অভাবনীয় ধ্বংস ডেকে আনা টোঙ্গার সেই আগ্নেয়গিরি অনেকটাই অক্ষত

দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের জলমগ্ন যে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত গত জানুয়ারিতে দ্বীপরাষ্ট্র টোঙ্গায় বিপুল ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল, সেই হুঙ্গা-টোঙ্গা হুঙ্গা-হাপাই বিস্ময়করভাবে অক্ষত রয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন গবেষকেরা।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 May 2022, 03:56 AM
Updated : 24 May 2022, 03:58 AM

এক প্রতিবেদনে বিবিসি জানিয়েছে, নিউ জিল্যান্ডের একটি গবেষক দল সাগরের তলদেশে ওই পর্বতের মাপজোক শেষ করেছেন। আগে তাদের ধারণা ছিল, জানুয়ারিতে ওই শক্তিশালী অগ্ন্যুৎপাতের পর আগ্নেয়গিরিটি হয়ত ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে, কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি।

গবেষকেরা দেখতে পেয়েছেন, অগ্ন্যুৎপাতের পর হুঙ্গা-টোঙ্গা হুঙ্গা-হাপাই গঠনগতভাবে খুব বেশি বদলায়নি।

জানুয়ারিতে টোঙ্গার অগ্ন্যুৎপাত একশ বছরেরও বেশি সময়ের মধ্যে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে রেকর্ড করা সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ সৃষ্টি করে।

এর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগর এবং অন্যান্য মহাসাগরের বেসিন জুড়ে সুনামি সৃষ্টি হয়। এমনকী এর ধাক্কায় যুক্তরাজ্যের ওপরে মেঘের স্তর সাড়ে ১৬ হাজার কিলোমিটার উঁচুতে উঠে যায়। যদিও দ্বীপ দেশ টোঙ্গায় খুব বেশি প্রাণহানি হয়নি।

নিউ জিল্যান্ডের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর ওয়াটার অ্যান্ড অ্যাটমসফেরিক (এনআইডব্লিউএ) রিসার্চ সম্প্রতিক একটি জাহাজ নিয়ে অগ্ন্যুৎপাত পরবর্তী হুঙ্গা-টোঙ্গা হুঙ্গা-হাপাইয়ের আকৃতি ও এর চারপাশের সমুদ্রতলের মানচিত্র তৈরি করেছে।

সমুদ্রতলে তারা প্রত্যাশিতভাবেই বিপুল ছাইয়ের স্তর আর লাভার আস্তর দেখেছেন। সেই সঙ্গে আগ্নেয়গিরিটি টিকে আছে বলেও তারা প্রমাণ পেয়েছেন।

এ অভিযানের নেতৃত্বে থাকা এনআইডব্লিউএর সামুদ্রিক ভূতত্ত্ববিদ কেভিন ম্যাককি বলেন, গবেষণা জাহাজ ট্যানগারোয়ার ‘সোনার’ বা শব্দক্ষেপণ যন্ত্র থেকে পাওয়া যে ছবি তিনি দেখতে পেয়েছেন, তাতে রীতিমত অবাক হয়ে গেছেন।

“১৫ জানুয়ারির অগ্ন্যুৎপাতের ভয়াবহতা বিবেচনায় নিলে, আমি ধারণা করছিলাম, আগ্নেয়গিরিটি ধসে গেছে অথবা বিস্ফোরণে উড়ে গেছে। অথচ এর কোনটিই ঘটেনি।”

তিনি বলেন, “এখন দেখে মনে হচ্ছে আগ্নেয়গিরিটি প্রায় অক্ষত আছে। সমুদ্রতলদেশে অগ্ন্যুৎপাতের কিছু নাটকীয় প্রভাব দেখা গেছে। সুক্ষ্ম বালু কাদা ও গভীর ছাইয়ের ঢেউ আগ্নেয়গিরি থেকে ৫০ কিলোমিটার দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে আছে। উপত্যকা সঙ্কুচিত হয়েছে এবং বিপুল লাভার স্তূপ জমে রয়েছে।”

ট্যানগারোয়ায় চড়ে ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকার জরিপ করার পর গবেষকরা হিসাব করে বলছেন, অগ্ন্যুৎপাতের কারণে ৬ থেকে ৭ ঘন কিলোমিটার পরিমাণ উপজাত সমুদ্রতলে জমা হয়েছে।

এই ছাই ও পাথর অগ্ন্যুৎপাতের সময় বাতাসে উৎক্ষিপ্ত হয়েছিল, কিন্তু পরে তা নিচে নেমে আসে এবং পানিতে তলিয়ে আগ্নেয়গিরির গা-বেয়ে সাগরের তলায় জমা হয়।

কেভিন ম্যাককি বিবিসিকে বলেন, ওই বিপুল ঘনত্বের পাথর, লাভা ও ছাইয়ের প্রবাহই সুনামির ঢেউ সৃষ্টির জন্য বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে, যা স্থানীয় দ্বীপগুলোকে ভাসিয়ে দিয়েছে।

হুঙ্গা-টোঙ্গা হুঙ্গা-হাপাই আগ্নেয়গিরিতে এর আগে ২০১৬ সালে জরিপ চালানো হয়। ওই সময়ের তথ্যউপাত্তের সঙ্গে এখনকার তথ্যউপাত্ত মেলানোর পর গবেষকেরা একটি ‘পার্থক্যের মানচিত্র’ তৈরি করতে পেরেছেন।

গবেষক দলের তৈরি করা মানচিত্রে লাল রঙ দিয়ে নতুন যুক্ত হওয়া পাথর, ছাই বা লাভার স্তর বোঝানো হয়েছে। নীল রঙে চিহ্নিত অংশ বোঝাচ্ছে, এখান থেকে আগ্নেয়গিরির অংশ বিচ্ছিন্ন হয়েছে।

বেশিরভাগ ক্ষতি হয়েছে আগ্নেয়গিরির ঘাড়ের অংশটি থেকে। গবেষকেরা বলেছেন, হুঙ্গা-টোঙ্গা হুঙ্গা-হাপাইয়ের ওপরের অংশ থেকে ২ থেকে ৩ ঘন কিলোমিটার বের হয়ে এসেছে।

সোনার জরিপের পাশাপাশি, ট্যানগারোয়ার বিজ্ঞানীরা স্থানীয় মহাসাগরের বাস্তুতন্ত্রও পর্যবেক্ষণ করেছেন।

স্বভাবতই, আগ্নেয়গিরির গায়ে জীবজগত ধ্বংস হয়ে গেছে, তবে মাত্র ১৫ কিলোমিটার দূরেই গবেষক দল মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণীর সন্ধান পেয়েছেন, যারা অন্য ডুবো পর্বতের গায়ে বাসা করে আছে।

এনআইডব্লিউএর মৎস্য বিজ্ঞানী ম্যালকম ক্লার্ক বলেন, “দুই পরিস্থিতি থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এ অঞ্চলের প্রাণীরা অনেক বেশি সহিষ্ণু। এটা গুরুত্বপূর্ণ, কারণ অগ্ন্যুৎপাত কীভাবে চারপাশের সামুদ্রিক জীবজগতকে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং সেখান থেকে বাঁচার সুযোগ কতটা, সে বিষয়ে ধারণা মিলতে পারে এই পর্যবেক্ষণ থেকে।”

গবেষকেরা পানির বাহ্যিক ও রাসায়নিক বৈশিষ্ট্যও পরীক্ষা করেছেন। তারা পানির তাপমাত্রা, পুষ্টিকণা, ও অক্সিজেনের ঘনত্ব মেপেছেন। অনেক স্থানেই, অ্যাশ-ফল বা ছাই-ধুলির প্রভাবে প্ল্যাঙ্কটনের মেলা বসেছে, আবার অনেক স্থানে পানিতে অক্সিজেনের অনু ভেঙে গেছে।

এই অভিযানে গবেষক দলটি হাজার হাজার ছবি, ও শত শত নমুনা সংগ্রহ করেছে। তবে গবেষণা জাহাজ ট্যানগারোয়া সরাসরি হুঙ্গা-টোঙ্গা হুঙ্গা-হাপাইয়ের মুখ বা ক্যালডেরার ওপর সরাসরি জরিপ চালায়নি।

গবেষণার ওই অংশটি ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে যুক্তরাজ্যের কোম্পানি সি-কিট ইন্টারন্যাশনাল নির্মিত একটি রোবটের ওপর। ম্যাক্সলিমার নামের ১২ মিটার দীর্ঘ ওই মনুষ্যবিহীন ওই সামুদ্রিক জলযান সিঙ্গাপুর হয়ে ট্যানগারোয়ার দিকে যাচ্ছে।

নৌযানটি দূর-নিয়ন্ত্রতি। এই সতর্কতার কারণ হল আগ্নেয়গিরিটি এখনও সক্রিয় বলে ধারণা করা হচ্ছে।

এনআইডব্লিউএর সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রবিদ ড. হসারাহ সিব্রুক বলেন, “ছাইয়ের আস্তর নিয়ে আমাদের প্রাথমিক বিশ্লেষণ থেকে ধারণা হয়েছে যে, এর সবটাই জানুয়ারির অগ্ন্যুৎপাতের অবশেষ নয়, বরং আমাদের ধারণা, আগ্নেয়গিরিটি ক্রমাগত ছাই ও গলিত লাভা উগরে যাচ্ছে, যদিও তা খুবই স্বল্প পরিমাণে।”

সম্প্রতি নিউ জিল্যান্ডের নৌবাহিনীর একটি জাহাজ সোনার দিয়ে পরীক্ষা করে জানিয়েছে, ক্যালডেরার ওপরের পানির স্তর নাটকীয়ভাবে বেড়ে গেছে। অগ্ন্যুৎপাতের আগে সেখানে ১৫০ থেকে ২০০ মিটার গভীর ছিল সাগরতল। এখন সেখানে পানির গভীরতা ৮০০ মিটার বা তার চেয়েও বেশি। তার মানে হল, আগ্নেয়গিরিটির ম্যাগমা চেম্বার খালি হয়েছে।

ট্যানগারোয়ার মাসব্যাপী এই প্রকল্পের অর্থায়ন করছে জাপানের নিপ্পন ফাউন্ডেশন এবং আয়োজক সংস্থা এনআইডব্লিউএ।

পুরানো খবর -