ওমিক্রন: মহামারীর আরেকটি ঢেউ ঠেকানোর জুয়ায় ভারত

পুনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ভাইরোলজির (এনআইভি) গবেষকরা এখন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করে চলেছেন, এটিই ভারতের সবচেয়ে পুরনো জিনোম সিকোয়েন্স কেন্দ্র।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 Dec 2021, 06:34 PM
Updated : 13 Dec 2021, 06:34 PM

দেশটির অন্যান্য পরীক্ষাগারেও এখন তুমুল ব্যস্ততা; করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ এর বিস্তার ঠেকাতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের শনাক্ত করার চেষ্টা করে যাচ্ছেন তারা।  

এ বছরের মার্চ-এপ্রিলে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নাজুক অবস্থায় ফেলে দিয়েছিল ভারতকে। বছর না ঘুরতেই সংক্রমণের আরও একটি ঢেউ এড়াতে গবেষকদের মরিয়া চেষ্টার চিত্র ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বিবিসির এক প্রতিবেদনে।

দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘ওমিক্রন’ শনাক্ত হওয়ার পর এখন প্রতিদিন ছোট ছোট বাক্সে সিল করা প্রায় ১০০ নমুনা পাচ্ছে এনআইভি।আগে নমুনা পাওয়া যেত এর পাঁচ ভাগের এক ভাগ। 

ইতোমধ্যে ভারতের ছয়টি রাজ্যে ৩৮ জনের শরীরে ওমিক্রনের সংক্রমণ ধরা পড়ার কথা জানিয়েছেন দেশটির চিকিৎসা কর্মকর্তারা।

এনআইভির একটি বায়ুরোধী কক্ষে সুরক্ষা পোশাক পরে নমুনার বাক্স খোলেন গবেষকরা, এরপর শুরু হয় ভাইরাসটি আলাদা করার প্রক্রিয়া। নম্বর সেঁটে দেওয়ায় কার নমুনা পরীক্ষা করছেন তা তারা জানতে পারেন না।

এ কাজের নেতৃত্বে থাকা এনআইভির জ্যেষ্ঠ বিজ্ঞানী ড. বর্ষা পোদ্দারের ফোনটি বাজতে থাকে অনবরত।বেশিরভাগ কল আসে দ্রুত ফল জানানোর জন্য।

তিনি বলেন, “আমাদের ওপর অনেক চাপ যাচ্ছে। কিন্তু আমাদের তো ঠিকভাবে কাজটা করতে হবে; চাইলেই অল্প সময়ে এটা করা সম্ভব না।”

নমুনা প্রস্তুত করে জিন বিন্যাসের জন্য সিকোয়েন্সিং মেশিনে দিতে কয়েক ঘণ্টা লেগে যায়। এনআইভির এই জিন বিন্যাসের যন্ত্রটি কেনা হয় মহামারীর শুরুর দিকে, গত বছর মার্চে।

যন্ত্রটি নমুনা থেকে জিন বিন্যাস বিশ্লেষণ করে কিছু ডেটা তৈরি করে। পরে একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে চীনের উহানে প্রথম শনাক্ত হওয়া করোনাভাইরাসের ধরনটির সঙ্গে তুলনা করা হয়। এর মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা জানতে পারেন কোন ধরনটি শনাক্ত হয়েছে। 

দুই সপ্তাহের বেশি সময় আগে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত করার কথা জানান। এর আগে বিশ্বজুড়ে আধিপত্য বিস্তার করা করোনাভাইরাসের ‘ডেল্টা’ ধরনটি প্রথমে শনাক্ত হয়েছিল ভারতে। 

এ বছরের শুরুর দিকে ‘ডেল্টা’ ধরনের বিষয়ে আগেভাগে না জানানোয় সমালোচনার মুখে পড়ে ভারত। পরে সারা বিশ্বে ওই ধরনটির আধিপত্য দেখা দেয়।

এনআইভির পরিচালক ড. প্রিয়া আব্রাহাম বলেন, ”আমরা সেখান থেকে অনেক কিছু শিখেছি। আমরা জানি যে, ভাইরাসকে আমরা যত বেশি ছড়াতে দেব, তত বেশি নতুন একটি ধরন তৈরি হওয়ার সুযোগ বাড়বে। আমাদের এখন আরও বেশি সক্রিয় হতে হবে, আরও বেশি প্রস্তুত থাকতে হবে।”

তবে ভারতের বিরাট জনসংখ্যার বিষয়টি তুলে ধরে নানা সীমাবদ্ধতার কথাও বলেন এনআইভির পরিচালক।  

“আমরা কোনো ক্ষেত্রেই যুক্তরাজ্য কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের মতো অগ্রসর দেশগুলোর কাছাকাছি নই, কিন্তু আমি মনে করি আমরাও অনেক কিছু করেছি। আমাদের এটা মনে রাখতে হবে যে, এসব পদক্ষেপের পাশাপাশি প্রত্যেকের সতর্ক হওয়া উচিত।”

এই গবেষকের মতে, সংক্রমণের তৃতীয় একটি ঢেউয়ের কবলে ভারত পড়তে যাচ্ছে কি না, তা নির্ভর করবে মানুষ এ ভাইরাসকে কতটা ‘উষ্ণ অভ্যর্থনা’ জানাবে, তার ওপর।

“যদি টিকা নিয়ে দ্বিধা থাকে, যদি বদ্ধ জায়গায় গণ জমায়েত হয়, তাহলে তৃতীয় ঢেউ আসবে।”    

১৩০ কোটি মানুষের দেশ ভারতের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের অর্ধেকের বেশি টিকার পূর্ণ দুই ডোজ পেয়েছেন। তারপরও কোটি কোটি মানুষ ঝুঁকির মধ্যেই রয়ে গেছেন।

‘ওমিক্রন’ এর কারণে তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানলে হাসপাতালগুলো দ্রতই উপচে পড়বে বলে সতর্ক করেছেন চিকিৎসকরা।

মুম্বাইয়ের চিকিৎসক ডা. স্বপ্নীল পারিখ বলেন, দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় হাসপাতালগুলোর ধারণক্ষমতার কয়েকগুণ বেশি রোগী সামলাতে হয়েছিল।

“তাই আমাদের যদি ছোট করেও তৃতীয় একটি ঢেউ আসে, যেটাকে আমি সম্ভাবনা মনে করছি, সেটাও আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাকে গ্রাস করে ফেলতে পারে।”

“আমি মনে করি তৃতীয় ঢেউ আসছে কি না, কিংবা এলে কখন আসবে- এসব প্রশ্ন না করে আমাদের বরং প্রস্তুত হওয়া উচিত।” 

বিবিসি লিখেছে, দিল্লির হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে এক মাসের বেশি সময় কোনো কোভিড রোগী ছিল না। কিন্তু গত সপ্তাহ থেকে সেখানে আবার রোগী বাড়ছে।

এ হাসপাতালের প্রধান ডা. সুমিত রায় বলেন, “এমন একটা ভয় এবং উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে যে, আমরা দ্বিতীয় ঢেউয়ের মতে একই পথ বেছে নিচ্ছি।   

“টিকার দুই ডোজ নেওয়া ব্যক্তিদের অনেকে আবারও আক্রান্ত হচ্ছেন, তাই আমাদের আবারও অনেক সতর্ক হওয়ার সময় এখন।”

গত এপ্রিলে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় ভারতের হাসপাতালগুলো কানায় কানায় ভরে যায়। ট্রলি আর হুইলচেয়ারে রেখেও রোগীদের চিকিৎসা দিতে দেখা যায়।

সেসময় অক্সিজেনেরও তীব্র সঙ্কট তৈরি হয়েছিল। আইসিইউতে রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার সময়ও ডা. সুমিত রায়কে অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর জন্য ফোনে ব্যস্ত থাকতে হয়েছে।

দিল্লিসহ ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের হাসপাতালগুলোতে অক্সিজেনের অভাবে অনেকের মৃত্যুও হয়েছে।

ডা. সুমিত বলেন, নতুন করে সঙ্কট দেখা দিলে ভারত সরকারকে আরও গুছিয়ে সম্পদের ব্যবহার করতে হবে। যেখানে জরুরি প্রয়োজন, সেখানে সরবরাহ বাড়ানোর ব্যবস্থা রাখতে হবে।

“বেডের জন্য মানুষের হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ছুটাছুটি করতে হয়েছে, এটা মেনে নেওয়া যায় না। আরও ভালো সমন্বয় দরকার। আমার মনে হয় আমরা এবার প্রস্তুতির সময় পেয়েছি এবং সমন্বয়টা থাকা উচিত।”

এই চিকিৎসক বলেন, একজন চিকিৎসককে মানুষের জীবন রক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কিন্তু প্রয়োজনীয় উপকরণের অভাবে তিনি যদি সেটা না পারেন, তাহলে নিজেকে তার ব্যর্থ মনে হবে।

“পেশাদার চিকিৎসক হিসেবে এটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে বাজে সময়।”

মহামারীর সম্ভাব্য নতুন ঢেউ মোকাবেলায় সরকারের তরফ থেকে প্রস্তুতির কথা বলা হলেও ‘আরও অনেক কিছুই; করা দরকার বলে মনে করেন মুম্বাইয়ের এই চিকিৎসক।

“আমার মনে হয় আমাদের যত বেশি মানুষকে সম্ভব টিকার পূর্ণ ডোজ দেওয়া দরকার। এছাড়া বয়স্ক এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে তৃতীয় ডোজ দেওয়া উচিত। বিশেষ করে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম এবং স্বাস্থ্যকর্মী ও সম্মুখসারির যোদ্ধা হিসেবে যারা কাজ করেন তাদের।”

এই চিকিৎসক বলেন, “এদেশে মহামারীর দ্বিতীয় ঢেউয়ের সময় আমরা জুয়া খেলেছি এবং তাতে আমরা হেরে গেছি। তাই এবার বিপরীতটা করতে হবে। আমাদের বাড়তি প্রস্তুতি নিতে হবে।”

আরও পড়ুন