উত্তর প্রদেশ নির্বাচনে গোরক্ষাই এখন বিজেপি’র মাথাব্যথা

ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যে আগামী ফেব্রুয়ারিতেই বিধানসভা ভোট। প্রচার এখন তুঙ্গে। আর ঠিক এ সময়েই ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) গোরক্ষা রাজনীতি এখন সেখানে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সামনে।

নিউজডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 Jan 2022, 07:03 PM
Updated : 25 Jan 2022, 07:43 PM

উত্তর প্রদেশের গ্রামগুলোতে মালিকবিহীন মুক্ত গরুর পাল নিয়ে মানুষ ক্রমেই আতঙ্কিত, বিরক্ত হয়ে উঠছে। গরুগুলো খাবারের জন্য ফসলের খেতে হামলে পড়ছে, এমনকী মানুষকে আক্রমণ করতেও ছাড়ছে না। গরুর গুঁতোয় ঘটছে মৃত্যুর ঘটনাও।

হিন্দু ধর্মে গরু অত্যন্ত পবিত্র প্রাণী। সে বিবেচনায় উত্তর প্রদেশের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ক্ষমতায় আসার পরই রাজ্যে গোহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন। এতে সেখানে গরুর সংখ্যা ‍অনেক বেড়ে গেছে।

গত বছর নভেম্বরের হিম হিম সন্ধ্যায় ৫৫ বছরের কৃষক রাম রাজ বাড়ির উঠানে বসে চা খাচ্ছিলেন। হঠাৎ করেই একটি খ্যাপা গরু তার উপর আক্রমণ করে। বাড়ির লোকেদের চোখের সামনে কয়েক মিনিট ধরে চলা ওই আক্রমণে রাম রাজ গুরুতর আহত হন এবং হাসপাতালে যাওয়ার পথে তার মৃত্যু হয়।

নিহতের ছেলের বউ অনিতা কুমারি বলেন, “আমাদের জন্য খুবই বেদনাদায়ক মৃত্যু ছিল সেটি। তারপর থেকে আমার শাশুড়ি শোকে ঠিকমত খাবারও খাচ্ছেন না।”

উত্তর প্রদেশে গরুর এ ধরনের আক্রমণ এখন সাধারণ ঘটনা হয়ে উঠেছে। গরু জবাই নিষিদ্ধ হওয়ায় সেখানে গরুর সংখ্যা বাড়ার পাশাপাশি দাপটও এতটাই বেড়েছে যে, গরুই এখন রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনে বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে।

হিন্দুদের কাছে গরু পবিত্র হলেও বিজেপি নতুন আইন করার আগ পর্যন্ত উত্তর প্রদেশের কৃষকরা ষাঁড় চাষ করার অনুপযুক্ত হলে এবং গাভী দুধ দেওয়া বন্ধ করে দিলে সেগুলো কসাইখানায় বিক্রি করে দিতেন। দুঃসময়ে সেই অর্থ তাদের কাজে লাগত। কিন্তু গোহত্যা নিষিদ্ধ হওয়ার পর তারা আর সেকাজ করতে পারছেন না। ফলে অনেকেই গরু খোলা ছেড়ে দিচ্ছেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন সরকার হিন্দুত্ববাদী কর্মসূচি হিসেবে গোহত্যা কঠোরভাবে দমন করেছে। বিজেপি’র নির্বাচনী ইশতেহারের একটি ছিল গোহত্যা বন্ধ করা। উত্তর প্রদেশসহ ভারতের ১৮টি রাজ্যে এখন গোহত্যা অবৈধ।

কট্টরপন্থি বিজেপি নেতা মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ২০১৭ সালে উত্তর প্রদেশের ক্ষমতায় আসার পর অবৈধ অভিযোগে বেশ কয়েকটি কসাইখানা বন্ধ করে দিয়েছেন। যদিও উত্তর প্রদেশে মাংসের ব্যবসা রমরমা। মহিষের মাংসের প্রধান রপ্তানিকারক রাজ্য এটি।

ভারতে সাধারণত মুসলমান এবং দলিত সম্প্রদায়ের লোকজন মাংসের জন্য গরু কেনাবেচা করে এবং কসাইখানাগুলো চালায়। গোহত্যা নিষিদ্ধ হওয়ার পর গত কয়েকবছরে তারা কয়েকবারই বিজেপি বা স্থানীয় ডানপন্থি উগ্র গোষ্ঠীর গোরক্ষা বাহিনীর আক্রমণের শিকার হয়েছেন। এমনকী ‍বাড়িতে গরুর ‍মাংস সংরক্ষণের অভিযোগ তুলেও হামলা এবং পিটিয়ে হত্যার মত ঘটনা ঘটেছে।

এমন হামলার কারণে কাসাইখানা এবং মাংসের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত অনেকেই ভয়ে ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে এখন অন্য পেশা বেছে নিয়েছেন। কৃষক শিব পূজান বিবিসি-কে বলেন, ‘‘এখন গরু কেনার কেউ নেই। কেউ সেগুলোকে বিক্রি করতে পারছেনা। যে কারণে আমরা বাধ্য হয়ে অনুৎপাদনশীল গরু কাছের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়ে আসি।”

আর কৃষকদের ছেড়ে দেওয়গরুগুলো খাবারের অভাবে জঙ্গল থেকে বের হয়ে গ্রাম এবং ছোট ছোট শহরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ক্ষুধার্ত গরুগুলো প্রায়ই আক্রমণাত্মক হয়ে উঠছে। কৃষক শিব জানান, তিনি নিজেও মাঠে গরুর হামলায় আহত হয়েছেন। তিনি বলেন, “দুইটি গরু আমাকে মাটিতে চেপে ধরেছিল। জীবন রক্ষায় আমি কোনওরকমে দৌড়ে পালিয়ে যাই।”

শিব নিজেও গোড়া হিন্দু। তিনিও বিশ্বাস করেন গরু পবিত্র প্রাণী। কিন্তু গোরক্ষার নামে সরকার সব ধরনের গোহত্যা নিষিদ্ধ করায় তিনি হতাশা প্রকাশ করেছেন।

পুনম দুবেই নামে ৩৬ বছরের আরেক নারীর স্বামীকে একটি খোলা ষাঁড় হত্যা করেছে। তিনি বিবিসি-কে বলেন, ‘‘খোলা ছেড়ে দেওয়া একটি ষাঁড়ের কারণে আজ আমার ছেলে এতিম। কে ‍আমাদের দেখভাল করবে।”

পুনমের স্বামী ভুপেন্দ্র দুবেই কোভিড-১৯ মহামারীর প্রথম ধাক্কায় চাকরি হারিয়ে গ্রামে ফিরে এসেছিলেন। তিনি স্থানীয় একটি বাজারে ছেলের জন্য মিষ্টি কিনতে গিয়ে ষাঁড়ের হামলায় নিহত হন।

পুনমদের গ্রাম থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরের আরেকটি গ্রামের রাম কালী নামে ৮০ বছরের এক বৃদ্ধা ২০১৯ সালে গরুর হামলায় আহত হয়ে কোমায় চলে যান। তিনি জানেনও না গত বছর কোভিডে তার ছেলের ‍মৃত্যু হয়েছে।

উত্তর প্রদেশে গোরক্ষার নামে রাজনীতি অনেক দিন ধরেই চলছে। এবার রাজ্যের বিরোধীদলগুলো খোলা ছেড়ে দেওয়া গরুর হামলার ঘটনাকে নির্বাচনী প্রচারের হাতিয়ার বানিয়েছে। আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে উত্তর প্রদেশে বিধানসভা নির্বাচনের ভোট শুরু হবে।

ভারতের সবচেয়ে জনবহুল এই রাজ্যে গ্রামাঞ্চলের ভোটেরদের ভোট জয়পরাজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। গোরক্ষার নামে রাজনীতি করে আসা ক্ষমতাসীন বিজেপি এখন এ সমস্যা সমাধানে ‘নতুন কৌশল প্রণয়নের’ চেষ্টা করছে। খোলা ছেড়ে দেওয়া গরুগুলোকে রাখার জন্য স্থানীয় সরকার থেকে অযোধ্যা জেলায় একটি আশ্রয়কেন্দ্র বানানো হয়েছে।

কিন্তু ওই আশ্রয়কেন্দ্রে এত গরুর জায়গা হচ্ছে না। কেন্দ্রের তত্ত্বাবধায়ক শত্রুঘ্ন তিওয়ারি বলেন, ‘‘আমাদের এখানে সর্বোচ্চ দুইশ গরু রাখা সম্ভব। কিন্তু এই এলাকায় ৭০০ থেকে ১০০০ গরু খোলা ঘুরে বেড়াচ্ছে।”

অনেক কৃষক ফসলের ক্ষেত বাঁচাতে পালা করে পাহারা দিচ্ছেন। এ নিয়ে হতাশ কৃষকরা বলছেন, তারা এবারের ভোট বয়কট করার কথা ভাবছেন। এমন একজন দিনা নাথ বলেন, ‘‘কি লাভ ভোট দিয়ে, যদি এটার মাধ্যমে আমাদের সমস্যার কোনও সমাধানই না হয়।”