নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবারের মৃত্যুর সংখ্যা গত শরতে ডেল্টার সংক্রমণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুর দিনটিগুলোকেও ছাপিয়ে গেছে।
গত শীতে করোনাভাইরাসের টিকা খুব সহজপ্রাপ্য ছিলো না। সে সময় যত মানুষের মৃত্যু হয়েছে, এবার ওমিক্রনের ঢেউয়ে মোট মৃত্যুর সংখ্যা তার দুই-তৃতীয়াংশ ছাড়িয়ে গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের আইনপ্রণেতারা মরিয়া হয়ে মহামারীর চেহারাটি বদলে দেওয়ার চেষ্টা করলেও মৃত্যুর সংখ্যা তাদের সব আশা মেঘে ঢেকে দিচ্ছে।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় যথাযথভাবে সাড়া দিতে দেশটির ব্যর্থতাই প্রকাশ করছে মৃত্যুর ওই দীর্ঘ তালিকা।
স্কটল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব এডিনবরার গ্লোবাল পাবলিক হেলথ বিভাগের প্রধান দেবী শ্রীধর বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রে মৃত্যুর হার অনেক অনেক বেশি, চোখে জল এনে দেওয়ার মত বেশি।”
তার মতে, যুক্তরাজ্যে এখন যে পরিস্থিতি, তাতে কোভিড বিধিনিষেধের কড়াকড়ি কিছুটা শিথিল করা যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র অনেক ‘পিছিয়ে আছে’।
বুস্টার ডোজ দেওয়ার ক্ষেত্রে আরও পিছিয়ে আছে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশটি। ফলে অতি সংক্রামক ওমিক্রন ধরনটি যখন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ল, দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ তখন একপ্রকার প্রতিরোধহীন অবস্থায়।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম ওমিক্রনের রোগী শনাক্ত হয় গত ১ ডিসেম্বর। কোভিড মহামারীতে মৃত্যুর হার নিয়ে নিউ ইয়র্ক টাইমসের বিশ্লেষণ বলছে, ওই সময় থেকে হিসাব করলে অন্য বড় ধনী দেশগুলোর চেয়ে যুক্তরাষ্ট্রে করোনাভাইরাসে মৃত্যুর হার কমপক্ষে ৬৩ শতাংশ বেশি।
মহামারীর পুরো সময়জুড়ে কোভিডে মৃত্যুর হার বিবেচনায় সাম্প্রতিক মাসগুলোতে ব্রিটেন ও বেলজিয়ামকে পেছনে ফেলেছে যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যুও হয়েছে সেখানে।
ওমিক্রনের সংক্রমণের উল্লম্ফনে মৃত্যু ও হাসপাতালে ভর্তি হওয়া ঠেকাতে অন্য দেশগুলোর সাফল্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাস্থ্যসেবা খাতের কর্মকর্তারা আশা খুঁজে পেলেও সেদেশের ভেতরের চিত্র আলাদা।
পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে হাসপাতালে কোভিড রোগী ভর্তির হার অনেক বেশি, অনেক রাজ্যই স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছে। ব্রিটিশদের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ ও জার্মানদের তুলনায় চারগুণ মৃত্যু দেখতে হচ্ছে আমেরিকানদের।
যুক্তরাষ্ট্রের কোভিডে মৃত্যুর হারকে এই শীতে ছাপিয়ে যেতে পারে যেসব ইউরোপীয় দেশ, তাদের মধ্যে আছে রাশিয়া, ইউক্রেইন, পোল্যান্ড, গ্রিস ও চেক রিপাবলিক। অর্থনৈতিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা এসব দেশে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগও অপ্রতুল।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের একজন সহযোগী অধ্যাপক জোসেফ ডাইলেম্যান, যিনি বিশ্বজুড়ে কোভিডের ফলাফল তুলনা করেছেন।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যুক্তরাষ্ট্রে দৈনিক গড় মৃত্যুর সংখ্যা আড়াই হাজারের মত। এর অন্যতম কারণ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকা বয়স্ক জনগোষ্ঠীকে টিকাদানের ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি।
আমেরিকানদের মধ্যে ৬৫ বছর বা বেশি বয়সের ১২ শতাংশ মানুষ মডার্না বা ফাইজার-বায়োএনটেকের দুই ডোজ বা জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজ টিকা পায়নি বলে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের (সিডিসি) পরিসংখ্যানে উঠে এসেছে।
এছাড়া একই বয়সী মানুষদের ৪৩ শতাংশ এখনও বুস্টার ডোজ নেননি বলেও সিডিসির তথ্যে জানা গেছে।
অথচ এর বিপরীতে ইংল্যান্ডে ৬৫ বছর বা বেশি বয়সের জনগোষ্ঠীর মাত্র ৪ শতাংশ পুরোপুরি টিকা পায়নি এবং ৯ শতাংশ বুস্টার ডোজ গ্রহণ করেনি।
ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের জরুরি বিভাগের একজন চিকিৎসক ড. মেগান র্যানি বলেন, কোভিডে আক্রান্ত হয়ে যেসব রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তাদের বেশিরভাগই টিকা না নেওয়া ব্যক্তি। তবে বুস্টার ডোজ না নেওয়া ব্যক্তিরাও এ ভাইরাসকে পরাস্ত করতে পারেন না সব সময়। যার কারণে তাদের বাড়তি অক্সিজেন দিতে হয় বা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়।
যুক্তরাষ্ট্রে কোভিড মহামারীর বিস্তার এবং টিকা গ্রহণে অবহেলার অন্যতম কারণ টিকার প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা।
মঙ্গলবার বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটে প্রকাশিত ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের দুই গবেষকের একটি গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কনোরাভাইরাসের সংক্রমণের হারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে টিকার প্রতি অনাস্থার হারের একটি সংযোগ রয়েছে।
গবেষকদের একজন টমাস বলিকি বলেন, “আমাদের গবেষণা বলছে, যখন আপনি একটি সংক্রামক ভাইরাসে সংক্রমিত হবেন, সরকারের জন্য তার নাগরিকদের সুরক্ষিত করার সবচেয়ে ভালো পথটি হল তাদের নিজেদের সুরক্ষিত করার বিষয়টি বোঝানো।”
যুক্তরাষ্ট্রের অনেক রাজ্যেই সংক্রমণের হার অনেক ওপরে থাকলেও বিজ্ঞানীদের আশা, এখনও অনেক মৃত্যু এড়ানো সম্ভব, যদি বয়স্ক ও বেশি ঝুঁকিতে থাকা আমেরিকানদের সুরক্ষিত করে তোলা যায়। সেজন্য মাস্ক পরা এবং সংক্রমিত কিনা তা পরীক্ষা করানো জরুরি।
আগামীতে সংক্রমণের নতুন কোনো ঢেউ যদি আসে, তাতে মৃত্যুর সংখ্যা নির্ভর করবে নতুন কোনো ভ্যারিয়েন্টের আবির্ভাব হচ্ছে কি না তার ওপর। পাশাপাশি আমেরিকানরা আর কত মৃত্যু মেনে নেবে, তার ওপর।