লকডাউনে ডাউনিং স্ট্রিটের পার্টি নেতৃত্বের ব্যর্থতায়: সু গ্রে

মহামারী শুরুর পর গত বছরের প্রথমভাবে গোটা ব্রিটেন যখন কড়া লকডাউনের বিধিনিষেধে আটকা, তখন ডাউনিং স্ট্রিটে খোদ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির বাগানে মদের পার্টি আয়োজনের পেছনে ‘নেতৃত্বের ব্যর্থতা’ দেখছেন ব্রিটিশ কেবিনেট অফিসের তদন্ত দলের প্রধান সু গ্রে।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 Feb 2022, 04:39 AM
Updated : 1 Feb 2022, 06:33 AM

বিবিসির খবরে বলা হয়, যুক্তরাজ্যের এই জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা সোমবার তার দীর্ঘ প্রতীক্ষিত প্রতিবেদনে লকডাউনের বিধিভঙ্গের প্রমাণ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন; তিনি বলেছেন, কিছু অনুষ্ঠান সে সময় হয়েছিল, যেগুলোর অনুমতি দেওয়া ‘উচিত হয়নি’।

ওই পার্টির আয়োজন নিয়ে পার্লামেন্টে সমালোচনার মুখে থাকা প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, তিনি এ অনুসন্ধানের ফল পুরোপুরি মেনে নিচ্ছেন।

অবশ্য বিরোধীদলের পদত্যাগের আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে এর আগে তিনি বলেছিলেন, ‘কোনও নিয়মই ভঙ্গ হয়নি’।

২০২০ সালের মে মাসে লকডাউনের বিধি ভেঙে ডাউনিং স্ট্রিট এবং বিভিন্ন সরকারি অফিসে পার্টি এবং তার কোনো কোনোটিতে খোদ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের অংশগ্রহণের খবর নিয়ে গত বছরের শেষ দিকে যুক্তরাজ্যের সংবাদমাধ্যমে শোরগোল শুরু হয়।

বিষয়গুলো তদন্তের জন্য গত ডিসেম্বরে যুক্তরাজ্যের কেবিনেট সেক্রেটারি সিমন কেইসকে দায়িত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী জনসন। কিন্তু কেবিনেট অফিসেই সেরকম একটি আয়োজন হয়েছিল- এমন ইঙ্গিত মেলার পর সিমন কেইস তদন্ত থেকে সরে দাঁড়ান এবং আরেক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা সু গ্রেকে তদন্তের দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয়।

জ্যেষ্ঠ এই কর্মকর্তা ১৬টি আলাদা জনসমাগমের ঘটনার তদন্ত করেছেন - যার তিনটির বিষয়ে সাধারণ মানুষ আগে জানতে পারেনি।

সু গ্রের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোভিড বিধিভঙ্গের এসব ঘটনার মধ্যে আটটি আলাদা তারিখের ১২টি ঘটনার বিষয়ে লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশ তদন্ত করছে।

এসব ঘটনার মধ্যে ২০২০ সালের ২০ মে ডাউনিং স্ট্রিটের বাগানে আয়োজিত ‘ব্রিং ইওর ওউন বুজ’ পার্টি রয়েছে, যেখানে অংশগ্রহণ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী জনসন এরইমধ্যে ক্ষমা প্রার্থনা করেছেন। ওই বছর ১৯ জুন আয়োজিত প্রধানমন্ত্রীর জন্মদিনের অনুষ্ঠানও রয়েছে এ তালিকায়।

এছাড়া জনসনের ডাউনিং স্ট্রিটের বাড়িতে ২০২০ সালে ১৩ নভেম্বরের একটি জমায়েতের ঘটনা রয়েছে পুলিশের তদন্তের মধ্যে।

পার্লামেন্টের বিরোধী দল লেবার পার্টির এমপিরা প্রশ্ন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নভেম্বরের অনুষ্ঠানেও উপস্থিত ছিলেন কিনা। জবাবে জনসন বলেছেন, পুলিশের তদন্তনাধীন বিষয়ে কোনো মন্তব্য তিনি করবেন না।  

সু গ্রে বিবিসিকে বলেছেন, কতটুকু তিনি বলতে পারবেন তার আওতা ‘খুবই সীমিত’ হয়ে গেছে মেট্রোপলিটন পুলিশের চলমান তদন্তের কারণে। এ পর্যায়ে একটি ‘অর্থবহ’ প্রতিবেদন প্রকাশ করার সুযোগ তার নেই।

তবে ডাউনিং স্ট্রিটের জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মীদের মধ্যে যে পার্টি সংস্কৃতি চলছে, তার স্পষ্ট সমালোচনা করেছেন সু গ্রে।

তিনি বলেছেন, কিছু অনুষ্ঠান আয়োজনের ক্ষেত্রে সুরক্ষা বিধি মানা হয়নি, অথচ পুরো ব্রিটিশ জনগণ সেই একই বিধি মেনে চলবে বলে সরকারের তরফ থেকে আশা করা হয়েছিল। জনগণের সামনে বিষয়টি প্রকাশ পেলে প্রতিক্রিয়া কী হবে- তা নিয়েও খুব মাথাব্যথা করেনি।

তদন্ত প্রতিবেদনে সু গ্রে লিখেছেন, “বিভিন্ন সময়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের বিভিন্ন অংশে বিবেচনাবোধের অভাব ও নেতৃত্বের ব্যর্থতা ছিল।

“কিছু অনুষ্ঠান আয়োজনের অনুমতি দেওয়া উচিত হয়নি। অন্য অনুষ্ঠানগুলো যেভাবে হয়েছে, সেভাবে করতে দেওয়াও ঠিক হয়নি।”

সু গ্রে তার মতামতে বলেছেন, “কখনোই একটি পেশাদার কর্মস্থলে অতিরিক্ত মদ্যপান উচত নয়।

বিবিসি লিখেছে, এ বক্তব্যের মাধ্যমে সু গ্রে সম্ভবত ডাউনিং স্ট্রিটের বাগানে অতিথিদের মাতলামি, মদ পানের বিষয়ে ‘উদার নীতি’ এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মীদের সুটকেসে মদের বোতল ভরার ছবির দিকেই ইঙ্গিত করেছেন।

বরিস জনসনের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়েও সমালোচনা রয়েছে ওই প্রতিবেদনে।

ক্ষমতাসীন কনজারভেটিভ পার্টির কয়েকজন এমপি বলেছিলেন, জনসনকে প্রধানমন্ত্রীকে দায়িত্ব থেকে সরানোর চেষ্টা করবেন কিনা- সেই সিদ্ধান্ত নিতে তারা এ তদন্ত প্রতিবেদনের অপেক্ষায় আছেন।

কনজারভেটিভ পার্টির সংসদীয় গ্রুপ ‘১৯২২ কমিটির’ কাছে যদি কমপক্ষে ৫৪ জন এমপি, যাদের মধ্যে পেছনের সারির এমপিদের প্রতিনিধিত্বও থাকতে হবে, প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অনাস্থা জানিয়ে চিঠি দেন, তাহলে এ বিষয়ে ভোটের আয়োজন হবে।

সোমবার সন্ধ্যায় বরিস জনসন ওই কমিটির সভায় বক্তব্য দেন। সভা শেষে কেবিনেট মিনিস্টার জ্যাকব রিস-মগ বলেন, “ইতিবাচক বৈঠক হয়েছে।”

আর প্রধানমন্ত্রীর দীর্ঘদিনের সমালোচক হিসেবে পরিচিত কনজারভেটিভ পার্টির একজন এমপি বিবিসিকে বলেছেন, অনাস্থা প্রস্তাবের ভোটাভুটিতে যাওয়ার মত যথেষ্ট স্বাক্ষর সংগ্রহের সম্ভাবনা খুবই কম।

‘কিছু বিষয় ঠিক হয়নি’

এর আগে হাউজ অব কমন্সে দেওয়া বক্তব্যে বরিস জনসন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, সু গ্রের তদন্ত থেকে তিনি পরামর্শগুলো নেবেন। তিনি বলেছিলেন, “আমি বুঝতে পেরেছি, আমি এটা শুধরে নেব।”

জনসন বলেছিলেন, “আমি দুঃখপ্রকাশ করছি। সোজা কথায়, বিষয়গুলো আমরা ঠিকভাবে সামলাতে পারিনি। যেভাবে বিষয়গুলো সামলানো হয়েছে, সেজন্যও আমি দুঃখিত।”

ডাউনিং স্ট্রিট যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাতে পরিবর্তন আনার অঙ্গীকারও তিনি করেন।

লেবার পার্টির নেতা স্যার কিয়ের স্টারমার বলেছেন, “ব্রিটিশ জনগণ আশা করে, প্রধানমন্ত্রী জনসন ভদ্রলোকের মত কাজ করবেন এবং পদত্যাগ করবেন। কিন্তু তিনি একজন নির্লজ্জ মানুষ।”

ওই ঘটনাগুলোর বিষয়ে এমপিদের সামনে প্রধানমন্ত্রী ‘মিথ্যাচার’ করেছেন বলে অভিযোগ তোলার পর ওয়েস্টমিনস্টারে এসএনপির নেতা ইয়ান ব্ল্যাকফোর্ডকে কমন্স চেম্বার ত্যাগ করতে বলা হয়। 

প্রধানমন্ত্রী জনসন পার্লামেন্টে বলেছেন, সরকারের কার্যক্রমের মানের উন্নয়ন ঘটাতে এবং সরকারি কর্মচারী বিধিমালা পর্যালোচনা করতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি দপ্তর চালু করবেন।

তবে ওই বক্তব্যের পরও বিরোধীরা ক্রমাগত তার পদত্যাগের দাবি এবং সু গ্রের পূর্ণাঙ্গ তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশের আহ্বান জানিয়ে গেছেন।

টোরি দলের কিছু এমপি প্রধানমন্ত্রীর সমর্থনে বক্তব্য দিলেও অন্যরা সমালোচনা করেছেন।

সাবেক প্রধানমন্ত্রী এবং টোরি নেতা টেরিজা মে বলেন, “কোভিড বিধিনিষেধ জনজীবনের স্বাধীনতায় উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছিল। তাদের এটা আশা করার অধিকার রয়েছে যে তাদের প্রধানমন্ত্রী নিয়মগুলো পড়ে দেখবেন, বিধিগুলোর অর্থ বোঝার চেষ্টা করবেন এবং তার আশপাশে যারা আছেন, তারাও একই কাজ করবেন এবং ওই বিধিগুলোর মেনে চলার ক্ষেত্রে উদাহরণ সৃষ্টি করবেন।”

গত সপ্তাহে মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, সু গ্রের প্রতিবেদনে তাদের তদন্তনাধীন বিষয়গুলোর ‘নূন্যতম রেফারেন্স’ রাখা যাবে, যাতে ‘তদন্তে কোনো ধরনের পক্ষপাত না হয়।’ এরপর সু গ্রে তার প্রতিবেদন নতুন করে লিখতে বাধ্য হন।

পুলিশের তদন্ত দলের নেতা কমান্ডার ক্যাথেরিন রোপার বলেছেন, তার কর্মকর্তারা এ পর্যন্ত তিনশর বেশি আলোকচিত্র এবং পাঁচশ পৃষ্ঠার বেশি কাগজপত্র দেখেছেন। এখন তারা ব্যক্তিগত ইমেইল এবং অন্যান্য বার্তা শনাক্ত করার চেষ্টা করবেন, যেখান থেকে বিধিভঙ্গের সম্ভাব্য ইঙ্গিত পাওয়া যায়।

ডাউনিং স্ট্রিটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের তদন্ত শেষ হলে তাদের অনুসন্ধান ফলের আলোকে প্রতিবেদনটি হালনাগাদ করার জন্য সু গ্রেকে আহ্বান জানাবেন প্রধানমন্ত্রী। তখন তিনি ওই হালানাগাদ প্রতিবেদন প্রকাশ করবেন।

পুরনো খবর