কারফিউ ওঠার পর কলম্বো ছাড়ার হিড়িক

বিক্ষোভ-সংঘাত দমাতে জারি করা অনির্দিষ্টকালের কারফিউ কয়েকঘণ্টার জন্য তুলে নেয়া হলে অসংখ্য মানুষকে বাসে করে শ্রীলঙ্কার বাণিজ্যিক রাজধানী কলম্বো ছাড়তে দেখা গেছে।

>>রয়টার্স
Published : 12 May 2022, 01:29 PM
Updated : 12 May 2022, 02:04 PM

ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে বিপর্যস্ত শ্রীলঙ্কায় বেশ কিছুদিন ধরে সরকার বিরোধী বিক্ষোভ চলছে। গত সোমবার ওই বিক্ষোভ রীতিমত সংঘাতের রূপ নেয়। যাতে এখন পর্যন্ত নয় জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন তিন শতাধিক মানুষ। বিক্ষোভের মুখে প্রধানমন্ত্রীত্ব ছেড়েছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে। বিক্ষোভকারীরা তার ভাই শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসের পদত্যাগও দাবি করছেন।

বিক্ষোভ দমাতে সোমবারই শ্র্রীলঙ্কাজুড়ে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারি করা হয়। নামনো হয় সেনাবাহিনী। সেনাবাহিনীর হাতে বিনা পরোয়ানায় যে কাউকে গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদ, এমনকি প্রয়োজনে গুলি করার ক্ষমতাও তুলে দেওয়া হয়েছে।

গত সোমবার থেকে চলা অনির্দিষ্টকালের ওই কারফিউ বৃহস্পতিবার স্থানীয় সময় সকাল ৭টায় কয়েক ঘণ্টার জন্য ‍তুলে নেয়া হয়েছিল বলে জানায় বার্তা সংস্থা রয়টার্স।

কারফিউ তুলে নেওয়ার পরপরই কলম্বোর বাসস্টপগুলোতে মানুষের উপচে পড়া ভিড় দেখা দেয়। বাসেও প্রচণ্ড ভিড় ছিল। তাদের বেশিরভাগই কলম্বো ছেড়ে নিজ নিজ শহরে চলে যেতে পথে নেমেছেন।

স্থানীয় সময় দুপুর ২টা থেকে আবার কারফিউ জারি হয়।

কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নিলেও বাসস্টপ ‍ছাড়া কলম্বোর সড়কগুলো বলতে গেলে নিরবই ছিল। অল্প কিছু মানুষ অতি প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতে বাড়ির বাইরে বের হয়েছিলেন।

যেহেতু গত কয়েক সপ্তাহ ধরেই দেশটিতে তীব্র জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে তাই সড়কে তেমন যানবাহন ছিল না।

এখনো জ্বালানি নিয়ে জনমনে ক্ষোভ ও হতাশা বিন্দুমাত্র কমেনি।

কারফিউ ওঠার পর পেট্রোল নিতে দীর্ঘসময় ধরে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিকশা চালক নিমাল জয়ান্থা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘‘অর্থনৈতিকভাবে আমরা খাদের কিনারে দাঁড়িয়ে আছি।

‘‘পেট্রোল পেতে আমাকে যতক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে তাতে আমার হাতে আর গাড়ি চালানোর সময় থাকবে না। তার আগেই আবার কারফিউ জারি হয়ে যাবে। কোনো অর্থ উপার্জন না করেই আমাকে বাড়ি ফিরতে হবে।”

শ্রীলঙ্কা সরকার কারফিউ জারি করে যতই বিক্ষোভ দমাতে চেষ্টা করুক, বিক্ষোভকারীরা প্রতিজ্ঞা করেছে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়াকে পদত্যাগে বাধ্য না করা পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাবে।

গত সোমবার বিক্ষোভ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের রূপ নিলে মাহিন্দা রাজাপাকসে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরে দাঁড়ান। বিক্ষোভকারীরা তার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। তিনি বর্তমানে পরিবার নিয়ে দেশের ‍উত্তরপূর্বের একটি নৌঘাঁটিতে লুকিয়ে আছেন। যেখান থেকে তারা দেশত্যাগের চেষ্টা করতে পারেন বলে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। বিক্ষোভকারীরা তাই ওই নৌঘাঁটির সামনেও অবস্থান নিয়ে আছেন।

এদিকে, শ্রীলঙ্কার একটি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত বৃহস্পতিবার মাহিন্দা, তার ছেলে নামাল এবং তাদের প্রধান প্রধান আরো কয়েকজন সহযোগীর দেশত্যাগের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বলে জানান আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা।

মাহিন্দা পদত্যাগের পর এ সপ্তাহেই নতুন প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া।

গত দুইদিন বন্ধ থাকা শ্রীলঙ্কার শেয়ারবাজার বৃহস্পতিবার খোলে। নতুন মন্ত্রিসভা গঠনের খবরে দিনের শেষভাবে শেয়ার বাজারে চাঙ্গাভাব দেখা গেছে।

ইতিহাসের সবচেয়ে বড় আর্থিক সংকট থেকে দেশেকে টেনে তুলতে গতমাসে পি নন্দলাল ভিরাসিংহকে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তিনি বলেছেন, দেশের অর্থনীতিকে পথে আনতে একটি স্থিতিশীল সরকার অপরিহার্য।

বুধবার তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট এবং অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোকে স্পষ্ট করেই বলেছি, আগামী দুয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফেরানো না হলে আমি পদত্যাগ করব।

“রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর কে থাকল, তাতে কিছু যায় আসে না। অর্থনীতির পতন ঠেকানোর অন্য কোনো উপায় নেই।”

দেশের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য বৃহস্পতিবার রাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাদের শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকারের সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে। চলমান সংকট কাটিয়ে উঠতে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া বারবার ঐক্য সরকার গঠনের কথা বলে আসছেন। কিন্তু বিরোধীদলের নেতারা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, গোটাবায়া পদত্যাগ না করা পর্যন্ত তারা কাজ করবেন না।

শ্রীলঙ্কা সরকার এখন ৫১ বিলিয়ন দেনার ভারে ডুবে আছে। ঋণের কিস্তি হিসেবে দেশটির এই বছর ৭ বিলিয়ন ডলার পরিশোধের কথা থাকলেও ওই অর্থ দেশটির হাতে নেই।

কোভিড-১৯ মহামারী ও ইউক্রেইনে যুদ্ধের প্রভাবে শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ মাত্র ৫ কোটি ডলারে নেমেছে। জীবন ধারনের নিত্যপণ্য যেমন রান্নার তেল, গ্যাস, জ্বালানি, ওষুধ, খাদ্যসহ অন্যান্য পণ্য আমদানি করা যাচ্ছে না। শ্রীলঙ্কা সরকার আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে হাত পাতলেও তেমন সাহায্য মেলেনি।

সাধারণ নাগরিকরা দেশের এই চরম আর্থিক দুর্দশার জন্য প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে ও তার ভাই মাহিন্দা রাজাপাকসে এবং তাদের পরিবারকে দায়ী করেছে।