টার্স থেকে নেওয়া

বিশ্বজুড়ে পড়বে ‘নেতিবাচক প্রভাব’

ভারতের নারী অধিকারকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে ‘ভিক্টোরীয় মূল্যবোধ’ তাড়িত সিদ্ধান্ত হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, এই রায় বিশ্বজুড়ে নারীর অধিকার আদায়ের আন্দোলনকে বড় ধরনের ক্ষতির মুখে ফেলল।  

“রো বনাম ওয়েড মামলার রায় কেবল যুক্তরাষ্ট্রেই নারীর প্রজনন অধিকারে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে না, বিশ্বজুড়েই এর প্রভাব দেখা যাবে,” বলেছেন নারী অধিকারকর্মী ও ফরেনসিক মেডিসিনের অধ্যাপক ড. বীণা জেএস, যিনি চিকিৎসকদের মেডিকেল এথিকস পড়ান। 

যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭১ সাল থেকে গর্ভপাত বৈধ; তবে দেশটিতে কন্যাসন্তান জন্ম দিতে অনাগ্রহ থেকে অনেকে ভ্রুণ হত্যায় ব্রতী হওয়ায় গর্ভপাতের ক্ষেত্রে কিছু শর্তও আছে। নানান কুসংস্কার ও ধর্মীয়-নৈতিক কারণে চিকিৎসকদের অনীহায় অনেক নারীকেই নিবন্ধিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রের বাইরে গর্ভপাতে ঝুঁকতে হয়।

“যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত বিশ্বের মডেল, অনেকেই তাকে অনুসরণ করে। আমার আশঙ্কা, এক পর্যায়ে ভারতও লাইনে দাঁড়াবে এবং কাছাকাছি একটি আইন নিয়ে আসবে। আর আমরা বাধ্য হব সেই সন্তানদের বড় করতে, যাদের চাইনি আমরা,” বলেছেন বীণা।

এসব ক্ষেত্রে পরবর্তীতে মা ও শিশু উভয়েরই শারীরিক ও মানসিক নানান সমস্যা দেখা দেয় বলে বিভিন্ন গবেষণার কথাও উল্লেখ করেন তিনি।

“গবেষণায় দেখা গেছে যে নারীরা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে সন্তান জন্ম দেন, তাদের প্রসব পরবর্তী মানসিক জটিলতা ও হতাশা বেড়ে যায়। ওই ‘অবাঞ্ছিত’ শিশুদের জীবনের মানও খারাপ হয়,” বলেছেন বীণা।