মহামারীর আরেকটি ঢেউ এড়াতে টিকা নেওয়ার উপযুক্ত সব মানুষকে এর আওতায় আনতে চাইছে যুক্তরাজ্য। ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ পূর্ণ বয়স্ক সবাইকে কোভিড-১৯ টিকার তৃতীয় ডোজ দিতে প্রচার বাড়ানো হয়েছে।
প্রাথমিক তথ্যের ভিত্তিতে দক্ষিণ আফ্রিকার গবেষকরা বলছেন ওমিক্রনে আক্রান্তদের উপসর্গ থাকছে মৃদু। তবে টিকা নেওয়ায় কিংবা কোভিড আক্রান্ত হয়ে সেরে ওঠার কারণে শরীরে যে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, তা কতটা কার্যকর সে বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।
সংক্রমণের বিস্তার নিয়ন্ত্রণে নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা বিবেচনা করছে ডেনমার্কসহ বিভিন্ন দেশ।
এরই মধ্যে ওমিক্রনের কবলে পড়া দেশগুলোর অভিজ্ঞতা, পদক্ষেপ আর গবেষণা থেকে অন্য দেশগুলো কী শিখতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে সিএনএনের একটি প্রতিবেদনে।
ওমিক্রন ঠেকাতে অনেক দেশ তড়িঘড়ি ভ্রমণ বিধি আরোপের পথে গেলেও করোনাভাইরাসের নতুন এ ধরনটি খুব দ্রুত গতিতে পুরো বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থা সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মহাপরিচালক তেদ্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস মঙ্গলবার একং সংবাদ ব্রিফিংয়ে বলেছেন, বিশ্বের ৭৭টি দেশে ‘ওমিক্রন’ এর সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে।
“বাস্তবতা হচ্ছে ওমিক্রন সম্ভবত সব দেশেই আছে, হয়ত সবখানে এখনও পর্যন্ত তা শনাক্ত হয়নি। ওমিক্রন এমন দ্রুততায় ছড়িয়ে পড়ছে, যা এর আগে কোনো ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে আমরা দেখতে পাইনি।
“আমাদের শঙ্কার কারণ মানুষ ওমিক্রনকে হালকাভাবে নিচ্ছে। আমরা এখন নিশ্চিতভাবেই বুঝতে পারি যে, ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও এ ভাইরাসকে আমরা অবজ্ঞা করেছিলাম।”
ওমিক্রণের সংক্রমণে উপসর্গগুলো মৃদু থাকার যে তথ্য পাওয়া গেছে, সে প্রসঙ্গে ডব্লিউএইচও মহাপরিচালক বলেন, “সংক্রমণের ঊর্ধ্বগতি অপ্রস্তুত স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে আবারও গ্রাস করে ফেলতে পারে।”
দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরন শনাক্তের খবর জানানোর পর যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ আফ্রিকার যাত্রীদের ক্ষেত্রে ভ্রমণ কড়াকড়ি আরোপ করেছিল।
এখন যুক্তরাজ্যেই ওমিক্রনের সংক্রমণ বেড়ে গেছে। তারপরও আফ্রিকার ১১টি দেশকে ভ্রমণ বিধিনিষেধের ‘লাল তালিকা’ থেকে বাদ দিয়েছে ব্রিটিশ সরকার। এর ফলে ওইসব দেশ থেকে যুক্তরাজ্যে প্রবেশে কোয়ারেন্টিনের কড়াকড়ি ততটা থাকবে না।
সিএনএন এর প্রতিবেদনে বলা হয়, নতুন এই ধরনটি এরই মধ্যে পুয়ের্তো রিকো এবং যুক্তরাষ্ট্রের ৩৬টি রাজ্যে শনাক্ত হয়েছে।
ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব সাউথহ্যাম্পটন এর জ্যেষ্ঠ রিসার্চ ফেলো মাইকেল হেড বলেন, “আমার মনে হয় ওমিক্রন খুব দ্রতই সবখানে ছড়িয়ে পড়বে।
“পরীক্ষার ব্যবস্থা এবং জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ করার সক্ষমতার অভাবে যেসব দেশে এখনও শনাক্ত হয়নি, বাস্তবে সেখানেও ওমিক্রন আক্রান্ত অনেকে থাকবেন।”
বেশি সময় নেবে না ওমিক্রন
যুক্তরাজ্যে প্রথম ওমিক্রনের সংক্রমণ ধরা পড়ে গত ২৭ নভেম্বর। যুক্তরাজ্যের হেলথ সিকিউরিটি এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, দাপটের দিক দিয়ে গত মঙ্গলবারই লন্ডনে ডেল্টাকে ছাড়িয়ে গেছে ওমিক্রন। অর্থাৎ সেখানে ডেল্টায় যত মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে, তার চেয়ে ওমিক্রনে হচ্ছে বেশি।
যুক্তরাজ্যের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সাজিদ জাভেদ মঙ্গলবার জানিয়েছেন, দেশটিতে প্রতি দুই দিনে ওমিক্রনে আক্রান্তের সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাচ্ছে।
যুক্তরাজ্যে গত বৃহস্পতিবার ৮৮ হাজার ৩৭৬ জনের নতুন করে সংক্রমণ ধরা পরেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী মহামারী শুরুর পর থেকে দৈনিক শনাক্তের হারে এটাই সর্বোচ্চ। দক্ষিণ আফ্রিকাতেও বুধবার সংক্রমণের রেকর্ড হয়েছে।
জনস্বাস্থ্য বিষয়ে লন্ডনের আঞ্চলিক পরিচালক কেভিন ফেনটন টুইটারে লিখেছেন, “এখন আগের চেয়ে দ্রততার সঙ্গে আপনার প্রথম, দ্বিতীয় অথবা বুস্টার ডোজ নিয়ে নিন। দয়া করে ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দেবেন না।”
ডেনমার্কের স্টেটেনস সেরাম ইনস্টিটিউট (এসএসআই) জানিয়েছে, সেখানে এ সপ্তাহেই আধিপত্য বিস্তার করা ধরন হয়ে উঠতে পারে ‘ওমিক্রন’। বৃহস্পতিবার এক দিনে সে দেশে প্রায় ১০ হাজার মানুষের দেহে সংক্রমণ ধরা পড়েছে।
শনাক্তের হার ‘অনেক, অনেক উঁচুতে’ মন্তব্য করে ড্যানিশ প্রধানমন্ত্রী মেট ফ্রেডরিকসেন বলেন, “কোনো সন্দেহ নেই, সংক্রমণের এই শেকল ভাঙতে নতুন ব্যবস্থা নিতে হবে।”
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান উরসুলা ফন ডের লিয়েন ব্রাসেলসে জানিয়েছেন, জানুয়ারির মাঝামাঝি ইউরোপের ২৭টি দেশে আধিপত্য বিস্তার করা ধরন হয়ে উঠতে পারে ‘ওমিক্রন’।
ইউরোপিয়ান সেন্টার ফর ডিজিজ প্রিভেনশন অ্যান্ড কন্ট্রোল (ইসিডিসি) ঝুঁকি পর্যালোচনা করে গত বুধবার সবশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ওই অঞ্চল ওমিক্রনের আরও বিস্তার ঘটার ‘উচ্চ ঝুঁকি’ রয়েছে।
করোনাভাইরাসের ডেল্টা ধরনের কারণে যত মৃত্যু এবং হাসপাতালে ভর্তির পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছিল, ওমিক্রনের কারণে সে সংখ্যা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলেও শঙ্কা প্রকাশ করেছে ইসিডিসি।
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি আ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেজ এর পরিচালক অ্যান্থনি ফাউচি বুধবার সিএনএনকে বলেন, সেখানেও ওমিক্রনের আধিপত্য ‘অবশ্যম্ভাবী’ হয়ে উঠেছে বলে তিনি মনে করছেন।
তবে সংক্রমণের পর ভাইরাসের এ ধরনটি কতটা গুরুতর অসুস্থতার কারণ হতে পারে, তা এখনও স্পষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন ফাউচি।
বিশ্বের অন্যান্য স্থানে ওমিক্রন কীভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে তা বুঝতে দক্ষিণ আফ্রিকার তথ্যগুলো খতিয়ে দেখছেন বিজ্ঞানী ও গবেষকরা।
দক্ষিণ আফ্রিকার ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর কমিউনিকেবল ডিজিজেস (এনআইসিডি) বলেছে, এখনও তথ্য সংগ্রহের কাজ চলছে, তবে প্রাপ্ত নমুনা বলছে, এবারের ঢেউটা হয়তো মৃদু হবে।
মঙ্গলবার ডিসকভারি হেলথ এর প্রকাশিত এক সমীক্ষায় বলা হয়, দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩৭ লাখ মানুষের স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে কাজ করা বড় একটি কোম্পানি নতুন ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে টিকায় কম সুরক্ষা পাওয়ার কথা জানিয়েছে। তবে আগের ধরনের চেয়ে ওমিক্রনে আক্রান্তদের লক্ষণ মৃদু বলেও তাতে দেখা গেছে।
গবেষকরা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি ফাইজার-বায়োএনটেকের দুই ডোজ টিকা সার্বিকভাবে ৩৩ শতাংশ সুরক্ষা দেয়। তবে হাসপাতালে ভর্তি করাসহ গুরুতর জটিলতা ঠেকাতে এর ৭০ শতাংশ কার্যকরিতা পাওয়া গেছে।
সমীক্ষায় জানানো হয়, করোনাভাইরাসের মূল ধরনের চেয়ে ‘ওমিক্রন’ আক্রান্ত হয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের হাসপাতালে ভর্তির ঝুঁকি ২৯ শতাংশ কম।
তবে ইংল্যান্ডের প্রধান চিকিৎসা কর্মকর্তা ক্রিস হুইটি হুঁশিয়ার করে বলেছেন, যুক্তরাজ্যে দৈনিক শনাক্তের সংখ্যা বাড়ছে এবং আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রেকর্ড ছাড়িয়ে আরও অনেক বেড়ে যাবে।
সেক্ষেত্রে তা বড় সঙ্কট হয়ে উঠতে পারে- এমন আশঙ্কা জানিয়ে বুধবার তিনি বলেন, “দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা এবং যুক্তরাজ্যের বিজ্ঞানীসহ সারা বিশ্বের বিজ্ঞানীরা এর যথার্থ অনুপাত নির্ণয়ের চেষ্টা করে যাচ্ছেন।”
কেবল টিকায় হবে না
বিভিন্ন দেশে ওমিক্রনের বিস্তারের মধ্যে সংক্রমণ কমানোর জন্য সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা এবং আবদ্ধ স্থানে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসের ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিচ্ছেন চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান গেব্রিয়েসুস বলেন, “টিকা মাস্কের বিকল্প নয়, দূরত্ব বজায় রাখার বিকল্প নয়, পর্যাপ্ত আলো-বাতাস কিংবা স্বাস্থ্যবিধিরও বিকল্প নয়। সবগুলো একসঙ্গে লাগবে। প্রতিনিয়ত এবং ভালভাবে এটা মানতে হবে।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, ওমিক্রনের উপসর্গ রয়েছে এমন সংক্রমণ বেশ অনেকটাই কমিয়ে আনতে পারে টিকার দুটি ডোজ। তবে তৃতীয় বা বুস্টার ডোজ ৭০ শতাংশ পর্যন্ত সুরক্ষা দেবে।
টিকার বুস্টার ডোজের জন্য প্রচারের গতি বাড়ানোর পাশাপাশি যুক্তরাজ্যের পার্লামেন্ট ‘কোভিড পাস’ চালুর অনুমোদন দিয়েছে।
নাইটক্লাব এবং বড় ভেন্যুতে প্রবেশের সময় এই পাস দেখাতে হবে। টিকার দুটি ডোজ নেওয়ার প্রমাণ থাকতে হবে কিংবা সাম্প্রতিক পরীক্ষায় কোভিড নেগেটিভ হতে হবে।
এছাড়া বেশিরভাগ আবদ্ধ স্থানে মাস্ক পড়া বাধ্যতামূলক করতে ব্যবস্থা নেওয়ারও অনুমোদন দিয়েছেন দেশটির আইন প্রণেতারা।
ফের লকডাউন?
ওমিক্রন দ্রত ছড়াতে থাকলেও নতুন করে লকডাউনের আলোচনা খুব কমই দেখা যাচ্ছে এবার।
“গত বছরের চেয়ে পরিস্থিতি এখন অনেক আলাদা, কারণ আমাদের এখন টিকার বাড়তি সুরক্ষা রয়েছে এবং নমুনা পরীক্ষার সামর্থ্যও বেড়েছে।
“আমার মনে হয় বৈজ্ঞানিকভাবে আরও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অত্যন্ত জোরালো যুক্তি রয়েছে, কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এর গহণযোগ্যতা কম।”
অবশ্য লকডাউনকে ‘কার্যকর শেষ অস্ত্র’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন জনসন। তিনি বলেন, “একটা পর্যায়ে লকডাউন দেওয়ার দরকার হতে পারে এবং সব দেশকেই এ বিষয়ে বাস্তবাবাদী হতে হবে।”
লকডাউনে না গেলেও ওমিক্রন ও ডেল্টা ধরনের বিস্তার ঠেকাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ নানা কড়াকড়ির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। এ সপ্তাহে রেস্তোরাঁ এবং বারে অ্যালকোহল পরিবেশন নিষিদ্ধ করেছে নরওয়ে। সেইসঙ্গে স্কুলে আরও বিধিনিষেধ আরোপ করে মানুষের মাঝে টিকা দেওয়ার গতি বাড়ানো হয়েছে।
তবে যেসব দেশে কেভিড টিকা নেওয়ার হার বেশি, সেখানে মানুষ একভাবে মেনেই নিয়েছে যে, করোনাভাইরাসকে সঙ্গী করেই বেঁচে থাকতে হবে।
‘ওমিক্রন’ এর সংক্রমণ বাড়ার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসে এ সপ্তাহে বিধিনিষেধ শিথিল করা হয়েছে। এ রাজ্যে ১৬ বছর এবং তার বেশি বয়সীদের মধ্যে ৯৩ দশমিক ৩ শতাংশকে টিকার পূর্ণ দুটি ডোজ দেওয়া হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ফোরবিসি রেডিওকে বলেন, “ভাইরাস এখানেও আছে। ওমিক্রন এই অস্ট্রেলিয়াতেও রয়েছে। আমরা ভাইরাসের সঙ্গেই আমাদের বসবাস করতে হবে, আমাদের আর পেছেনের দিকে টানতে দেব না।”